জীবনের অন্তিম বেলার অফুরন্ত অবসরের দিনযাপনের এ সময়ে ফেলে আসা দিনের সুখ–দুঃখের অনেক ঘটনা মাঝে মাঝেই মনের পর্দায় ঝিলিক দিয়ে উঠে। আমার স্মৃতির দর্পণে ভেসে উঠে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার (সাবেক পশ্চিম পটিয়া) দেয়াং পাহাড়ের পাদদেশে প্রকৃতির নিজ হাতে গড়া আমার প্রিয় গ্রাম দৌলতপুর। স্মৃতি জাগানিয়া শৈশব কৈশোরের ছায়া সুনিবিড় খাল–বিল–নদী ঘেরা আমার গ্রামের অনেক দৃশ্য–ঘটনা আমাকে স্মৃতি কাতরতায় আক্রান্ত করে। আমার মনে পড়ে গ্রীষ্মের এবং বার্ষিক পরীক্ষার পরে দীর্ঘ স্কুল ছুটিতে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পানে করে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিয়ে দৌলতপুরে বেড়াতে যাওয়া এবং ছুটি শেষে একই পথে ফিরে আসা। গ্রামের বাড়িতে পৌঁছুলে আমার বৃদ্ধা দাদীর আবেগঘন খুশির সম্ভাষণ, আবার ছুটি শেষে বিদায় নেওয়ার প্রাক্কালে অন্তর হু হু করে উঠা দাদীর ভেজা দু’চোখ এবং বেদনাবিধুর মুখের ছবি আমি এখনও দেখতে পাই। দেয়াং পাহাড়ের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ডাহুক–ডাহুকী আর কোকিলের কুহুতান, দিন শেষে পাখিদের নীড়ে ফেরা, জোনাকি রাতের অপরূপ দৃশ্য, পাখ–পাখালির বিচিত্র মধুর কলরব, শীতের সকালের কাঁচা খেজুর রস, ভাপা পিঠা, পুকুরে মাছ ধরা, ডাঙ্গুলি আর হাডুডু খেলা, রাখালের গরু চরানো আর রাতে ঘুমানোর আগে দাদির কাছে কিস্্সা শোনা–এ সবই এখনো আমাকে আবেগে আপ্লুত করে। তখনকার দৌলতপুরের প্রাণ সজীব করা অঙিজেন সমৃদ্ধ বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য আমার মন এখনও ব্যাকুল হয়ে উঠে। শহর থেকে সাম্পানে চড়ে আমার গ্রামে আসা–যাওয়ার পথের প্রাকৃতিক দৃশ্য আর কর্ণফুলী নদীতে চলাচলকারী নৌযানের তলদেশে লাগানো আলকাতরার গন্ধ এখনো আমি আমার শ্বাস–প্রশ্বাসে অনুভব করতে পারি। আমার অনুভূতিতে স্থায়ী হয়ে গেছে আলকাতরার এই সুবাস। আমার গ্রামের সেই মাঠঘাট, জমির আল, ধান কাটার পর শীতের শিশির ভেজা শূন্য ধানী জমি, সাপ্তাহিক হাটের চা দোকানের কয়লা পোড়ানোর গন্ধ, সেইসব দিনের সেই পরিচিত পরিবেশ আর হারিয়ে যাওয়া সব বন্ধু–সুহৃদদের জন্য এখনও মনটা আবেগে কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠে। আমি তখন ভীষণভাবে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ি। এসব স্মৃতি আমাকে নিয়ে যায় ফেলো আসা নানা বিচিত্র ঘটনায় ঠাসা সেসব দিনে।
আমার শৈশব কৈশোরের চেনা সেই গ্রাম দৌলতপুরের ছায়া–সুনিবিড় সেই রূপ, সেই সবুজ শ্যামল মায়া মাখানো অবয়ব আজ আর নেই। ‘ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় দারুন মর্ম ব্যথা’ নিয়ে দৌলতপুর আজ সেই মায়াবী রূপ হারিয়ে ফেলেছে। আমাদের প্রজন্মের মানুষ পরস্পরের প্রতি যেভাবে ভালোবাসা, সহমর্মিতা আর উদারতা দেখাতেন, আজকের বাসিন্দারা তা প্রদর্শনে অনেক হিসেবি আর কৃপণ। এখনকার জীবন বৈষয়িক দ্বন্ধে এবং ক্ষুদ্র স্বার্থে ভীষণ অনুদার এবং রাজনৈতিক কারণে দলাদলিতে লিপ্ত। মানবিকতা আজ অনেকটা নির্বাসিত। নুতন প্রজন্মের একাংশ মাদকে আসক্ত। এ প্রজন্মের কাছে প্রবীণেরা উপেক্ষিত। নম্রতা–ভদ্রতার পরিবর্তে অসৌজন্যতা ও উদ্ধতভঙ্গি প্রকাশের মাধ্যমে মেকী স্মার্টনেস প্রদর্শনে এ প্রজন্ম পারঙ্গম। এসব দেখে শুনে মনটা অব্যক্ত বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। মন চায় ফিরে যেতে ফেলে আসা সেসব দিনে। ‘মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে, স্মৃতি যেন আমারই হৃদয়ের বেদনার রঙে রঙে ছবি আঁকে।’