চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান প্রকৌশলী ফরিদ আহমদ। চট্টগ্রামের পটিয়ার আশিয়া গ্রামে ১ নভেম্বর ১৯৩২ সালে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবা গোলাম রসুল চৌধুরী। মা বিবিজান।
বনেদি মুসলিম পরিবারের বাবা মায়ের প্রথম সন্তান হিসেবে বাড়ির সামনের পাঠশালায় লেখাপড়ার হাতে খড়ি। পরবর্তীতে পিংগলার শেখের পাড়ায় নুর আহমদ মাষ্টার স্থাপিত ও পরিচালিত প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক পাঠ শুরু। ১৯৩৯ হতে আশিয়া নিজামুদ্দিন ফ্রি বোর্ড প্রাইমারি স্কুলে ৩য়-৪র্থ শ্রেণী বোর্ড এর পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাস করেন। ১৯৪২ পঞ্চম শ্রেণী হতে কর্ত্তালা বেলখাইন মোহাবোধী হাই স্কুল হতে ভর্তি হন। এ স্কুল হতে ১৯৪৮ সালে বিজ্ঞান বিভাগ হতে কৃতিত্বের সাথে ২য় বিভাগে মেট্রিক পাস করেন। আশিয়া গ্রাম হতে ২২ মাইল দূরে গহীন গ্রামের ভিতর হাঁটা পায়ে যাতায়াত করে এলাকার একমাত্র কলেজ কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজ হতে ১৯৫০ সালে বিজ্ঞান বিভাগে মেধা তালিকায় ২২ তম স্থান নিয়ে এইচ এস সি পাস করেন এবং চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হন। ১৯৫০-৫১ এর জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে সরকারি বৃত্তি ও মুসলিম এডুকেশন সোসাইটির বৃত্তি লাভ করেন।
বিএসসিতে পড়াকালীন ১৯৫১ এর ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়ে ট্রেনিং এর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে সিমান্ত প্রদেশের কোহাট শহরে ও করাচির ড্রিপ রোডে ট্রেনিং শেষ করেন।
প্রশিক্ষণ শেষে করাচিস্থ এয়ার ফোর্স টেকনিক্যাল ট্রেনিং স্কুলে এ্যারো ইঞ্জিন মেকানিক কোর্স চলাকালিন চাকরি হতে ডিসচার্জ এর জন্য আবেদন করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাঁর আবেদন অনুমোদন না করে ক্লার্ক এর ট্রেনিং এর জন্য কোহাট পাঠিয়ে দেন। চাকরি চলাকালীন ৩ বছর মেয়াদি আমেরিকার বিখ্যাত হলিউড রেডিও এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউন্স (এইচ আর টি আই) এর করেসপন্ডেস কোর্সে ডিপ্লোমা পাস করেন। ১৯৫৭ তে চাকরি হতে অবসর নেয়ার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান বাহিনীর রিক্রুটিং অফিস চট্টগ্রামে বদলী হয়ে আসেন এবং রিক্রুটিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রামের স্টেশন কমণ্ডার তাঁকে অবসরে দেয়ার পরিবর্তে আরো তিন বছর চাকরি করান এবং সার্জেন্ট হিসেবে পদোন্নতি দেবার প্রস্তাব করেন। ফরিদ প্রস্তাবে রাজি না হয়ে পাকিস্তান এয়ারফোর্স হতে ১৯৬০ এর এপ্রিল মাসে অবসর নেন। ইতিমধ্যে ১৯৫৮ এর ০৭ নভেম্বর তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর জাকির হোসেনের বোনের মেয়ে রাঙ্গুনিয়া নিবাসি আহামদুর রহমানের ৪র্থ কন্যা আয়েশা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
পাকিস্তান এয়ারফোর্স হতে অবসর নিয়ে জীবন জীবিকার তাগিদে চট্টগ্রামের ‘মারফি রেডিও এ্যাসেম্বলি” কারখানায় যোগ দেন। একই বছর নভেম্বরে “মর্ণিং নিউজ” ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় চট্টগ্রাম অফিসে সাংবাদিকতার কাজ শুরু করেন। ১৯৬১ এর সেপ্টেম্বর মাসে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় ব্রিটিশ কোম্পানী “স্পেনসার কোং” এর ট্রাভেলিং সেলস্ রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে কাজে যোগ দেন।
