১৯৭১ সালে কিশোর জীবনে, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার দেখা নানা ঘটনার মধ্যে একটি এখনো আলোড়িত করে আমার হূদয়কে। সেই ভয়াল দিনের কথা মনে পড়লে নিজের অজান্তে বেরিয়ে আসে রাশি রাশি ধিক্কার আর অভিশাপ, পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দালাল-দোসরদের উদ্দেশে। আমার পরিবারের জন্য সবচেয়ে হূদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে ১৭ এপ্রিল। ওইদিন সকালে সবার চোখের সামনে যন্ত্রণায় কাতর অবস্থায় বড় ভাই আমিনুল হক (২৫) মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আগের দিন পটিয়া সদরে হানাদার বাহিনীর বোমার আঘাতে আহত হন তিনি।
১৬ এপ্রিল শুক্রবার ছিল পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর জন্য চরম বিভীষিকাময় দুঃখ জাগানিয়া আতঙ্কের দিন। পাকিস্তানি বাহিনীর জঙ্গি বিমান বহর পটিয়া সদরে দুই দফায় আকস্মিক বোমা হামলা ও মেশিনগানের এলোপাতারি গুলি চালায় ওইদিন। এতে প্রায় ২০ জন নিরীহ লোক শহীদ ও অর্ধশতাধিক আহত হন।
৩০ মার্চের পর থেকে চট্টগ্রামসহ দেশের বেশিরভাগ এলাকা যখন শত্রুকবলিত হয়ে পড়েছিল, তখন থেকে ১৬ এপ্রিল সকাল পর্যন্ত পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম ছিল শত্রুমুক্ত তথা স্বাধীন। অনেক দোকান-পাটে তখনো উড়ছিল বাংলাদেশের পতাকা। সে সময়কার প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের কাছ থেকে জানা যায়, কালুরঘাট সেতু রক্ষণাবেক্ষণ ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে হানাদার বাহিনীর অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে নিয়োজিত বাঙালি সেনা ও স্থানীয় সহযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তানি বিমান ও পদাতিক বাহিনী ১১ এপ্রিল সকালে কালুরঘাট এলাকায় প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে। এ সময় ক্যাপ্টেন হারুন অর রশিদ (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) ও লে. শমসের (পরবর্তীতে বিএনপি নেতা) মবিনসহ কয়েকজন বাঙালি সৈন্য ও সহযোদ্ধা আহত হন। এ পর্যায়ে অস্ত্র-গোলাবারুদসহ শক্তির দিক থেকে নিজেদের দুর্বল মনে হওয়ায় কালুরঘাট এলাকায় অবস্থানরত বাঙালিদের মনোবল ভেঙে পড়ে। তাদের অনেকেই চলে যান রামগড়ের দিকে। অল্প কয়েকজন চলে যান পটিয়ার দিকে। কালুরঘাট এলাকার পতন অবস্থা দেখে পটিয়া সদর ও আশপাশে বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থানরত বাঙালি যোদ্ধাদের সর্বশেষ সদস্যদের মধ্যেও অনিশ্চিত অবস্থা দেখা দেয় এবং তাঁরাও সরে যেতে থাকেন এলাকা থেকে। তখনো পাকিস্তানি বাহিনীর ধারণা ছিল, পটিয়ার বাঙালি যোদ্ধাদের বড় ঘাঁটি রয়ে গেছে এবং পটিয়া হয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রাম দখলে নিতে তারা হয়তো প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হবে। ১৫ এপ্রিল তারা কালুরঘাট থেকে পটিয়ার দিকে অগ্রসর হয়ে পটিয়া-বোয়ালখালী সীমান্তের মিলিটারি পুলের দিকে অবস্থান করে।
