মুক্তিযুদ্ধ ও বর্তমান বাংলাদেশ

ড. উজ্জ্বল কুমার দেব | সোমবার , ১১ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ

আমরা আমাদের দেশে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। ১৯৭১-এ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করে। বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আমরা যদি দেশ না পেতাম, যদি স্বাধীনতা না আসতো, আজকের এই উৎসব আমরা করতে পারতাম না। দেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। বাস্তবায়িত হচ্ছে বড় বড় রূপকল্প। আজ আমাদের দেশ শতভাগ বিদ্যুতায়নের পথে। বিশ্বব্যাংক বলছে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশ। গত ৫০ বছর আমরা কি এমন করলাম যে পুরো বিশ্ব আমাদের সমীহ করছে। কথায় কথায় আমরা বলি সামাজিক উন্নয়নের সব সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে আমরা এগিয়ে আছি। আজ আমরা বোঝার চেষ্টা করব ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে পাকিস্তান থেকে আমরা আলাদা বাংলাদেশ গঠন করেছিলাম, সেই মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের বর্তমান প্রজন্ম কী ভাবছে? এই পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে কিভাবে দেখছে?
কয়েকদিন আগে বিবিসি বাংলায় পাকিস্তানের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি ও বিশিষ্টজনেরা বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়ন এবং তার সাথে পাকিস্তানের বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে বেশকিছু তুলনামূলক কথাবার্তা বলেছিলেন। তরুণ প্রজন্মের মতামতে উঠে আসে এতদিন ধরে যে ইতিহাস তাদেরকে শেখানো হয়েছিল তাতে পাকিস্তানের ব্যর্থতাকে আড়াল করে রাখা হয়েছে। তাদেরকে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে বোঝানো হয়েছিল ভারতের চক্রান্তের শিকারে পাকিস্তান দু’ভাগে ভাগ হয়। বাংলাদেশের তখন যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলেছিল ইতিহাসে তা পুরোপুরি চেপে যায়। বর্তমানেও সেই ভুল ইতিহাস শেখানোর চেষ্টা চলছে। তরুণদের মতে, সরকারিভাবেও সেই ভুলের কোনো বিশ্লেষণ দেয়া হচ্ছে না। দুঃখের ব্যাপার হলো, আমরা বর্তমান বাংলাদেশের কিছু কিছু তরুণ প্রজন্মের চিন্তাধারার মধ্যেও সেই ইতিহাস লক্ষ্য করি।
করাচির গবেষণা সংস্থা ইন্সটিটিউট অব হিস্টোরিকাল এবং সোশ্যাল রিসার্চের পরিচালক ড. সৈয়দ জাফর আহমেদ এর মতে, ১৯৭১ নিয়ে পাকিস্তানে সরকারি ব্যাখ্যা গত ৫০ বছরে তেমন বদলায়নি। পাকিস্তানের একটা অংশ আলাদা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তরুণ প্রজন্ম জানে ওটা ছিল একটা ট্রাজেডি। কিন্তু কেন এই ট্রাজেডি বা ব্যর্থতা তার সঠিক ব্যাখ্যা তারা এখনো জানে না। তরুণ প্রজন্ম বিশ্বাস করে এ ব্যর্থতার পেছনে ভারতের ইন্ধন ছিল এবং আওয়ামী লীগ ভারতের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় আড়াই দশক অধ্যাপনা করা রাজনীতি ও ইতিহাস বিভাগের প্রথিতযশা এ শিক্ষক আরও বলেন, ১৯৭১ এ ভারতের ভূমিকা অবশ্যই ছিল, কিন্তু প্রধান কারণ ছিল পাকিস্তানের একের পর এক সরকারের ব্যর্থতা যা দিনে দিনে বাঙালিদের মধ্যে বৈষম্য এবং বঞ্চনার মনোভাব শক্ত করেছে। বাঙালিরা ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। ১৯৪৭- এ দেশভাগের সময় বাংলা ছিল পাকিস্তানের একমাত্র অঞ্চল যেখানে মুসলিম লীগ ক্ষমতায় ছিল। অথচ দেশ সৃষ্টির পর ঐ অঞ্চলের মানুষ সমান প্রতিনিধিত্ব পায়নি। এর প্রধান