১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম বন্দর সংস্থার বন্দর ও জাহাজ চলাচল বিভাগে রেডিও, টেলিফোন মেকানিক (আর.টি. মেকানিক) হিসাবে কাজে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে তাঁর জন্য লাইটিং অফিসারের পদ সৃষ্টি করেন। সে পদে তাঁকে পদায়ন করা হয়। এ পদে থাকা অবস্থায় বন্দরের ম্যারিনটাইম নেভিগেশন লাইট হাউজ তদারক ও রক্ষণাবেক্ষণ ও বয়া বাতি স্থাপনের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেন। সে সময়কালে বিদেশ হতে এসব যন্ত্রপাতি আমদানী করে স্থাপন করা হতো এবং কোটি কোটি টাকা বিদেশী মুদ্রা ব্যয় করা হতো। তিনি এসব যন্ত্রপাতির ৭০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে তৈরীর ব্যবস্থা করে বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করেন। কিন্তু এতে পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মকর্তারা তাঁর উপর কিছুটা অসুন্তুষ্ট হন। কিন্তু তিনি তাঁর বিভাগীয় প্রধান ক্যাপ্টেন ছৈয়দ সাহেবের আনুগত্য লাভ করেন এবং তাঁর অনুপ্রেরণায় বন্দরে নাইট নেভিগেশন ব্যবস্থা চালু করে রাত্রিকালীন সময়ে বন্দরে জাহাজ চলাচলের উপযোগী করে চট্টগ্রাম বন্দরকে জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে সক্ষমতা বৃদ্ধি করে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেন।
সরকারি চাকরি করলেও ফরিদ আহমদ একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ। জননেতা মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানির একনিষ্ঠ অনুসারী হয়ে তিনি কাজ করেছেন। মৌলানা সাহেবের সাথে সম্পর্কের কারণে তাঁর দলের নেতা এবং সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হতো এবং আলাপ পরিচয় ছিল। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। ইতিহাসের ধারাবাহিকতার চট্টগ্রামের লালদিঘীর জনসভায় মজলুম জননেতা মৌলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে দিলেন। সে দিন হতে বাঙালি বুঝে নিয়েছে পাশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন খুব শীঘ্রই।
১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচনে তিনি সরাসরি কাজ করেছেন। সে সময়কালে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ঘনিষ্ঠ সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। কিন্তু সরকারি চাকরির বাধ্যবাধকতার কারণে সরাসরি রাজনীতির সাথে কোন সময়ই যুক্ত ছিলেন না। ১৯৭০ এর ডিসেম্বর হতে দেশের রাজনীতির ঘটনা প্রবাহ ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।
বন্দরের জাহাজ চলাচল বিভাগে ফরিদ আহমদ ছাড়া সকলে পাকিস্তানী। মার্চ মাসে তাঁরা সকলেই পাকিস্তান চলে যান। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা রাত হতে পাকিস্তান নেভির যুদ্ধ জাহাজ হতে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট লক্ষ্য করে প্রচুর গোলাগুলি শুরু করে। ক্যান্টনম্যান্ট থেকে শহরের দিকে পাঞ্জাবী সৈন্যবাহিনী ষোলশহর এলাকায় ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টর উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। ফরিদ আহমদের ছোট ভাই মাহবুব আহমদ তখন ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিল। ঐ যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। ফরিদ আহমদ ফিরিঙ্গিবাজারের অভয়মিত্র ঘাটের বন্দর স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার ওয্যারলেস ম্যাসেজটি তাঁর হাতে পৌঁছে। তিনি এয়ার ফোর্সের ট্রেনিং কাজে লাগিয়ে এয়ার ফোর্স স্টাইলে সিগন্যাল লিখে বিদেশী জাহাজ সমূহে এবং পারকি এলাকা দিয়ে বৃটিশ ও জাপানী পতাকাধারী বহিনোঙ্গরে দাঁড়ানো জাহাজগুলোতে পৌঁছে দেন। নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধের সকল কর্মকাণ্ড এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাঙালি নিধনের গণহত্যার খবর এবং মুক্তিযুদ্ধের সকল কর্মকাণ্ড বিদেশী জাহাজ সমূহে নিয়মিত পৌঁছিয়ে দিতেন যা পরের দিন বিবিসি ও ভারতীয় রেডিওর বাংলা খবরের বিশ্ব সংবাদে প্রচারিত হতো।
যুদ্ধকালীন হানাদারদের বন্দুকের মুখে মৃত্যুকে সামনে নিয়ে জাহাজ নিয়ে বন্দরের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। দায়িত্ব পালনকালে মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দুকের নিশানাতেও পড়তে হয়েছে তাঁকে। সরকারি কোয়ার্টার অভয়মিত্র ঘাটে দিনের বেলায় পাঞ্জাবী সেনাবাহিনীর পাহারায় থেকে রাতের গভীরে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়মিত সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। তাঁর বাসা থেকেই কবি আব্দুল সালাম ও আমজাদ হোসেনের সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম জনপ্রিয় স্লোগান “হায় হায় কি হলো, ঠিক্কা খান মরিল” তৈরী করে প্রচারিত হয়।