১৬ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে আমি (লেখক) আরাকান সড়ক-সংলগ্ন কাগজিপাড়ায় আমাদের বাড়ির কাছের (পটিয়া সদর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পশ্চিমে, বর্তমানে পটিয়া পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ড)) দোকান থেকে ঘরের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিষ নিয়ে ফিরছিলাম। এমন সময় পশ্চিম দিক থেকে অস্ত্রকাঁধে লুঙ্গি পরা এক ব্যক্তি পটিয়ার দিকে যেতে যেতে পথচারীদের বলছিলেন, ‘পাঞ্জাবিরা আসছে, রাস্তাঘাট থেকে সরে যান’। এর ঘন্টা তিনেক পরই পটিয়া সদর ও আশপাশের এলাকায় দু’দফায় বোমা হামলা চালায় হানাদার বিমান বাহিনী। আমি তখন বাড়িতে। প্রথম দফা হামলা চলে সকাল প্রায় ১১টায়। হঠাৎ পশ্চিম দিক থেকে শোনা যায় গগনবিদারী বিকট আওয়াজ। হতচকিত হয়ে ঘর থেকে বাইরে এসে মাথা ঘুরিয়ে নিতেই দেখা গেল দুটি বিমান ডিগবাজি খেয়ে নামছে পটিয়া সদরের দিকে। মুহূর্ত না যেতেই প্রচণ্ড বোমা ও গুলির শব্দ। চারদিকে আর্তনাদ, আতঙ্ক, হাহাকার। যে যেদিকে পারছে ছুটছে, এদিক-সেদিক লুকিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। লোকজন বুঝতে পারছে পাকিস্তানি বাহিনীই এ আক্রমণ চালাচ্ছে। সবার মনে ভয়, এই বুঝি শত্রুর গুলি বা বোমার আঘাতে নিঃশেষ হয়ে যাবে নিজেও। আমি আমার ছোট বোন কামরুন্নাহারকে নিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টায় খাটের নিচে শুয়ে পড়ি। অল্প কিছুক্ষণ পর সবকিছুতে নীরব-নিস্তব্ধতা। গোলাগুলি আর বোমার শব্দ থামার পর খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে আসতেই মা বললেন, ‘খবরদার বাবা বাইরে যাসনে। কোন দিক থেকে কী বিপদ আসে।’ মা তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতর থেকে পুরোনো পত্রিকা, বই-খাতাসহ বাংলা লেখা সব কাগজ পেছনের ছোট পুকুরে নিয়ে ডুবিয়ে দেন, যাতে আমাদের পরিবার বঙ্গবন্ধুর সমর্থক সেটা বোঝা না যায়। কারণ স্থানীয় কয়েকজন স্বাধীনতা বিরোধী আমি এবং আমার বড় ভাইকে বলতো ‘মুজিব্যার ফোয়া’।
মেঝো ভাই (লেখকের) আমিনুল হক ছিলেন পটিয়া কলেজের পূর্ব গেটের বিপরীতে নিজ দোকানে। প্রথম দফা বোমা-গুলি থামার পর তাঁকে খুঁজতে ছোটেন বড় ভাই জাহিদুল হক, আমার আর এক ছোট বোনের স্বামীকে নিয়ে। সদরে গিয়ে দেখেন চারদিকে লণ্ডভণ্ড অবস্থা। আশপাশের এলাকার অনেক মানুষ ঘটনাস্থলে এসে প্রায় উদভ্রান্ত অবস্থায় ছুটোছুটি করছেন, খোঁজখবর নিচ্ছেন তাঁদের আত্মীয়স্বজন বা প্রিয়জনদের। লোকজনের আহাজারিতে থানা মোড়, কলেজ রোড, পিটিআই রোড, স্টেশন রোড, আদালত রোড, তালতলা চৌকি, সবজরপাড়া, হাবিবুরপাড়াসহ আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে।
জাহিদুল হক ভাই আমিন ভাইয়ের খোঁজ নিতে দোকানে গিয়ে তাঁকে পেলেন না। স্থানীয় লোকজনদের কাছে জানতে পারেন, আমিন ভাই বোমায় আহত হয়ে পটিয়া কলেজের দক্ষিণ দিকের রাস্তা বেয়ে পশ্চিমে দিকে ছুটে গেছেন। সেদিকে গিয়ে কলেজ মাঠের দক্ষিণপশ্চিম কোণায় মসজিদের কাছে ‘ইদুলমল্লাপাড়ার’ এক বাড়ির সামনে তাঁকে পাওয়া গেল। তাঁর চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের খোঁজে বেরিয়ে দেখলেন, বোমা হামলার পর সব চিকিৎসক চেম্বার কিংবা ডিসপেনসারি বন্ধ করে চলে গেছেন। অবশেষে ভাইয়েরা ছুটলেন খাস্তগীরপাড়া, চিকিৎসক জহুরুল হকের বাড়ির দিকে। কিন্তু ডা. জহুরের বাড়ির পথে স্থানীয় কালীবাড়ির কাছে গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। হানাদার বাহিনী দ্বিতীয় দফা বোমা হামলা শুরু করে এ সময়। বড় ভাই ও ছোট বোনের স্বামী শুয়ে পড়লেন রাস্তার পাশে ক্ষেতের আড়ালে। তখন বেলা প্রায় পৌনে একটা থেকে একটা। মসজিদে মসজিদে মানুষজন তখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন জুমার নামাজ আদায়ের জন্য।
এরকম জুমার সময় আবারো নিষ্ঠুর বোমা হামলা ও গুলির তাণ্ডবে হাহাকার পড়ে যায় চারদিকে। চার-পাঁচ মিনিটের বর্বর তাণ্ডবে আবারও সব ওলটপালট হয়ে গেল। দিশেহারা হয়ে পড়ে সর্বস্তরের মানুষ। বোমাবর্ষণ বন্ধ হলে ক্ষেতের আড়াল থেকে বের হয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে জাহিদ ভাই জানতে পারলেন-যেহেতু আমিন ভাইয়ের পেটে স্প্লিন্টার জাতীয় কিছু ঢুকেছে, তাই সেটি অপারেশনের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এ রকম কাজের ঝুঁকি নেওয়ার মতে চিকিৎসক ও সরঞ্জাম তখন পটিয়ায় ছিল না। তাই ভাইকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল দোহাজারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, ঠেলাগাড়ি করে। পথে ডা. নূরুল ইসলামের (জাতীয় অধ্যাপক) দেখা মিলল কাঞ্চননগর এলাকায়। তিনি দেখেশুনে একটি ইনজেকশন লিখে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটি দেওয়া গেলে রোগী বাঁচতে পারে এবং তিন বছরের মধ্যে ওই স্প্লিন্টার বা গুলি বের করা সম্ভব।’ দুর্ভাগ্য, সেদিন কোথাও সেই ইনজেকশন পাওয়া যায়নি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর, পরদিন সকালে চিকিৎসক প্রিয়দর্শন চৌধুরীর (এমবি ডাক্তার নামে খ্যাত) গ্রামের বাড়ি বাঘখাইনে সেই ইনজেকশন পাওয়া যায়। সেটি নিয়ে ১৭ এপ্রিল সকাল প্রায় ১০টার সময় প্রিয়দর্শন চৌধুরীর ভাই সুপ্রিয় চৌধুরী এসেছিলেন আমাদের বাড়ির কাছে। এমন সময় আমাদের চোখের সামনে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিলেন বোমাহত আমিন ভাই। শুনে মন খারাপ করে ফিরে গেলেন সুপ্রিয় চৌধুরী।
পটিয়ায় বোমা হামলা ও গুলিতে সেদিন থানা মোড়ে নিজ চেম্বারে অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান হাইদগাঁও গ্রামের অশীতিপর হোমিও চিকিৎসক সৈয়দ আহমদসহ অজ্ঞাতনামা এক রোগী। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় রিকশাচালক দুদু মিয়া, গৌবিন্দারখিলের বাচা মিয়ার পুত্র ফয়েজ আহমদ, আবুল খায়ের, নজির আহমদের স্ত্রী নছুমা খাতুন (২৭), মনির আহমদের ছেলে ছৈয়দুল হক (৮), হাবিবুরপাড়ার ঘোড়ার গাড়িচালক উম্মর আলী (৫৫), ইদুলমল্লপাড়ার আমীর আহমদ (৬০), এয়াকুবদণ্ডি গাজীরপাড়ার আলী আকবর, দক্ষিণ ভূর্ষি গ্রামের বিজয় দে, মধুসূদন মিত্র, রমনী মোহন মজুমদার, শতীশ দেবনাথ, পীযুষ চৌধুরী, রবীন্দ্রলাল চৌধুরী ও মঙ্গলাদেবী চৌধুরী ও অজ্ঞাতনামা ৩-৪ জনসহ প্রায় ২০ জন। আহত হন ৫০ জনের মতো।
বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত হয় পটিয়া থানা মোড়ের মসজিদের বারান্দা, এএস রাহাত আলী উচ্চবিদ্যালয়ের ছাদ ও বারান্দার অংশবিশেষ এবং পিটিআইসহ এলাকার বেশ কিছু দালানের অংশবিশেষ। ভস্মীভূত হয় থানা মোড়ের আজিজিয়া কুতুবখানাসহ তিনটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ও বেশ কিছু দোকানপাট। আমি বিকেলে পাড়ার দুজন তরুণের সঙ্গে কৌতূহলবশত পটিয়া থানার মোড় এলাকায় গিয়ে থানার মসজিদ-সংলগ্ন আজিজিয়া কুতুবখানা ও সংলগ্ন ডা. সৈয়দ আহমদের চেম্বারসহ আশপাশের ধ্বংসলীলার যে চিহ্ন দেখেছি তা আজো ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা তখন জানান, চিকিৎসক সৈয়দ আহমদের চেম্বারে কয়েকজন রোগী ছিলেন। চেম্বারের ভেতরেই তাঁরা ভস্মীভূত হয়ে পিণ্ডে পরিণত হয়। ভয়ে সেদিন নিহতদের লাশ নিতে আসারও সাহস করেনি অনেকে। ওই দিনই হানাদার বাহিনী বোয়ালখালীর মিলিটারি পুল এলাকা পার হয়ে পশ্চিম পটিয়া এলাকায় অবস্থান নেয়। ১৭ তারিখের মধ্যে দোহাজারী পর্যন্ত তাদের করতলগত হয়।
লেখক : সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী।