মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ ও মুক্তিসংগ্রামে অবদান

ড. মো. মোরশেদুল আলম | সোমবার , ১৭ এপ্রিল, ২০২৩ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনার পর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, বিশ্ব জনমত সৃষ্টি, কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন প্রভৃতির জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাপকভাবে অনুধাবন করেন। এরূপ পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালে ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জন্ম। মুজিবনগর সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের কূটনেতিক স্বীকৃতির প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায় এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ দেশের স্বাধীনতার জন্য অসম যুদ্ধে সারা বিশ্বের সহযোগিতা কামনা করেন। প্রবাসী সরকার গঠনের পর ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে আবার বিশ্বসমর্থন ও কূটনেতিক স্বীকৃতির আহ্বান জানানো হয়। ১৭ এপ্রিল মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়। কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথ তলা গ্রামে মুজিবনগর সরকারের আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র হলো আমাদের ম্যাগনাকার্টা, স্বাধীনতার সনদ। এই ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে কেন, কোন্‌ ক্ষমতা বলে এবং পরিস্থিতিতে একটি স্বাধীনসার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলো, যেরাষ্ট্রের নাম হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। যেহেতু এই সরকার মুজিবনগরে তার প্রধান দপ্তর স্থাপন করেছিল তাই ‘মুজিবনগর সরকার’ হিসেবে সমধিক পরিচিত। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে কলকাতায় এই সরকারের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়েছিল প্রধানত নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধের নির্বিঘ্ন নেতৃত্ব দেয়ার জন্য।

মুজিবনগর সরকার ছিল সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম। এই সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি দেশবিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছিল। মুজিবনগর সরকার গঠনের মূল লক্ষ্য ছিল দেশকে পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতা অর্জন। মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত করা, তাদের নেতৃত্ব দেওয়া, তাদের সরঞ্জাম ও রসদের ব্যবস্থা করা, যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা, শরণার্থীদের পুনর্বাসন, নিয়মিত ও গেরিলা বাহিনীগুলোকে সুসংগঠিত করা, মুক্তিবাহিনীর বীরত্বের কথা জাতিকে জানানো ও তাদের উদ্বুদ্ধ করা, সেক্টর কমান্ডারদের সহায়তা , তাঁদের সাথে যোগাযোগ ও কৌশল নির্ধারণ প্রভৃতি ছিল প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের কাজ। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের নানা অঙ্গনের একটি। এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য ছিল বিবিধ। এই উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল সর্বাগ্রে পাকিস্তানকে এক ঘরে করা, অত্যাচার বন্ধ করতে এবং সমঝোতায় আসতে চাপ প্রয়োগ করা এবং সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে তাদের দুর্বল করা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য আহরণ করা ছিল আর একটি উদ্দেশ্য। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক জনমত ছাড়া ভারতের দৃঢ়তর ও ব্যাপক সাহায্য নিশ্চিত করাও সম্ভব ছিল না। শরণার্থীর বোঝা ছিল খুবই বেশি, সামরিক সাহায্যও ছিল দুষ্পাপ্য এবং কূটনেতিক সমর্থন ছাড়া ভারতের পক্ষে বালাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়া ততো সহজ ছিল না। প্রত্যেক দেশে ও প্রত্যেক মঞ্চে কথা বলা এবং সমর্থন আদায় করা ছিল মুজিবনগর সরকারের লক্ষ্য। মুজিবনগর সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের কূটনেতিক স্বীকৃতির প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায় এবং প্রধানন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ দেশের স্বাধীনতার জন্য অসম যুদ্ধে সারা বিশ্বের সহায়তা কামনা করেন। প্রবাসী সরকার গঠনের পর ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে আবার বিশ্বসমর্থন ও কূটনেতিক স্বীকৃতির আহ্বান জানানো হয়। ১৭ এপ্রিল মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়। কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথ তলা গ্রামে মুজিবনগর সরকারের আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান এবং কর্নেল (অব.) আতাউল গণি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মুজিবনগরে মন্ত্রিসভার অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী পুনরায় বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেন। বাংলাদেশের নির্দিষ্ট দাবি ছিল: . সামরিক সাহায্য, . মানবিক ও ত্রাণ সাহায্য (দখলিকৃত এলাকার বাঙালির জন্য এবং ভারতে আশ্রয়প্রার্থী শরণার্থীদের জন্য), . পাকিস্তানের জন্য সামরিক সাহায্য স্থগিত এবং ৪. পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন জনাব আব্দুল মান্নান এম. এন. এ। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন তৎকালীন চীফ হুইফ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ ও একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ঐতিহাসিক এবং শাসনতান্ত্রিক উভয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গুরুত্ব বহন করে।

ঘোষণাপত্রের অন্য অংশটিতে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা এবং চেইন অব কমান্ড চিহ্নিত করা হয়। আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় উভয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতাকে সুনিয়ন্ত্রিত করে উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালনা করা এবং তাকে একটি আইনগত ভিত্তি দেয়ার জন্য এটি প্রয়োজন ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ‘জাতিপুঞ্জের সদস্য হিসেবে সকল দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা পালন করার এবং সম্মিলিত জাতিসংঘের সনদ মেনে চলার’ প্রস্তাব গ্রহণ ও কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেন। ২৫ মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের ওপর হামলার ঘটনাটিকে সামনে রেখে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ঘোষণাপত্রটি কার্যকর করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ঘোষণাপত্রে বর্ণিত ক্ষমতাবলে বিদ্যমান সকল আইন ঘোষণাপত্র সাপেক্ষে বৈধ করার জন্য এবং ‘জনগণের ইচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল ধরনের সংশোধনী আনার লক্ষ্যে একটি ‘আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়োগ আদেশ১৯৭১’ জারি করেন।

মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি বৈধ কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি হয়। একটি কার্যকর সরকার হিসেবে মুজিবনগর সরকার অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম তথা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও মুক্তাঞ্চলে প্রশাসন চালু এবং পররাষ্ট্র বিষয়ে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। মুজিবনগর সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি এবং রাষ্ট্রসমূহের স্বীকৃতি আদায় করা। বৈদেশিক ক্ষেত্রে এই সরকার বহুমুখী তৎপরতা চালায় এবং মানবজাতির সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক ফোরাম জাতিসংঘে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়ের এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মযহারুল ইসলাম তাঁর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গ্রন্থে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার গঠন ও প্রধান সেনাপতি নিয়োগের পর মুক্তিবাহিনী দ্রুত সংগঠিত করা অত্যাবশ্যক হওয়ার প্রেক্ষাপটে প্রথম পর্যায়ে প্রয়োজন ছিল প্রথমত: যে সমস্ত বেঙ্গল রেজিমেন্ট, . পি. আর, পুলিশ, মোজাহিদ, আনসার বাহিনী বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছিল তাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে এক কমান্ডে নিয়ে আসা। দ্বিতীয়ত: হানাদার বাহিনীর মনোভাব, শক্তি ও প্রকৃতি সাপেক্ষে যুদ্ধ স্ট্র্যাটেজী তৈরী করা। তৃতীয়ত: মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী বিভিন্ন সামরিক অফিসারকে যথোপযুক্ত দায়িত্বে নিয়োগ করা এবং যুদ্ধ এলাকা নির্ধারণ করা। চতুর্থত: যে বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও কৃষকশ্রমিকদের মধ্য থেকে যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আসছিল তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে নিয়োগ করা। পঞ্চমত: অস্ত্র ও অন্যান্য যুদ্ধ উপকরণের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সজ্জিত করা।’

যুদ্ধের সুবিধার্থে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে প্রতিটি সেক্টরে একজন করে সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক সংগঠন আরও বিকশিত হয়ে স্থল বাহিনী ছাড়াও তিনটি ব্রিগেড ফোর্স (এস, কে ও জেড) এবং বিমান ও নৌবাহিনী গড়ে ওঠে। মুক্তিবাহিনী সরকারি পর্যায়ে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। যথা: নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনী। নিয়মিত বাহিনীতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর লোকজন ছিলেন। মুজিবনগর সরকার একটি যথার্থ সরকার হিসেবে কার্যকরী ছিল। সাধারণত প্রবাসী সরকার শুধু যুদ্ধ বা প্রতিরোধ পরিচালনা করে; কিন্তু মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ছাড়াও প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজে সফলতার পরিচয় দেয়। বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণ বহির্বিশ্বে প্রচার করা এবং এর প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি এবং সম্ভব হলে স্বীকৃতি আদায় করাও ছিল মুজিবনগর সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। বিশ্বে বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের জনগণের বাংলাদেশ এবং বাঙালিদের প্রতি যে সহানুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল তা ওই সরকারের বিভিন্নমুখী প্রচেষ্টার ফসল। মুজিবনগর সরকার যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ সরকার তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সরকারের নিকট স্পষ্ট হতে বেশি সময় লাগেনি। পাকিস্তান সরকার ও তার দোসরদের অপপ্রচার সত্ত্বেও মুজিবনগর সরকারের প্রতি বিশ্বব্যাপী সহানুভূতি ও নৈতিক সমর্থন গড়ে উঠার প্রধান কারণ ছিল প্রবাসী সরকারের স্বাধীন ও সার্বভৌম নীতিসমূহ এবং কার্যকলাপ। বাঙালি আমলা, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাধারণ জনগণ সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হয়। মুক্ত এলাকায় প্রশাসন বহাল রাখে। বাংলাদেশে এবং শরণার্থী শিবিরে মানুষের মনোবল সুদৃঢ় রাখতে সক্ষম হয়। একই সঙ্গে ভবিষ্যৎ মুক্ত বাঙলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়েও মৌলিক নীতিমালা ও পরিকল্পনা প্রণয়নে সক্ষম হয়। বস্তুত মুজিবনগর সরকার সার্থক মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে।

লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদিল্লির কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর দরগাহ: সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির হাজার বছরের ঐতিহ্য
পরবর্তী নিবন্ধসিএসইতে লেনদেন ১২.৯১ কোটি টাকা