মুমিনের যে সব আমলে জান্নাতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

ফখরুল ইসলাম নোমানী | শুক্রবার , ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ

প্রত্যেক মুসলমানের চূড়ান্ত লক্ষ্যউদ্দেশ্য ও একান্ত আশাআকাঙ্ক্ষা হচ্ছে জান্নাতের মেহমান হওয়া। কেননা জান্নাত অনন্ত সুখ, শান্তি ও অসংখ্য নিয়ামতের জায়গা। আল্লাহতাআলা নিজেই জান্নাতের দিকে বান্দাদের ডেকেছেন। কোরআনে এরশাদ হয়েছে আল্লাহ শান্তির ঘরের দিকে ডাকছেন। (সুরা ইউনুস : ২৫) জান্নাত একটি সুপরিচিত শব্দ। শব্দটির অর্থ উদ্যান, সুখময় স্থান ইত্যাদি। পরিভাষায় পার্থিব ক্ষণস্থায়ী জীবনের অবসানের পর মুমিনের অনন্ত সুখময় চিরস্থায়ী জীবনের জন্য আল্লাহতাআলার সুসজ্জিত প্রস্তুত করে রাখা আবাসকে জান্নাত বলা হয়। যে কেউ ইচ্ছা করলেই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।এ জন্য মানতে হবে কোরআনসুন্নাহর বিধান। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে আল্লাহ তাকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার তলদেশে প্রবহমান থাকবে নহর। আর যে ব্যক্তি তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তাকে দেবেন যন্ত্রণাময় শাস্তি। (সুরা : ফাতহ : আয়াত : ১৭) জান্নাত লাভের ছোটবড় আমল অনেক আছে। মুমিনের জীবনের একমাত্র আরাধনা হলো মহান আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) এর দেখানো পথে চলে দুনিয়ার হায়াত নামক সংক্ষিপ্ত সফর শেষ করে পরকালে জান্নাত লাভ করা। সেই জান্নাত লাভের বহু পথপদ্ধতি কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত আছে। সেগুলোর মধ্য থেকে এখানে এমন আমলের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে যা করলে নির্বিঘে জান্নাত যাওয়া যাবে। পৃথিবীতে নবীর সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন একমাত্র সাহাবায়ে কিরাম। দুনিয়ার জীবনে আর কোনো মুমিনের এ সৌভাগ্য ললাটে আসবে না। তবে নবীজি (সা.) এমন কিছু আমল বর্ণনা করেছেন যা পালন করলে মুমিন ব্যক্তি জান্নাতে তাঁর সান্নিধ্য লাভ করবেন যা হলো :

. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া: নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইবাদত। কোরআন হাদিসে নামাজ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা করা হয়েছে। নিয়মিত নামাজ আদায়ের পুরস্কার জান্নাত। উবাদা ইবনে সামিত (রা.) বলেন আমি রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি আল্লাহতাআলা বান্দার ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। যে ব্যক্তি এই নামাজগুলো যথাযথভাবে আদায় করবে এবং অবহেলাবশত তাতে কোনো ত্রুটি করবে না তার সঙ্গে আল্লাহতাআলার চুক্তি হয়েছে যে তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।

. আয়াতুল কুরসি পাঠ করা: আয়াতুল কুরসি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে কোরআনের আয়াতগুলোর সর্দার বলা হয়েছে। ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে মৃত্যু ছাড়া জান্নাতে যাওয়ার পথে তার কোনো বাধা থাকবে না।

. সায়্যিদুল ইস্তেগফার পাঠ: ক্ষমা প্রার্থনার অনেক বাক্য আছে। তার মধ্যে সায়্যিদুল ইস্তেগফার শ্রেষ্ঠ। “আল্লাহুম্মা আনতা রব্বী লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাক্বতানী, ওয়া আনা আবদুকা ওয়া আনা আলা আহদিকা ওয়া ওয়া’দিকা মাসতাত্বা’তু, আ’ঊযুবিকা মিন শার্রি মা ছানা’তু। আবূউ লাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়া ওয়া আবূউ বিযাম্বী ফাগফিরলী ফাইন্নাহূ লা ইয়াগফিরুয্‌ যুনূবা ইল্লা আনতা”। সকালসন্ধ্যা এ ইস্তেগফার পাঠের ফজিলত জান্নাত। শাদ্দাদ ইবনে আউস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি দিনের বেলা সায়্যিদুল ইস্তেগফার পাঠ করবে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সে মারা গেলে জান্নাতি হবে।

. কালেমা শাহাদাত পাঠ করা : অজু শেষে আকাশ বা ওপরের দিকে তাকিয়ে কালেমা শাহাদাত পাঠকারীর জন্য জান্নাত। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন যে ব্যক্তি কামিল বা পূর্ণরূপ অজু করে পাঠ করবে ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।’ তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে যাবে এবং যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।

. আজানের জবাব দেওয়া : আজান শুনে জবাব দেওয়া সুন্নত। এর প্রতিদান জান্নাত। রাসুল (সা.) বলেন আজানের জবাব যদি কেউ মন থেকে (গুরুত্বের সঙ্গে) বলে তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

. বিশেষ তিনটি আমল : কারো সঙ্গে কথোপকথনের আগে সালাম বিনিময় করা মানুষকে খাওয়ানো এবং তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া সহজ এই তিনটি আমলের বিনিময়ে জান্নাত লাভ হবে। রাসুল (সা.) এর সঙ্গে সর্বপ্রথম সাক্ষাতের সময় আমি তাঁকে কথা বলতে শুনেছি হে লোক সকল! তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও। খাবার খাওয়াও। মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন (অর্থাৎ শেষ রাতে) নামাজ পড়ো। তাহলে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

. দুই জিনিসের হেফাজত করা : মুখ ও যৌবন হেফাজত করার প্রতিদান জান্নাত। রাসুল (সা.) বলেন যে ব্যক্তি জিহ্‌বা ও লজ্জাস্থান হেফাজতের নিশ্চয়তা দেবে আমি তার জন্য জান্নাতের দায়িত্ব নেব।

. আপনজনের মৃত্যুতে ধৈর্য ধারণ : প্রিয়জনদের ইন্তেকালে ধৈর্য ধারণ করার প্রতিদান জান্নাত। রাসুল (সা.) বলেছেন আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি যখন আমার কোনো মুমিন বান্দার অতি প্রিয় ব্যক্তিকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নিই অতঃপর সে সওয়াবের আশায় ধৈর্য ধারণ করে আমার কাছে তার প্রতিদান হলো জান্নাত।

. সালামের প্রসার ঘটানো : একজনের সঙ্গে অপরজনের সাক্ষাৎ হওয়ার পর সালামের মাধ্যমে সম্ভাষণ জানানোর চেয়ে উত্তম কোনো সম্ভাষণ নেই। সালাম মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। পরস্পরের মধ্যে হৃদ্যতা বৃদ্ধি করে। যে আগে সালাম দেয় সে অহংকার থেকে মুক্ত হয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করল ইসলামে সর্বোত্তম কাজ কী ? তিনি বললেন চেনাঅচেনা সবাইকে সালাম দেবে।

১০. ক্ষুধার্তকে অন্নদান : হাদিস থেকে জানা যায় শেষ বিচারের দিনে মহান আল্লাহ বলবেন আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম তোমরা আমাকে খাবার দাওনি কেন? অপরাধীরা বলবে হে আল্লাহ! আপনি তো মহান সত্তার অধিকারী। আপনাকে খাবার কীভাবে দিতাম? তখন মহান আল্লাহ বলবেন তুমি কি জানতে না যে আমার অমুক বান্দা ক্ষুধার্ত ছিল? যদি তাকে খাবার খাওয়াতে তাহলে সেটার প্রতিদান এখন আমার কাছে পেতে।

১১. আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখা : আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে যেতে পারবে না। হজরত জুবায়ের ইবনে মুতইম (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি নবী (সা.) কে বলতে শুনেছেন আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। সুতরাং জান্নাতে যেতে চাইলে অবশ্যই আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে এবং তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে।

১২. তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়: তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মহান আল্লাহর নৈকট্য ও মর্যাদা লাভের সিঁড়ি। নবী (সা.) কে তাহাজ্জুদের নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়ুন।

মহান আল্লাহ আমাদের নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়সহ সালামের প্রসার ক্ষুধার্তকে অন্নদান এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার তওফিক দান করুন। আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে নবিজীর (সা.) অনুসরণ ও অনুকরণে ছোট থেকে বড় সব বিষয়ে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করার মাধ্যমে ইবাদতবন্দেগিতে নিয়োজিত থাকার ও আমাদের এই আমলগুলো যথাযথ পালনের মাধ্যমে নবী (সা.) এর সান্নিধ্য অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপুতুল বধূ
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা