মুছে যাচ্ছে রংমহলের রং

চকরিয়া প্রতিনিধি | বুধবার , ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম রংমহল। রংমহল গ্রামের পাশে প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। পার্কের সীমানা দেয়াল লাগোয়া রয়েছে প্রায় ৫শ একরের একটি বড় বিল। এই বিল ‘দাঙ্গার বিল’ হিসেবে পরিচিত। এই বিলের মধ্যে টিলা শ্রেণীর পাহাড়ও রয়েছে। বিলের চারপাশে সংরক্ষিত বনভূমিতে সৃজন করা আছে সামাজিক বনায়ন।
সম্প্রতি দেখা গেছে, রংমহল গ্রামের রং আর রূপ গত দুই মাস ধরে পাল্টে ফেলা হচ্ছে। দাঙ্গার বিলের টিলা ও সমতল শ্রেণীর জমির মাটি অসংখ্য এস্কেভেটর দিয়ে কেটে ফেলা হচ্ছে। প্রতিদিন শত শত গাড়ি মাটি অন্যত্র বিক্রি করে দিচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। এস্কেভেটর দিয়ে ২০ ফুটের বেশি গভীরে গিয়ে গর্ত করে বিলের বিভিন্ন স্থানে বসানো হয়েছে শক্তিশালী ড্রেজার। ড্রেজারে ৫০-৬০ ফুট গভীর থেকে তোলা হচ্ছে বালু। এতে ওই এলাকায় পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন শত শত গাড়িতে করে মাটি পরিবহনের কারণে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে ডুলাহাজারা-বগাইছড়ি সড়ক। রংমহল গ্রামের মানুষ ধুলোর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। আগামী বর্ষায় ভূমিধসের আশঙ্কায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে গ্রামের কয়েকশ বাসিন্দার মাঝে। সীমানা দেয়াল ধসে যাওয়ার আশঙ্কা সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষের। তবে এ ব্যাপারে মুখ খুলছেন না কেউ। অভিযোগ আছে, ধ্বংসযজ্ঞে আছেন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী নেতা। সিন্ডিকেটে আছেন স্থানীয় ডুলাহাজারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রংমহল গ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত বগাইছড়ি ছড়ার বউ ঘাটা পয়েন্টে দুটি নাশিতে মাটি ফেলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পানির প্রবাহ। ছড়ার ওপর তৈরি করা মাটির বাঁধ কাম সড়কের ওপর দিয়ে নেয়া হচ্ছে শত শত ট্রাক মাটি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়রা আজাদীকে বলেন, পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছেন ডুলাহাজারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাইফুল এহেছান চৌধুরী। দুই মাস ধরে চলা এই চিত্র যাতে কোনো গণমাধ্যমকর্মী ধারণ করতে না পারেন সেজন্য সেখানে বসানো হয়েছে পাহারা। ধ্বংসযজ্ঞের শুরুর দিকে স্থানীয়দের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে ইউএনওর নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের একটি দল সেখানে গিয়ে মাটি পরিবহনের সময় দুটি গাড়ি জব্দ করে। তবে ডুলাহাজারা ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মো. নুরুল আমিন দাবি করেছেন, পরিবেশ বিধ্বংসী কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত নন। বগাইছড়ি ছড়ায় মাটি ফেলে পানির প্রবাহ কে বন্ধ করেছে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। অভিযুক্ত অন্যরাও কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত নন বলে দাবি করেছেন।
উল্লেখ্য, রংমহলের দাঙ্গার বিলের টিলা শ্রেণীর বিপুল পরিমাণ সমতল ভূমির স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে স্থানীয় এনামুল হক গংয়ের দায়ের করা মামলায় উচ্চ আদালতের দেওয়া নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে। এরপরও প্রভাবশালীরা নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করছে না বলে অভিযোগ জমির মালিকদের। তবে রংমহল এলাকার যে জায়গা থেকে মাটি অপসারণ করা হচ্ছে তা পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত এবং সেখানে বনবিভাগের কোনো জায়গা নেই বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুল এহেছান চৌধুরী। তিনি আজাদীকে বলেন, সেখানে মাছ চাষ করার জন্য বেশ কিছু পুকুর খনন করা হবে। সেজন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মাটি অপসারণ করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মো. মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পার্ক লাগোয়া টিলা ও সমতল শ্রেণীর জমি থেকে গভীর গর্ত করে মাটি অপসারণ করায় হুমকির মুখে রয়েছে পার্কের সীমানা দেয়াল। আগামী বর্ষা মৌসুমে এর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা তার। বিষয়টি ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম বলেন, ডুলাহাজারা বনবিটের রংমহল এলাকায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলের টিলা শ্রেণীর পাহাড় রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা জোরদার করা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ স্বল্পসংখ্যক জনবল নিয়ে বনবিভাগ একা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না।
রংমহল এলাকায় টিলা শ্রেণীর পাহাড় কাটা এবং সমতল জমির মাটি কেটে মৎস্য চাষের জন্য পুকুর খনন করার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর অনুমতি দেয়ার বিষয়টি সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা। তিনি আজাদীকে বলেন, এ ধরনের কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি হোক বা সরকারি বনভূমি বা ছড়া হোক, যেখানে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড চললে জরুরি ভিত্তিতে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজ আজাদীকে বলেন, মাসখানেক আগে আমি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছি। তখন মাটি পরিবহনে নিয়োজিত দুটি গাড়িও জব্দ করেছি। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতে মোটা অংকের জরিমানা করে গাড়িগুলো ছাড়া হয়। এ সময় নির্দেশনা দেওয়া হয় পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড না চালাতে। কিন্তু এখন শুনছি ফের ওখানে ধ্বংসযজ্ঞে মেতেছে চক্রটি। এসি ল্যান্ডকে নির্দেশ দিয়েছি সেখানে গিয়ে বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা করতে। পরিবেশ অধিদপ্তরকেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশে-বিদেশে অপপ্রচারের চেষ্টা চলছে : প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