মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের গর্ব ও অহংকারের শেষ নেই। মুক্তিযুদ্ধ ছিল দেশের আপামর জনগণের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ শুধু পুরুষরাই করেনি, করেছে
নারীরাও। কেউ অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছে, কেউ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা–শুশ্রূষা করে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, ভরসা দিয়েছেন, মনোবল জুগিয়েছেন, কেউ বর্হিবিশ্বে স্বাধীনতার সপক্ষে বিশ্বমত গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত থেকেছেন।
বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, অস্ত্র এগিয়ে দেওয়া অথবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও চিকিৎসা করা, তাদের জন্য ওষুধ, খাবার ও কাপড় সংগ্রহ করা এসব সক্রিয় কর্মকাণ্ডই ছিল তাদের মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই ছিল জনযুদ্ধ। নারী–পুরুষ নির্বিশেষে এই যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন সমানভাবে। নারীরা অত্যাচারিত বা ধর্ষিত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে, এটা যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি স্থান পেয়েছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নারীর লড়াই। যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন এমন নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি হিসেবে বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন তিন নারী। তারা হলেন, ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি।
পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশনের দৌলতে আমরা কিছু নারীমুক্তিযোদ্ধাদের কথা জানতে পেরেছি স্বাধীনতার অনেক বছর পর।
এমন আরও কত নারী মুক্তিযোদ্ধা দেশের আনাচে–কানাচে রয়ে গেছেন, যাদের কথা আমরা এখনো জানতে পারিনি।
মুক্তিযুদ্ধের সাহসী ৩ নারী বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন। তবে বীরপ্রতীক সিতারা বেগম, তারামন বিবির ব্যাপারে সবাই জানলেও এক প্রকার আড়ালে রয়ে গেছেন কাঁকন বিবি।
আজ বীরপ্রতীক কাঁকন বিবিকে নিয়ে লিখছি।
কাঁকন বিবি
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের এক বীরযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর বিপক্ষে মুক্তিবাহিনীর হয়ে ৫ নম্বর সেক্টরে গুপ্তচরের কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে এ–বিষয়ে সরকারিভাবে কোনো গেজেট প্রকাশিত হয়নি।
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার ঝিরাগাঁও গ্রামে তাঁর বাড়ি। কাঁকন বিবির আসল নাম কাঁকাত হেনিনচিতা। মুক্তিবেটি নামে পরিচিত এই নারী খাসিয়া সমপ্রদায়ের এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মূল বাড়ি ছিল ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশের এক গ্রামে। ১৯৭০ সালে দিরাই উপজেলার শহীদ আলীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাঁর নাম হয় নূরজাহান বেগম।
১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ তিনি এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। কন্যাসন্তান জন্ম দেবার ফলে স্বামীর সঙ্গে তার মনোমালিন্য দেখা দেয় এবং একপর্যায়ে তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়। পরে ইপিআর সৈনিক মজিদ খানের সঙ্গে বিয়ে হয়। মজিদ তখন কর্মসূত্রে সিলেট ইপিআর ক্যাম্পে থাকতেন। দুই মাস পর মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসার পর স্বামীকে না পেয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তাঁর স্বামী বদলি হয়ে দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকার কোনো এক ক্যাম্পে আছেন।
স্বামীকে খুঁজতে বের হন তিনি। ১৯৭১ সালের জুন মাস তখন। পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন, তাদের বাংকারে দিনের পর দিন অমানুষিক নির্যাতন করে তাকে ছেড়ে দেয় তারা। এরপরই কাঁকন বিবি স্বামীকে পাওয়ার আশা ত্যাগ করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। জুলাই মাসে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি পরিচয় করিয়ে দেন সেক্টর কমান্ডারের সাথে।
কাঁকন বিবির ওপর দায়িত্ব পড়ে গুপ্তচর হিসেবে বিভিন্ন তথ্য জোগাড় করার। সাহসিকতার সঙ্গে বিভিন্ন রূপে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন। তার সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সফল আক্রমণ চালান।
গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়েই দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আবার ধরা পড়েন তিনি। এবারে একনাগাড়ে সাত দিন তাঁকে ॥বিবস্ত্র করে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। লোহার রড গরম করে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছেঁকা দেওয়া হয়। মৃত ভেবে অজ্ঞান অবস্থায় কাঁকন বিবিকে ফেলে রেখে যায়। কয়েক দিন পর জ্ঞান ফিরে এলে তাঁকে উদ্ধার করে বালাট সাবসেক্টরে নিয়ে আসা হয়। সুস্থ হয়ে তিনি আবার ফিরে আসেন বাংলাবাজারে। অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর কাছে। পরে তিনি সম্মুখযুদ্ধ আর গুপ্তচর উভয় কাজই শুরু করেন। এরপর প্রায় ২০টি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে টেংরাটিলায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। এই যুদ্ধে তাঁর দেহে কয়েকটি গুলি লাগে।
দেশ স্বাধীন হলে কাঁকন বিবি দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে এক ব্যক্তির কুঁঁড়েঘরের বারান্দায় মেয়ে সখিনাসহ আশ্রয় নেন। এর পরের প্রায় দুই যুগ তিনি ছিলেন সবার চোখের অন্তরালে। ১৯৯৬ সালে স্থানীয় এক সাংবাদিক বিষয়টি সবার নজরে নিয়ে এলেন।
দেশব্যাপী এই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাঁকে জমি উপহার দেন। পরে তাঁকে একটি ছোট কুঁঁড়েঘর নির্মাণ করে দেন বদরউদ্দিন কামরান।
২০১৮ সালের ২১ মার্চ ১০৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
‘হয়ত বা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না
বড় বড় লোকেদের ভিড়ে
জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে
তোমাদের কথা কেউ কবে না
তবু হে বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা,
তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবে না
না না না শোধ হবে না’
এই গান তো এমন বিস্মৃত মুক্তিসেনানিদের জন্যই লেখা হয়েছিল।