বর্বর, কুটিল পাকবাহিনীর হাজার চেষ্টা যে বজ্রকণ্ঠ থামাতে পারেনি, এই বাংলার ঘাতকের অসংখ্য বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে সেই বজ্রকণ্ঠ থেমে গিয়েছিল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। বিশ্বের ইতিহাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড অসংখ্যবার ঘটেছে, কিন্তু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের প্রভাব সারা বিশ্বের মেহনতি এবং শোষিত মানুষের কণ্ঠকে বিদ্ধ করে দিয়েছিল, বন্ধ করে দিয়েছিল প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বরকে। বিশ্বের নিপীড়িত এবং নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতীক হিসেবে শেখ মুজিবকে দেখা হতো। তৃতীয় বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বিশ্বকে তাঁর বক্তব্যের মর্মার্থ বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, শোষিত মানুষের জন্য আমরণ সংগ্রাম করে যাবেন। আদতেই নিজের জীবন দিয়ে স্বীয় বক্তব্যের যথোক্তি তিনি প্রমাণ করেছেন। মৃত্যু-অবধি দুঃখী মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতীক হয়ে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল ছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিলেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে। তিনি তাঁর লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করেছিলেন। বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিলে তিলে প্রস্তুত করেছিলেন এবং বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করে বঙ্গবন্ধুর সারা-জীবনের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নকে পূরণ করার গৌরব দেখিয়েছে। প্রকৃত অর্থে, বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক জীবনকাল হচ্ছে গবেষণার বিষয়বস্তু, তিনি রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট। একটা মানুষ কীভাবে সাধারণের কাছে এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে সেটাই গবেষণার উপকরণ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, তবে কেন এমন হত্যাকাণ্ড? কেন বাংলার গণমানুষের মুক্তির মহানায়কের ওপর এমন বর্বরতা? প্রশ্নের উত্তরের জন্য তথ্য-দলিল এতদিনে অপ্রতুল নয়। ২১ ডিসেম্বর ১৯৭৩, সাংবাদিক মাইকেল বার্নস ঘব িঝঃধঃবংসধহ সাময়িকীতে বাংলাদেশের ওপর একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন, যেখানে শেষ দিকে লেখা হয়েছিল, “আগামী বিপজ্জনক ও জটিল বছরগুলোতে অনেকদিন বাংলাদেশের প্রয়োজন হবে মুজিব ধরনের নেতৃত্ব”।
কিন্তু মাইকেল বার্নস এবং খুনিদের হিসাবে গরমিল ছিল; ১৯৭২ থেকে ষড়যন্ত্র শুরু করে তারা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সফল হয়েছিল, ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সেদিন বঙ্গবন্ধুসহ ১৭ জনের প্রাণহরণ করা হয়েছিল। ১৬ আগস্ট, লন্ডন টাইম্স-এ সম্পাদকীয় মন্তব্য ছিল, ‘শেখ মুজিবকে যদি এমন হৃদয়বিদারকভাবে হত্যা করা হয়, তাহলে স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রয়োজন ছিল না’।
রাজনৈতিক ব্যক্তিকে হত্যা নজিরবিহীন নয়; কিন্তু স্বজন-পরিজন এমনকি ১০ বছরের ছোট শিশু রাসেলকে হত্যা, দৃষ্টান্তরহিত। শুধু মুজিব হত্যা নয়, খুনিদের লক্ষ্য ছিল, মুজিব নেতৃত্বের কোনো চিহ্ন না রাখা। তবে দৈবাৎ বেঁচে গিয়েছিলেন দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। সৌভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনা এখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী; আর সে কারণে খুনিদের বিচার ত্বরান্বিত হয়েছে। অর্থাৎ খুনিদের হিসাবে ভুল হয়েছিল।
১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের কাছাকাছি একটি দৃষ্টান্ত আছে। ১৮৫৭-এর সেপ্টেম্বর মাসে ইংরেজ সৈনিক কর্নেল হডসন বাহাদুর শাহ্-র চার রাজপুত্রকে একসঙ্গে গুলি করে হত্যা করেছিল। বেশ কিছুদিন পর ইংরেজ ইতিহাসবিদ ম্যালেসন ভারতে ইংরেজদের গৌরবগাথা নিয়ে ইতিহাস রচনা করার সময়ে হডসন-এর হত্যাকাণ্ড নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এটা অপ্রয়োজনীয় এবং অপরাধ ছিল ‘খোদ ইংরেজ ইতিহাসবিদ তার স্বজাতি একজনের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন এভাবে। চারজনকে হত্যা করার জন্য যদি এমন মন্তব্য হয়, তাহলে ১৫ আগস্টের হত্যা সম্পর্কে কেমন মন্তব্য হওয়া উচিত? ইতিহাসের সবচেয়ে কলংকৃত এই হত্যাকাণ্ডের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে চুম্বক অংশ গুলোর দিকে আলোকপাত করা যাক। প্রথমত, আত্মস্বীকৃত খুনিরা হিমশৈলের শীর্ষভাগে ছিল, তারা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেছিল মাত্র। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী ছিল, যাদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয় ছিল।
দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর বড় অপরাধ ছিল বাংলাদেশ সৃষ্টির অনুঘটক হওয়া এবং দেশটিকে যেভাবে গড়ছিলেন। একাত্তরে মোশতাক, তাহেরউদ্দীন ঠাকুর এবং মাহবুবুল আলম চাষী (গোঁড়া দক্ষিণপন্থী) মার্কিন যোগসাজশে মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করতে চেয়েছিল, কিন্তু তাজউদ্দীন আহমেদের শক্ত ভূমিকার কারণে উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়। কিন্তু বাহাত্তর থেকে ষড়যন্ত্র নতুন করে শুরু হয় এবং যুক্ত হয় সেনাবাহিনীর কর্নেল ফারুক-রশিদ। বাহাত্তর থেকে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল তার প্রমাণ ২০০৫-এ অবমুক্ত মার্কিন দলিলে আছে, আর তখন থেকেই ফারুক ও রশিদ এবং যুক্তরাষ্ট্র সংযোগ স্থাপিত হয়, যা চলমান ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যা পর্যন্ত। তৃতীয়ত, বঙ্গবন্ধু এক বাম নেতাকে একবার কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, মোশতাক আমাকে কালকে কী বলেছে জানো? বলেছে এত সমাজতন্ত্র করবেন না, এত ধর্মনিরপেক্ষতা করবেন না। একটু আল্লাহ আল্লাহ করেন, ব্যক্তি খাতকে গুরুত্ব দেন। ওকে আমি বলে দিছি, মোশতাক, তোর কথা আমি শুনলাম না। আমার দেশের কৃষক-শ্রমিক অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছে, জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, (তাদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য) আমি সমাজতন্ত্রের পথেই যাব, আমি ধর্মনিরপেক্ষতার পথেই যাব।
চতুর্থত, বঙ্গবন্ধু আলজিয়ার্স জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে (৬-৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩) যা বলেছিলেন, তাতে বিশ্বমোড়লদের হৃৎকম্প হওয়ার কথা। তিনি বলেছিলেন, বিশ্ব আজ দুভাগে বিভক্ত-শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। এমন বক্তব্যের জন্য ফিদেল ক্যাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দিত করে সতর্ক করে বলেছিলেন, আজ থেকে তোমাকে একটি বুলেট অনুসরণ করবে। ক্যাস্ত্রোর সেই কথা মিথ্যা হয়নি। দেশে ফিরে ১১ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু খবর পেলেন, চিলির অ্যালেন্দেকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি তখন বিড়বিড় করে বলেছিলেন, আমাকেও হয়তো অ্যালেন্দের ভাগ্যবরণ করতে হবে। হয়তো নয়, তাই হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দেশি-বিদেশি সতর্ককারীর অভাব হয়নি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এক উত্তর- কোনো বাঙালি আমাকে মারবে না।
বাঙালির স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি বুঝতে পেরেছিল যে বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের বাঙালিদেরকে হাজার বছর পিছিয়ে দেবার নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে হলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিকল্প নেই। আজীবন বাঙালির স্বাধিকার ও মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন করে যার বছরের পর বছর কেটেছে কারাগারের প্রকোষ্ঠে, পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি উপেক্ষা করে যিনি জীবনের শেষ ক্ষণটিতেও চিন্তা করে গেছে এদেশের আপামর দুঃখী মানুষের কথা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সেই বাঙালির আকাশসম উদার বুকের রক্তেই তবু রঞ্জিত হয়েছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের প্রাঙ্গণ, কলংকিত হয়েছিল দেশ, অভিশপ্ত হয়েছিল এ জাতি। বহু বাধা পেরিয়ে হত্যাকান্ডের ৩৪ বছর পর বিচার সম্পন্নের মাধ্যমে যদিওবা সেই কলঙ্ক থেকে জাতি কিছুটা হলেও রেহাই পেয়েছে, তবু প্রশ্ন থেকেই যায়, এই অভিশাপ থেকে, ইতিহাসের দায় থেকে কতটা মুক্ত হতে পারল জাতি? আদৌ পেরেছে কি?
তবে বাংলাদেশ থেমে থাকেনি। জাতির পিতার দেখানো পথে হেঁটে চলেছে বাংলাদেশ। মাঝখানে নানা চড়াই-উতরাই, ঘাত-প্রতিঘাত, চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা, গণতান্ত্রিক শূন্যতা এসেছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত বাঙালি সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে বারবার গেঁথেছে গৌরবগাথা। বিজয়ের ৫০ বছরে বাংলাদেশ সকল সূচকে অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। দারিদ্র্যমোচন, শিক্ষার প্রসার, নারী উন্নয়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
শেষের দিকে এসে একটা চিন্তার খোরাক দিতে চাই। দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার স্মরণ দিবস গুলোতে সেখানকার অধিবাসীরা বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করে, শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। আমরাও যদি বঙ্গবন্ধুর স্মরণ দিবসগুলোতে তাঁর জীবনী ও কাজের আলোচনার পাশাপাশি এদিনটিতে সমাজের সকল স্তরের সকলে মিলে তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করে যার যার জায়গা থেকে সমাজ, সর্বোপরি রাষ্ট্রের বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে অবদান রাখতে পারি তবে সেটিই হবে জাতির পিতার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার মহার্ঘ ও অপরিসীম ভালবাসার অনন্য বহিপ্রকাশ। ব্যাপারটি নিয়ে ভাববার জন্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, নাক কান গলা হেড নেক সার্জারি বিভাগ,
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।