১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন। একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের বন্দর সচল এবং জাহাজ চলাচল উপযোগী করার জন্য ভারতীয় নৌবাহিনীর এ্যাডমিরাল শর্মাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এ্যাডমিরাল শর্মার নেতৃত্বে কর্ণফুলী নদীতে ডুবে যাওয়া এবং বোমার আঘাতে এবড়ো থেবরো হয়ে যাওয়া জাহাজগুলোকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
ইন্ডিয়ান নেভী পরিত্যক্ত জাহাজ এবং জেটি থেকে পাকিস্তানী সেনাদের পরিত্যক্ত অস্ত্রভান্ডার বোঝাই করে চলে যাওয়ার সময় বোমা ফেঁটে গিয়ে সমুদ্র খাঁড়ির ডান কিনারের বাইরে জাহাজ ডুবে যায়। তখন সন্দেহ হয় যে জাহাজ চলাচল খাঁড়িতে ডুবন্ত মাইন রয়েছে। এ ডুবন্ত মাইন মুক্ত করে বন্দরকে জাহাজ চলাচলে নিরাপদ করা জরুরী হয়ে পড়ে। কিন্তু এ কাজ করার জন্য যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন ছিল। এ কাজের জন্য ইন্ডিয়ান নেভির মাইন সুইপিং জাহাজ বোম্বে হতে বাংলাদেশে এনে তা দিয়ে কাজ শুরু করা ছিল দুরহ এবং সময় সাপেক্ষ। কিন্তু দেশে ইতিমধ্যে জ্বালানি তেলের সঙ্কট দেখা দেয়, ফলে তেলের টেঙ্কার চট্টগ্রাম রিফাইনারীতে আনা জরুরী হয়ে পড়ে। ফরিদ আহমদ সাহেবের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এবং নির্দেশনায় এ্যাডমিরাল শর্মার নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান নেভীর ক্যাপ্টেন জগজিৎ সিং এর সহযোগিতায় সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে আইর মাছের জাল দিয়ে স্থানীয় জেলেদের সহযোগিতায় এবং ফিরিঙ্গিবাজারের শফি মেটাল ওয়ার্কসের নির্মিত ছোট ছোট নোঙ্গর দিয়ে মাত্র ২০/২২ দিনের মধ্যে কোন বড় ধরনের দুর্ঘটনা ছাড়া মাইন সুইপিং এর কাজ শেষ করেন এবং ইন্ডিয়ান জ্বালানি তেলবাহি টেঙ্কার ‘দেশদীপ’কে বাংলাদেশের ক্যাপ্টেন মাহবুব কঙবাজার বরাবর সমুদ্র হতে ১৯৭২ এর ফেব্রুয়ারি মাসে নিরাপদে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসেন। এতে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ বড় ধরণের জ্বালানী সংকট হতে রক্ষা পায়।
১৯৭২ এর শেষের দিকে রাশিয়ান নেভীর সেলভেজ টিম এর সাথে সেলভেজ কো-অর্ডিনেটর হিসাবে কাজ করেন ফরিদ আহমদ। সে সময়ে চট্টগ্রাম হতে কঙবাজার বরাবর সমুদ্র খাঁড়িতে লুকায়িত মাইন হাইডেন মাইন ডিক্টেশন এবং সেলভেজ অপারেশন কাজে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এ বিষয়ে তৎকালীন বন্দর চেয়ারম্যান হোসেন কিবরিয়ার ভূমিকা প্রশংসনীয়।
১৯৭৩ এর মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ অনুমোদনে সুইডেন স্টক হোমের ‘এজিএ’ এবং লন্ডনের ‘ট্রেনিং হাউস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ এর ট্রেনিং এর জন্য পাঠানো হয়। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সে সময়ে বিদেশী ট্রেনিং বন্ধ ছিল। কিন্তু ফরিদ আহমদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক তাঁকে বিশেষ অনুমোদন দেয়া হয়।
১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য একটি আধুনিক বয়া বসানোর জাহাজ এবং একটি টাগবোট ক্রয়ের ব্যবস্থা নেয়া হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের পক্ষে তা গ্রহণের জন্য বিশেষ অভিজ্ঞ কর্মকর্তা হিসেবে কোপেনহেগেন এবং হলেন্ডের রটারডমে বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে ফরিদ আহমদকে পাঠানো হয়।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য ফরিদ আহমদের অবদান অনস্বীকার্য্য সে সময়ে তিনি বাংলা বাজারের পেছনে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে ‘আমিজি ভালিজি ভারনিমান’ নামক কোম্পানীর ছোট একটি ড্রাইডক নৌবাহিনীর জন্য অধিগ্রহণ করেন। বহিঃ সমুদ্র হতে ভেসে যাওয়া বার্জ ধরে নিয়ে এসে নৌবাহিনীকে হস্তান্তর করেন। এ বার্জটি পরবর্তীতে নৌবাহিনী পুনঃবাসন কাজে সহায়ক হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলদেশ নৌবাহিনীর জন্য আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত প্রথম ফ্রিগেট জাহাজ ওমর ফারুক ক্রয় করেন। সে সময় ফ্রিগেটের জন্য কোন জেটি ছিলনা। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অনুরোধে ফ্রিগেট জাহাজ ওমর ফারুক এর জন্য একটি আধুনিক জেটি নির্মাণ করেন ফরিদ আহমদ। এ জেটিতে বন্দরের হারবার মাষ্টার মোয়াজ্জেম হোসাইন এর পাইলটিং ফ্রিগেট ওমর ফারুককে বন্দরে নিয়ে আসেন এবং নৌবাহিনীর প্রধান এ্যাডমিরাল মোশারফ হোসেন সাথে ফরিদ আহমদ নবনির্মিত জেটির উপর দাঁড়িয়ে ফ্রিগেট ওমর ফারুককে অভ্যর্থনা জানান।
নৌবাহিনীর পুনঃ নির্মাণে আরও অনেক উন্নয়নমূলক কাজ ফরিদ আহমদ কর্তৃক সম্পাদন করা হয়। এছাড়াও স্বাধীনতা পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ আধুনিকি করণের কাজে তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরিকালীন তাঁর কাজের প্রশংসা স্বরূপ ১৯৭৮-৭৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকরণ এবং জাহাজ চলাচলের দক্ষতা বিবেচনায় পুরস্কার স্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘প্রেসিডেন্ট মেডেল ও এক হাজার টাকা’ নগদ প্রদান করে ফরিদ আহমদকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করা হয়।
১৯৮০ সালে জাপানের “ইন্টারন্যাশনাল এসোশিয়েশন অব পোর্টস এ্যান্ড হারবারস (আইএপিএইচ)” “কার্গো মুভমেন্টস ইন দি ইন্টারন্যাশনাল পোর্ট অব চিটাগাং” উপর আন্তর্জাতিক রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় পুরস্কার, সার্টিফিকেট ও ৩৫০ ডলার নগদ দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ফরিদ আহমদকে সম্মানীত করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও সুযোগসন্ধানিদের ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি বন্দরের চাকরি ত্যাগ করে সিঙ্গাপুরস্থ “রেড সি মেরিটাইম” নামক কোম্পানীতে চাকরি নিয়ে সৌদি আরবের ইয়ানবুতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কাজে যোগদেন। সেখানে প্রায় ৪/৫ বছর সুনামের সাথে চাকরি করেন।
১৯৮৫ এর ফেব্রুয়ারিতে দেশমাতৃকার টানে এবং পারিবারিক প্রয়োজনে দেশে ফেরত আসেন এবং “মেরিনার্স বাংলাদেশ” নামক একটি শিপিং কোম্পানীতে কাজে যোগ দেন। সে সময়ে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে চট্টগ্রাম সিইউএফএল স্থাপনে প্রাথমিক প্রস্তাবনা, পরিকল্পনা এবং সম্ভাব্য যাচাইয়ের জন্য বিশেষ পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন।
১৯৯২ এর জুলাই মাসে স্ত্রী আয়েশা বেগম রুনু ও বড় মেয়ে আতিয়া বেগম রোজি সহ ছেলে আসিফ আহমদের আহ্বানে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আমেরিকার ডালাসে চলে যান। ২০১৩ এর ২৩ সেপ্টেম্বর স্ত্রী আয়েশা বেগম রুনু আমেরিকায় পরলোক গমন করেন।
ফরিদ আহমদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশপ্রেমিক এবং বহু প্রতিভার অধিকারী হয়েও কোন দিন কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পিছনে ছুটেননি। সৎ ও কর্মদক্ষতায় তিনি আজীবন অনাড়ম্বর জীবন যাপন করে গেছেন। সৎ থেকে মানুষ হিসেবে কিভাবে সুন্দর ও সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করা যায় তার জীবন্ত উদাহরণ ফরিদ আহমদ। তিনি আমার, আমার পরিবারের কাছে একজন আদর্শবান ব্যক্তিত্ব। ২২ নভেম্বর ২০২০ আমেরিকার সময় সকাল ৮.০৫ মিনিট এবং বাংলাদেশ সময় রাত ১০.০৫ মিনিট সময় আমেরিকা ক্যালিফোর্নিয়ার আরবাইন সিটিতে নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বর্তমান নৈতিকতা বিবর্জিত সমাজ ব্যবস্থায় এবং সম্মান ও অর্থের পিছনে ছুটে চলা মানুষগুলোর জন্য ফরিদ আহমদ একজন ন্যায় নীতিবান আদর্শ মহাপুরুষ। আমরা তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। তিনি আমাদের মাঝে তাঁর আদর্শের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক : শিল্পশৈলী