মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন

নাসের রহমান | সোমবার , ২৪ মার্চ, ২০২৫ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ জাতি স্বাধীনতা লাভ করেছে। স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সুদূর অতীত নয়যা কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে পারে। ইতিহাস কেউ কেউ বিকৃত করলেও সঠিক ইতিহাস অনেকের জানা। ইতিহাসের সত্যকে আড়াল করা যায় না। অস্বীকার করারও কোনো সুযোগ নেই। কেউ অস্বীকার করলে ইতিহাসের কিছু যায় আসে না। ইতিহাস ইতিহাসই থাকে। ইতিহাস সর্বদা নির্মোহ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। এসব বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনার উল্লেখ আছে। যে কোনো বিষয়ে সঠিক তথ্য জানার জন্য বই একটি নির্ভরশীল মাধ্যম। বই থেকে অনেক কিছু জানা যায়। আবার কোনো কোনো বই বিভ্রান্তিও ছড়ায়। তবে প্রকৃত তথ্য সমৃদ্ধ বইয়ের অভাব নেই। যাচাই করে দেখতে হয়।

বাঙালির প্রথম অর্জন ভাষা আন্দোলন। বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের হলেও ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি আত্মপরিচয়ে বলিয়ান হয়। ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে স্বাধীকার আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। বাঙালি আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা ভাবতে পারে। এর প্রভাব পড়ে ছাপ্পান্নের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে। পাকিস্তানের বলয়ে থেকে পূর্ব বাংলায় মানুষেরা স্বতন্ত্রতার বহি:প্রকাশ ঘটায়। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বেশি দিন টিকতে দেয়নি। পাকিস্তান সামরিক শাসনের কবলে চলে যায়। পূর্ব বাংলার মানুষ কখনো সামরিক শাসন মেনে নেয় নি। প্রতিবাদ ও আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরশাসকের বিদায় হয়। সত্তরের নির্বাচনে বাঙালিরা অর্থাৎ আওয়ামীলীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার নির্বাচিত প্রতিনিধির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানা রকম টালবাহানা শুরু করে। এতে পূর্ব বাংলার জনগণ আবার রাজপথে নেমে আসে। আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথ উত্তপ্ত করে তোলে। শহরে বন্দরে গ্রামে গঞ্জে মানুষ মিছিলে মিছিলে প্রতিবাদ শুরু করে। সরকার মিছিলে গুলি চালায়। ছাত্র হত্যা করে, শ্রমিক হত্যা করে। বাংলার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ওপারেশন সার্চ লাইট নামে ঢাকায় বর্বর গণহত্যা চালায়। হাজার হাজার নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। বাঙালিদের আর কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না। পূর্ব বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ই ডিসেম্বর পাকহানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে বিশ্বে মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ স্থান করে নেয়।

গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধকে কেউ ম্লান করতে পারবে না। এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে অস্বীকার করা মানে স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যাদের পুরাপুরি বিশ্বাস নেই তারাই মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে চেষ্টা করতে পারে। কারণ মুক্তিযুদ্ধ কোনো বিশেষ শ্রেণি পেশার মানুষের যুদ্ধ নয়। এটি একটি জনযুদ্ধ যেখানে সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেছে। কতিপয় স্বাধীনতা বিরোধী ছাড়া পূর্ব বাংলার আপামর জনসাধারণ এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। হঠাৎ করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরে মানুষ মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ শোষণবঞ্চনা, নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যুদ্ধ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতিরোধের যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ এদেশের মানুষের স্বাধীনতার যুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধে যারা বিরোধিতা করেছে, যারা স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল, তারা বাংলাদেশের বিজয়কে মেনে নিতে পারেনি। তাদের সংখ্যা কম হলেও পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলতে পারেনি। যখনই সুযোগ পেয়েছে মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে কটুক্তি করতেও দ্বিধা করেনি। যখন কোনো বড় আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে তখনই তাদের হীনমানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে। বিভিন্ন রকম অসত্য তথ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। জুলাই আগস্টের ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পরেও মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি তাদের অপচেষ্টায় তৎপর রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, সংবিধান, জাতীয় পতাকা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের কাছে নানা রকম বিভ্রান্তিমূলক তথ্য উপাত্ত দিয়ে মীমাংসিত বিষয়গুলোকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে।

সংস্কার সবাই চায়। সংস্কার এখন সময়ের দাবি। মানুষের প্রয়োজনে সংস্কার করতে হয়। অন্যান্য বিষয়ের মতো সংবিধানও সংস্কার হবে। যে কোনো কিছুকে সময়োপযোগী করতে হলে সংস্কারের প্রয়োজন হয়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সংবিধান জাতি পেয়েছে তাতেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের স্বার্থে সংবিধানে নানা ধরনের পরিমার্জন করেছে। সংবিধানের যেসব অনুচ্ছেদে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে না তা বাদ দিতে হবে। প্রয়োজনে সংযোজন বিয়োজন করা হবে। অর্থাৎ সংস্কার কমিশন এ ব্যাপারে তাদের প্রস্তাবনা বা সুপারিশমালা তুলে ধরবে। জনগণের মনঃপূত হলে তা গৃহীত হবে। কিন্তু সংবিধান নিয়ে অহেতুক বিতর্কে জড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে জুলাই আগস্টের ছাত্রজনতার অভ্যূত্থানের যে জনআকাঙ্ক্ষা তৈরী হয়েছে তার কোনো বিরোধ নেই। একাত্তরে পূর্ব বাংলার মানুষ শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। ছব্বিশেও ছাত্ররা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে যে আত্মত্যাগ স্বীকার করেছে উভয়ের লক্ষ্য একই। মানুষের অধিকার রক্ষা করা। মৌলিক অধিকারে নিশ্চিত করা। সাম্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করা। এসব তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে এসব কথাইতো উল্লেখ আছে। এসবের বাস্তবায়ন হয়নি বলে মানুষ আন্দোলন করে। ছাত্রজনতা রক্ত দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটায়। স্বৈরাচারের পতন হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যা একাত্তরে তা চব্বিশেও একইরকম সমুজ্জ্বল। মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা বাংলাদেশ একই সূত্রে গাঁথা। এসব কিছু এদেশের মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে চব্বিশের ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান। এ ঐতিহাসিক সত্যকে ধারণ করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তাহলে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে স্বপ্ন তা বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ভাতা বৃদ্ধির প্রস্তাব ইতিবাচক
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে