প্রিয় আব্বা, আপনাকে প্রায়ই মনে পড়ে। সময় নেই অসময় নেই। যখন তখন মনে পড়ে। কেন পড়ে কী জন্য পড়ে জানি না। একটা শূন্যস্থান সৃষ্টি হয়েছে বলে কি? বাবা নামের বিশাল এক শূন্যতা আমাদের মাঝে। যে শূন্যতা পূরণ হবার নয়। আপনাকে হারিয়ে বিশাল এক শূন্যতা আমাদের গোটা পরিবারে। তবুও ভিতটা এখনো মজবুত। আগেরই মতো। আপনার রেখে যাওয়া মজবুত ভিতটা অটুট আছে এখনো। আম্মা আছেন বলেই। আম্মা সুনিপুণ হাতে সব ঠিকঠাক রেখেছেন। আজকাল কেন জানি না শুধুই আম্মার সাথে থাকতে ইচ্ছে করে। সময় পেলেই আম্মার পাশে জড়িয়ে শুয়ে না হয় হাতে হাত জড়িয়ে বসে থাকি। আম্মা পুরোটা সময় আপনাকে নিয়ে স্মৃতিচারণে মশগুল থাকে। আমিও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাই এটা ওটা। আম্মা কতো সুন্দর করে বলে আপনাকে নিয়ে। আম্মার চোখমুখে তখন কী এক আশ্চর্য দ্যুতি খেলা করে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি আম্মাকে আর শুনি।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আমাদের পুরো জাতির জন্য কী অবর্ণনীয় দুর্যোগ নিয়ে এসেছিল। আম্মার কী হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা। প্রতিটি যুদ্ধ দিনের সকালের বিকালের রাতের। যেন এক একটি স্থির চিত্র। আমিও দেখলাম যেন আম্মার চোখ দিয়ে। আপনার বীরত্ব গাথা যুদ্ধ নিয়ে কতই না বীরোচিত। দস্যু মিলিটারিদের হাত থেকে পুরো গ্রামকে রক্ষা করার আপনার এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। আম্মার নাকি একটুও ভয় লাগেনি। একটুও বুক কাঁপেনি। আল্লাহর অশেষ রহমত আম্মার ভালোবাসা আপনার কোনও ক্ষতিই ওরা করতে পারেনি। আর আমাদের চিরসবুজ শৈলকোপা ও অক্ষত থাকলো হায়েনাদের রোষানল থেকে। আব্বা না থাকলে ভিন্ন চিত্র হতে পারতো তখন। চেয়ারম্যান চাচাদের গোয়াল ঘরের মতোই লেলিহান আগুনে জ্বালিয়ে দিত পুরো গ্রাম। অথচ রাস্তায় যাকেই পাচ্ছে গুলি চালিয়ে পাশে হালদার কিনারায় ফেলে রেখে যাচ্ছে তারা। পাশের বাড়ির নব বিবাহিত যুবক কিংবা ইজ্জত আলী দাদা অচেনা নাপিত কেউ রেহাই পাইনি। লাশ ভয়ে কবর দিতে পারেনি আপনজনেরা। ঘর থেকেই বের হওয়া দায়। সেখানে কিসের কী। শেয়ালে কুকুরে খেয়েছে মানুষের মরা দেহ। ছেলেরা দাড়ি গোঁফ কাটতে পারেনি। হাট বাজারে যাওয়া বন্ধ। আশ্বিন মাস ভাগ্যিস ঘরে ঘরে ধান চাল ছিল। আর আলু। ঐগুলোই তখন একমাত্র খাওয়ার সম্বল। দিনরাত একভাবে কাটিয়েছে। দরজা জানালা বন্ধ করে। বাড়ির এমাথা ওমাথা সামনে পিছনে থেকে থেকে সৈন্যরা টহল দিয়ে যায়। মেয়েরা বেশি অরক্ষিত তখন। আতঙ্কে দিন কাটতো আম্মার। সামনের দিকের ঘরের জানালা খোলা রেখে একদিন আম্মা নাকি নামাযে সালাম ফেরাতেই চোখ যায় বাইরে। দশাসই চেহারার পাকিস্তানি সৈন্য দাঁড়িয়ে। ভয়ে আম্মা চোখমুখ বন্ধ করে দেয় দৌড় ভেতর ঘরে। এরকম এক দুর্বিসহ জীবন তখন। আপনি ছিলেন আম্মার রক্ষাকবচ হয়ে। দুঃসময় শেষ হয়। আবার ঘুরে দাঁড়ায় পুরো জাতি।
আপনার প্রিয় জন্মস্থান শৈলকোপার মতো আরও একটা প্রিয় স্থান পেলেন। আপনার প্রিয় নাজিরহাট কলেজ। কলেজ ক্যাম্পাস তার আশপাশ এরিয়া নাজিরহাট বাজার এককথায় পুরো অঞ্চলটা আপনার ২য় হোম হিসাবে পরিগণিত হলো। অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ স্টাফ কর্মচারী তো ছিলোই। নাজিরহাটের বনেদী ব্যবসায়ীরা (ইয়াকুব সওদাগর) ও আব্বার পরম বন্ধু স্বজন। বিপদে আপদে পাশে থাকতেন একে অপরের। অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরির মৃত্যু আব্বাকে বড়োই বিমর্ষ করে দেয়। অমন অটল চরিত্রের মানুষটির আততায়ীর হাতে মৃত্যু তিনি মানতে পারেননি। সুখেদুঃখে এ মানুষটিও আব্বার সাথে জড়িয়ে ছিলেন। নাজিরহাট কলেজ ক্যাম্পাসের সামনের বিশাল দিঘি তার পিচঢালা কালো পথ তারপাশের ছোটছোট কটেজগুলোও আব্বার স্বৃতিবহ। এমনকি পুরনো লোহার সেতুটাও। ওদিক দিয়ে গেলে আব্বার গায়ের গন্ধ খুঁজি। ওখানের পথে পথে আপনার স্বৃতিচিহ্ন। পুরো নাজিরহাটটা আপনিময়।