মুনাফিকের পরিচয়

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ৯ মে, ২০২৫ at ১০:১৯ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত, সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর যুগেও মুনাফিকের অপতৎপরতা ছিল, এখনও আছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। মুনাফিকদের সর্দার ছিল আবদুল্লাহ ইব্‌নে উবাই বিন সালুল। তিনি আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর ঠিক পেছনে নামাজ পড়তেন জামাতের সাথে কিন্তু মনে মনে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর আদর্শের বিরোধিতা করতেন। বর্তমান পৃথিবীতে এখনও প্রতিটি জনপদে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইদের তৎপরতা বেশ লক্ষণীয়। তারা মুসলমানদের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করতে চায় এবং ঈমানদার মুসলমানদের বিপথগামী করতে চায় কিন্তু আল্লাহর প্রিয় বান্দারা তাদের সেই পাতা ফাঁদে পা দেয় নাএটাই মুমিনের বৈশিষ্ট্য। মুনাফিকদের নিয়ে আল্লাহতায়ালা একটি সূরাই নাযিল করেছেন। এটি কুরআনুল মজিদের ৬৩ নং সূরা। এতে বলা হয়েছে, ‘মুনাফিকরা যখন তোমার কাছে আসে, তখন তারা বলে (হে মুহাম্মদ), আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছিতুমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল (সাঃ)। আল্লাহতায়ালা জানেন, তুমি নিঃসন্দেহে তাঁর রাসূল; আল্লাহতায়ালা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী’সূূরা আল মুনাফেকুন০১। আল্লাহতায়ালা মুনাফিকদের সম্পর্কে খবর দিতে গিয়ে বলেন যে, যখন তারা নবী (সাঃ) এর নিকট আসে তখন শপথ করে করে ইসলাম প্রকাশ করে এবং তাঁর রিসালাত স্বীকার করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা মুসলিম নয় বরং এর বিপরীত। মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) কে উদ্দেশ্যে করে বলেন, এই মুনাফিকরা তোমার কাছে এসে শপথ করে করে তোমার রিসালাতের স্বীকারোক্তি করে। কিন্তু তুমি বিশ্বাস রেখো যে, তাদের এই কসমের কোন মূল্য নেই। এটা তাদের মিথ্যাকে সত্য বানানোর একটি মাধ্যম মাত্র। রাসূল (সাঃ) এর সততার ব্যাপারে মুনাফিকরা স্বীকৃতি দেয় বটে কিন্তু অন্তরে তারা এমত পোষণ করে না, যদিও বাহ্যিকভাবে তারা কখনো কখনো স্বীকার করে। তারা তাদের বাহ্যিক স্বীকারোক্তিকে নিজেদের জীবন রক্ষার মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে যে, তারা হত্যা ও কুফরীর হুকুম হতে দুনিয়ায় বেঁচে যাবে। তাদের অন্তরে নিফাক স্থান করে নিয়েছে। মুনাফিকদের বাহ্যিক ব্যবহার ও কথাবার্তায় কোন কোন মুসলিম প্রতারিত হয়ে থাকে। কারণ তাদের মিথ্যা কথন তারা বুঝতে পারে না। ফলে তাদেরকে মুমিন বলে ভুল করে। আবার কোন কোন মুসলিম মুনাফিকদের কথাকে বিশ্বাস করে এবং তাদের আচার আচরণকেঅনুকরণ করে। মুনাফিকরা তো মনে মনে এই চায় যে, ইসলাম এবং এর অনুসারীরা ধ্বংস হোক। তাই মুনাফিকদের অনুসরণ মুসলিমদের জন্যে বয়ে আনতে পারে অপুরণীয় ক্ষতি। এজন্য আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তারা আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করে। তারা যা করছে তা কত মন্দ’ (তাবারী২৩/৩৯৪)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘এটা এজন্য যে, তারা ঈমান আনার পরে কুফরী করেছে। ফলে তাদের হৃদয় মোহর করে দেওয়া হয়েছে, অতঃপর তারা কিছুই বুঝে না। আল্লাহতায়ালা তাদেরকে এজন্য মুনাফিক আখ্যায়িত করেছেন যে, তারা ঈমানের পরিবর্তে কুফরীকে এবং হেদায়াতের পরিবর্তে ধ্বংসকে গ্রহণ করে নিয়েছে। একারণে আল্লাহতায়ালা তাদের অন্তর সীল করে দিয়েছেন। ফলে তারা সৎ পথ প্রাপ্ত হয় না এবং কোন উত্তম কথাও তাদের অন্তরে পৌঁছে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, তুমি যখন তাদের দেহাকৃতি তোমার নিকট প্রীতিকর মনে হয়, তারা যখন কথা বলে, তখন তুমি সাগ্রহে তাদের কথা শ্রবণ কর। অর্থাৎ মুনাফিকদের রয়েছে মুখের মিষ্টি কথা এবং বাকপটুতা। যখন কেউ তাদের কথা শুনতে পায় তখন তাদের কথা বাক্যালংকার এবং সাজিয়ে গুছিয়ে বলার কারণে সে মুগ্ধ হবে, যদিও মুনাফিকদের অন্তর দুর্বল, ভয়ার্ত ও ভীত থাকে। উহুদের যুদ্ধে মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ ইব্‌নে উবাইকে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ৩০০ জন সৈন্যের নেতা বানিয়ে দিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার মাঝপথে তিনি সাহাবীদেরকে আর সামনে অগ্রসর না হওয়ার কথা বললেন এবং এও বললেন যে, সামনে আর যাওয়া যাবে না এবং নেতার আনুগত্য করা ফরজ অতএব আমার কথা তোমাদের মানতে হবে।

