১৯৭১ সনের ২১ শে নভেম্বর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম। ঐদিন সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও জওয়ানরা লাল সবুজের পতাকা জাতিকে উপহার দেবার স্বপ্নে বিদ্রোহ করার মাধ্যমে আপামর বাঙালি মুক্তিকামী জনগণ ও মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব নেয়। এই ইতিহাস সবারই জানা।
আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের ১ম গোলন্দাজ বাহিনীর নামকরণ, সাফল্য ও সর্বশেষে এইসব বিজয় ধারণ করে রাখা যাদুঘর যা চট্টগ্রামের হালিশহরের আর্টিলারি সেন্টার ও স্কুলে অবস্থিত, তা নিয়ে আলোকপাত করবো।
আমি এই সুন্দর শহর চট্টগ্রামে জন্মেছি। আমার সামরিক জীবনের গুরুত্ব গোলন্দাজ বাহিনী তথা ৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে। ২১ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসে এই মুজিব ব্যাটারী জাদুঘর উদ্বোধন করেন।
আমি গর্বিত ও আনন্দিত আরো একটি বিশেষ কারণে। এই জাদুঘর যা জনগণের জন্য উন্মুক্ত তা আন্তর্জাতিক মানের জাদুঘর হবে যা আপনারা পরিদর্শন না করলে ধারণাই করতে পারবেন না। বাংলাদেশে যে বৃটিশ মিউজিয়াম সমমানের জাদুঘর থাকতে পারে তা আজ বাস্তবতা। মাদাম তুসোর লাইভ মুরালের ন্যায় জাতির পিতার মুরাল আপনাকে বিস্মিত ও গর্বিত করবে তা আমি নিশ্চয়তা দিলাম। এই জাদুঘরে আপনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গোলন্দাজ বাহিনীর ব্যবহৃত সকল অস্ত্র, গোলাবারুদ, ও স্মৃতি পাবেন। ২/৩ ঘণ্টা সময় নিয়ে আসবেন বাংলাদেশের গৌরবের সাক্ষী হতে। পরিবার পরিজন বিশেষ করে আপনাদের সন্তানদের সাথে আনবেন। তারা জেনে গর্বিত হবে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে।
১৯৭১ এ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সেনাবাহিনী তথা পাকিস্তানী সশস্ত্রবাহিনীর বিপক্ষে অসম যুদ্ধে বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীর নেতৃত্বের অন্যতম ইতিহাস জাতির জানা উচিত। আমাদের অনেক না পাওয়া, দুর্নাম, অনিয়ম, দুর্নীতির মাঝে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন ও বিজয়ের গৌরব অনুপস্থিত।
চলুন ফিরে যাই ৭১ এ মুজিব ব্যাটারী ও জাদুঘর নিয়ে। গোলন্দাজ বাহিনীর কাজ কী? এই বাহিনী স্বল্প, মাঝারি ও দূর পাল্লার গোলা/শেল বা মিসাইল পদাতিক বাহিনীর পেছন হতে ফায়ার করে শত্রুর অবস্থানকে নড়বড়ে করে পদাতিক বাহিনীর বিজয় সুনিশ্চিত করে। শত্রুর শক্ত প্রতিরোধ যেমন মেশিনগান পোস্ট, বাংকার, শক্ত অবস্থান, কমান্ড পোস্ট, ট্যাংক এসব সম্মুখযুদ্ধে সক্রিয় থাকলে শত্রুকে পরাজিত করা ভীষণ কষ্টের/অসম্ভব।
১৯৭১ এর ২২ শে জুলাই বাংলাদেশের ১ম গোলান্দাজ ইউনিট ভারতের কোনাবান অঞ্চলে ৬ টি ৩.৭ ইঞ্চি হাউইটজার কামান দিয়ে যাত্রা শুরু করে। এই ইউনিটের নামকরণ করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে যা বর্তমানে ‘মুজিব রেজিমেন্ট আর্টিলারি’ নামে পরিচিত। মুজিব ব্যাটারী মুক্তিযুদ্ধে ২ নং সেক্টরে ‘কে’ ফোর্সের সাথে যুদ্ধে অংশ নেয়। ভারতীয় সরকারের জেনারেল সিং যিনি ১৯৭১ সালে ফেনী ও কক্সবাজার অঞ্চলে যুদ্ধ করেন, তিনি ২০১১ সালে জুন মাসে এই মুজিব ব্যাটারীর ২ টি কামান তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মুবীনকে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হস্তান্তর করেন, যা আপনারা যাদুঘরে এলে দেখতে পারবেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তা ও সমাজের গণ্যমান্য, ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে এই মুজিব ব্যাটারী যাদুঘর উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানটি এতোটাই আকর্ষণীয় ছিল যে উপস্থিত সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তা উপভোগ করেন।
একজন সাবেক আর্টিলারি অফিসার হিসেবে এটা আমার জন্য অত্যন্ত সম্মান ও গর্বের। আপনারা হয়তো জানেন যে, আর্টিলারি কোরের Motto হলো ‘সম্মান ও গৌরব’।
এই জাতীয় পর্যায়ের জাদুঘর নির্মাণের চিন্তা বাস্তবায়ন ও প্রতিটি স্টেজে পরিদর্শন ও তদারকি সামনে থেকে যিনি নেতৃত্ব দেন, তিনি হলেন কমান্ড্যান্ট, আর্টিলারি সেন্টার ও স্কুল বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এ এন এম মনজুরুল হক মজুমদার, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, জি, এমফিল। সৌভাগ্যবশত আমার প্রথম চাকরিস্থল ৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে সহকর্মী মনজুরুলকে আমিই প্রথম ইউনিটে রিসিভ করি। আমার দেড় বছরের জুনিয়র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মনজুরুল একজন চুপচাপ, নম্র, ভদ্র, মেধাবী ও চৌকষ অফিসার হিসেবে সেনাবাহিনীতে সকলে কাছে সমাদৃত। Introvert Character এর অধিকারী বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মনজুরুল তার কাজে অত্যন্ত দক্ষ। মুজিব ব্যাটারী যাদুঘর তৈরীর মাধ্যম ও আমাদের এক প্রকার Surprise দিয়েছে এবং দেশ ও জাতিকে সম্মানিত করেছে। এই বিশেষ কাজের জন্য তার ও তার অধীনস্থ সকল অফিসার ও অন্যান্য পদবীর সকল সদস্যদের প্রতি জানাই কৃজ্ঞতা ও আন্তরিক অভিনন্দন (গুগুল করুন Artillery Center & School)।
বাংলাদেশের সকলের পক্ষ থেকে জাতির এই গৌরবকে জাতির সামনে উপস্থাপন করার জন্য আজ আমরা গর্বিত ও ধন্য। ধন্যবাদ আর্টিলারি কোর, ধন্যবাদ আর্টিলারি সেন্টার ও স্কুল, হালিশহর চট্টগ্রাম এবং ধন্যবাদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।