কারণ ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা চলে গিয়েছিল আমলা এবং সেনাবাহিনীর হাতে। সেখানে গোষ্ঠী স্বার্থ ছিল প্রধান বিবেচনা। অভ্যন্তরীণ বিরোধ-অসন্তোষ মেটানোর রাজনৈতিক ‘সৃজনশীলতা’ পাকিস্তানের শাসকদের মধ্যে ছিল না বলেই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল। বিরোধ নিরসনে রাজনীতিক এবং সেনা নেতৃত্বের মধ্যে সৃজনশীলতার দারুণ অভাব ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেওয়া উচিৎ ছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া ও ভুট্টোরা তা মানেননি। ওটাই মূলত সর্বনাশা সিদ্ধান্ত ছিল। ১৯৭১ এ ভারতের যে ভূমিকা তা পাকিস্তানের সে সময়কার শাসকদের মুখরক্ষা করার অজুহাত দিয়েছে। তারা অন্তত মানুষকে একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। স্কুল-কলেজের বইপত্রে সেই ইতিহাস না থাকলেও, পাকিস্তান সরকার জানতে না দিলেও ডিজিটাল মিডিয়ার সূত্রে বর্তমান প্রজন্মের অনেক তরুণ যুবক সত্যিকারের ইতিহাস জানার চেষ্টা করছে।
ওই মতামত-বিশ্লেষণে আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম পাকিস্তানের একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আসাদ দুররানির মন্তব্য। যিনি পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থারও প্রধান ছিলেন। উনার মতে গত ৫০ বছরে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোনো স্বীকারোক্তি না এলেও পাকিস্তানের মানুষ ও বর্তমান প্রজন্ম এখন অনেকটাই বুঝতে পারছে কোথায় গলদ হয়েছিল। মানুষের মনে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভুল হয়েছিল। ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব মেনে না নিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো ভুল করেছিলেন। এখন সাধারণ মানুষের স্তরেও এই বোধ পৌঁছে গেছে। পাকিস্তানের সিনিয়র সাংবাদিক নাসিম জেহরার মতে, সাধারণ মানুষ হয়তো ১৯৭১ নিয়ে মাথা ঘামায় না, কিন্তু যারা দেশ এবং সমাজ নিয়ে চিন্তা করেন, কথা বলেন, লেখালেখি করেন তারা এখন জানেন পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবস্থাপনায় ভুল হয়েছিল। পাকিস্তান আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা যেহেতু দেশের পশ্চিমাংশে ঘাঁটি গাড়েন, শাসন ক্ষমতাও সেখানেই কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। সেই সাথে শুরু হয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশাসন, প্রতিরক্ষাসহ সমস্ত ক্ষেত্রে দেশের অন্য একটি অংশের নাগরিকদের প্রতি পদে পদে বৈষম্য। যেখানে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের দুই অংশে মাথাপিছু আয় ছিল সমান, ১৯৭১ সালে পশ্চিমের মানুষের আয় পূর্বের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ঐ ২৫ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগের অভাবে শত শত স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু পশ্চিমে বেড়ে গেছে তিন গুণ। তাই আমাদের নিজেদের ভুলের পরিণতি নিয়েও অনুশোচনা বা দুঃখবোধ এখনকার মানুষের হচ্ছে এবং যুবসমাজ সঠিক ইতিহাস জানার চেষ্টা করছে।
বর্তমান প্রজন্মের পাকিস্তানের একজন জনপ্রিয় ইউটিউবার সাঈদ মুজাম্মিল। সম্প্রতি গত ৫০ বছরে পাকিস্তান-বাংলাদেশের উন্নয়নের একটি তুলনামূলক ভিডিও চিত্র তৈরি করেছেন। এটি উর্দু ভাষায় তৈরি এবং ফেইসবুকে আমাদের স্বাধীনতার মাসে ভাইরাল হয়। শুরুতে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের একটি খবর তিনি উদ্ধৃতি করেন। সেখানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে উদ্দেশ্য করে লেখা ছিল, ‘ওয়াট ক্যান বাইডেন’স প্ল্যান ডু ফর পোভার্টি? লুক টু বাংলাদেশ’। তিনি বলেন, বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে কি এমন অর্জন করে ফেলল যে দারিদ্রতা রুখতে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকার শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন। শুরুতেই তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবার পিছনে নারীর ক্ষমতায়ন মূল ভূমিকা পালন করেছে। নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম জায়গা জাতীয় সংসদ। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার প্রায় ২১ ভাগ নারী। তথ্য চিত্রে দেওয়া তাঁর সুত্রমতে, শ্রমবাজারে অংশগ্রহণে বাংলাদেশের নারীরা ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছেন এবং পাকিস্তানের চেয়ে এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে বাংলাদেশ। এ দেশের শ্রমশক্তিতে ৩৬ শতাংশই নারী যা পাকিস্তানে ২২ শতাংশ। পাকিস্তানের কিছু মানুষ নারীদের সন্তান উৎপাদন ও রুটি সেকার যন্ত্র মনে করা হয়। স্বাস্থ্য খাতের দিকে নজর দিয়ে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য সূচকে বাংলাদেশ ভালো করেছে। নবজাতক ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বেশ সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা যেখানে ৮ সেখানে পাকিস্তানের সংখ্যা ৬। শিক্ষায় বাংলাদেশের নারীরা বেশ এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের ২৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই মাধ্যমিক পাস। অন্যদিকে পাকিস্তানে এই হার ২৭ শতাংশ। বাংলাদেশের ১ টাকা এখন পাকিস্তানের ১.৮৫ রুপির সমান। তাঁর মতে পাকিস্তান আগের জায়গায়ই বসে আছে আর বাংলাদেশ উপরের দিকে উঠছে।
১৯৭২ সালে মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের বলা তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে পঞ্চাশ বছরে অনেক অপমান ও তাচ্ছিল্য সহ্য করে, চরম বৈষম্য এবং দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে বাংলাদেশ আজকের বর্তমান অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। সামিল হয়েছে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। চরম শত্রুরাও আজকের বাংলাদেশকে দেখে বাহবা দিচ্ছে দেখে ভালো লাগছে। বাংলাদেশকে যেতে হবে আরো বহু দূর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে বাংলাদেশকে দেখতে চান। তবে একটিবার পেছনে ফিরে দেখলে, ৫১ বছর আগের অবস্থার সাথে তুলনা করলে, এগিয়ে যাবার উদ্যম অনেকগুণ বেড়ে যায়। পাকিস্তানি টিভি উপস্থাপক জয়গাম খান যখন বলেন ‘সুইডেন না, আল্লার ওয়াস্তে আমাদের আগে বাংলাদেশের মত বানিয়ে দিন’। তখন বুক গর্ভে ভরে যায়। আর কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসে তাদের প্রতি, যাদের প্রাণ, রক্ত এবং ত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ এ পেয়েছি অমূল্য স্বাধীনতা। সকল বীর শহীদের প্রতি আবারো জানাই হৃদয়ের গভীর হতে বিনম্র শ্রদ্ধা। বাংলাদেশ এগিয়ে যাক। জয় বাংলা।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ,
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভার্চুয়াল লাইব্রেরি : শিক্ষার ক্ষেত্রে বয়ে আনবে নবযুগের সূচনা
পরবর্তী নিবন্ধএক টাকায় ইফতার সামগ্রী