আল্লাহতায়ালা কখনও নাফরমান লোকদের হেদায়াত দান করেন না’সূরা আত তাওবা৮০। মুনাফিকরা যে কোন শোরগোলকে মনে করেন তাদেরই বিরুদ্ধে। অর্থাৎ যখন কোন ভয়াবহ ঘটনা যখন ঘটে তখন তারা ধারণা করে তাদের উপর হয়তো তা আপতিত হচ্ছে। তাই তারা মৃত্যুর ভয়ে হা হুতাশ করে। সূরা আহযাবের ১৯ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা মুনাফিকদের সম্পর্কে বলেন, ‘তারা তোমাদের ব্যাপারে ঈর্ষাবোধ করে। যখন বিপদ আসে তখন তুমি দেখবে যে, মৃত্যুভয়ে মুর্ছাতুর ব্যক্তির ন্যায় চোখ উল্টিয়ে তারা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু যখন বিপদ চলে যায়, তখন তারা সম্পদের লালসায় বাক চাতুরিতায় অবতীর্ণ হয়। তারা ঈমান আনেনি, এজন্য আল্লাহতায়ালা তাদের কার্যাবলী নিষ্ফল করে দিয়েছেন এবং আল্লাহর পক্ষে এটা সহজ। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতরাসূল (সাঃ) বলেছেন, মুনাফিকদের বহু নিদর্শন রয়েছে। যেগুলো দ্বারা তাদেরকে চেনা যায়। তাদের সালাম হল লানত, তাদের খাদ্য হল লুটতরাজ, তাদের গানিমাত হল চুরি, তারা মসজিদের নিকটবর্তী হওয়াকে অপছন্দ করে, সালাতের জন্য তারা শেষ সময়ে এসে থাকে, তারা অহংকারী এবং তারা নম্রতা ও বিনয় প্রকাশ হতে বঞ্চিত থাকে। তারা নিজেরাও ভাল কাজ করে না এবং অন্যদেরকে ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে না। রাতের বেলা তারা এক টুকরা কাঠ এবং দিনে শোরগোলকারী– (আহমেদ/২৯৩)। মুনাফিকদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা তাঁর রাসূল (সাঃ) কে সতর্ক করে বলেছেন, ‘হে নবী, তুমি কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জেহাদ কর এবং তাদের উপর কঠোরতা অবলম্বন কর; কেননা তাদের ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম আর তা হচ্ছে এক নিকৃষ্ট ঠিকানা’সূরা আত তাহরিম৯। কুরআনুল মজিদের সূরা আল বাকারার ১৪ নং আয়াতে মুনাফিকদের চরিত্র এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, ‘তারা যখন ঈমানদারদের সাথে মিলিত হয় তখন বলেআমরা ঈমান এনেছি, যখন একাকী তাদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে, আমি অবশ্যই তোমাদের সাথে আছি, আমরা ঠাট্টা করছিলাম মাত্র। আল্লাহতায়ালাই বরং তাদের সাথে ঠাট্টা করে যাচ্ছেন, আল্লাহতায়ালা তাদের অবকাশ দিয়ে রেখেছেন, তারা তাদের বিদ্রোহে উদভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরা হেদায়াতের বিনিময়ে গোমরাহী কিনে নিয়েছে, তাদের এই ব্যবসাটা মোটেও লাভজনক হয়নি এবং এরা সঠিক পথের অনুসারীও নয়’। মুনাফিকরা মুসলিমদের নিকট এসে নিজেদের ঈমান, বন্ধুত্ব ও মঙ্গল কামনার কথা প্রকাশ করে। তাদেরকে ধোঁকায় ফেলতে চায়, যাতে জান ও মালের নিরাপত্তা এসে যায় এবং যুদ্ধলব্ধ মালেরও ভাগ পাওয়া যায়। আর যখন নিজেদের দলে থাকে তখন তাদের হয়ে কথা বলে। মুনাফিকদের ৩টি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল১। তারা কথায় কথায় মিথ্যা বলে। ২। ওয়াদা ভঙ্গ করে। ৩। আমানত খেয়ানত করে। তাবুকের যুদ্ধে অংশ না নিয়ে আল্লাহতায়ালা মুনাফিকদেরকে ভৎর্সনা করেছেন। যারা আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর সাথে যুদ্ধে না গিয়ে বাড়িতে বসে থাকায় আনন্দিত হয়েছিল। আল্লাহর পথে জান ও মাল দিয়ে জেহাদ করা তাদের কাছে ছিল অপছন্দনীয়। আল্লাহতায়ালা তাঁর রাসূল (সাঃ) কে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তিনি যেন মুনাফিকদের সাথে কোন সম্পর্ক না রাখেন, তাদের কেহ মারা গেলে যেন তার জানাজার সালাত আদায় না করেন এবং তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা বা দু’আ করার উদ্দেশ্যে যেন তার কবরের কাছে না দাঁড়ান।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারী-পুরুষ, বিবাহ ও সংসার
পরবর্তী নিবন্ধমননে ও নান্দনিকতায় অনন্য রবীন্দ্রনাথ