সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমার পর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি মানচিত্র, রক্তে শিহরণ জাগানিয়া একটি লাল-সবুজের পতাকা আর স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম অর্জন স্বাধীনতা প্রাপ্তির পেছনে রয়েছে শোষণ ও বঞ্চনার পাশপাশি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর সুমহান আত্মত্যাগের গৌরবময় ইতিহাস।
এরই মধ্যে আমরা উদযাপন করেছি আমাদের শ্রেষ্ঠতম অর্জন মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পেরিয়ে নানা সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের সরকারগুলোর মনোযোগ ছিলো হতাশাব্যাঞ্জক। একথা সবারই জানা যে, স্বাধীনতার লক্ষ্য পূরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হলো যুগোপযোগী ও গুণগত শিক্ষা। কিন্তু এই স্বতঃসিদ্ধ সত্যটিই আজ সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত।
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র পেয়েছি তার বীজমন্ত্র ছিলো চারটি – জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। পরিতাপের বিষয়- আমাদের শাসকগোষ্ঠী কার্যত তার মূল থেকে সরে এসেছে। এটি নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী আর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রধান অন্তরায়। মহান সংবিধানে উল্লিখিত চারটি মূলনীতিকে জাতীয় অগ্রগতির প্রেরণা হিসেবে নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি কোন একটি ক্ষেত্রেও। অজ্ঞাত কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে এই আদর্শ থেকে সরে আসা হয়েছে আরও বেশি। আর একারণে দেশপ্রেমিক, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন ও প্রতিশ্রুতিশীল প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না।
বর্তমানে দেশে বিরাজমান বহুধা বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থায় অসামপ্রদায়িক চেতনা লালনকারী ও মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী নাগরিক গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এ কথা আমাদের মানতেই হবে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি বিদ্যালয়, বেসরকারি বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, মাদরাসা, কওমি মাদরাসাসহ ভিন্নধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করে যখন আমাদের সন্তানেরা কর্মক্ষেত্র ও বাস্তবজীবনে একত্রিত হবে, তখন যতই তারা পাশাপাশি চলুক না কেনো তাদের চিন্তা, মনন ও কর্মের দিক থেকে বিস্তর ব্যবধান থেকে যাবে।
আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর রয়েছে নানান বিভক্তি। বাস্তবজ্ঞান ও বিশ্বজনীন চাহিদার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে খোলা হচ্ছে নতুন নতুন বিষয় আর প্রণয়ন করা হচ্ছে মনগড়া পাঠ্যক্রম।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে নৈরাজ্য। আদতে বিশ্ববিদ্যালয় হলো বিশ্বজনীন জ্ঞান সৃজন ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র। জ্ঞান উৎপাদন ও চর্চা সমাজে প্রবহমান রাখাই ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য। কিন্তু বর্তমানে আমরা কী দেখছি?
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ধ্যানধারণা থেকে সায়ত্তশাসন (৭৩ এর অধ্যাদেশ) অনুযায়ী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হওয়ার কথা চিন্তা করেছিলেন, তার থেকে বেরিয়ে এসে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে লুটপাট আর ক্ষমতাচর্চার মহড়া। অন্যদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেবার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষাবাণিজ্য ও নগদ মুনাফা অর্জনে অধিক মনোযোগী হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে একথা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশির ভাগই শিক্ষাসেবা ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষাবাণিজ্য ধারণা বাস্তবায়ন করে চলেছে। একারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে গুণগত শিক্ষাদান ও গবেষণার পরিবর্তে লক্ষ্য করা যাচ্ছে অর্থ উপার্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার কারণে অনেক শিক্ষাউদ্যোক্তাকে সাজা ভোগ করতেও দেখা গেছে ইতোমধ্যে।
আবার দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে ছাত্রসংগঠনগুলোও হয়ে পড়েছে অকার্যকর। তারা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের অধিকার আদায়ের পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টায় ব্যস্ত। ছাত্রনেতাদের প্রধান লক্ষ্যই যেনো টেন্ডারবাজি আর নিয়োগ বাণিজ্য। ক্যাম্পাসগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকার কারণে ভিন্নমতের প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোও কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আর এসব কারণে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হতে হচ্ছে অনিশ্চিত গন্তব্যের মুখোমুখি। এমন পরিস্থিতিতে একমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থাই হতে পারে একমাত্র সমাধান। স্বাধীনতাত্তোর কালে বেশ কয়েকটি শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি কোন এক অজ্ঞাত কারণে।
ইংরেজ ভাবাদর্শপুষ্ট শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উপযোগী সমাজগঠনমূলক একটি পরিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় ১৯৭২ সালে গঠিত ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ প্রণীত সুপারিশমালা। এই কমিশনের সভাপতি ছিলেন শিক্ষাবিদ ড. কুদরাত-এ-খুদা। এটি ১৯৭৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত হলেও বাস্তবায়ন তো দূরে থাক, এর লিখিত রূপটিরও তিরোধান যাত্রা সাঙ্গ হয়েছে।
পরবর্তী কালে শিক্ষাকে জাতীয় প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করা এবং জ্ঞানের সমসামায়িক উন্নয়নের সাথে সমন্বয়ের জন্য গুণগত পরিবর্তন করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে তৎকালীন সরকার প্রফেসর শামসুল হককে প্রধান করে ৫৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটি দেশের জন্য প্রযোজ্য ও কার্যসিদ্ধিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার লক্ষে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। দুঃখের বিষয় সেটিও বাস্তবে আলোর মুখ দেখেনি।
এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষকের অধিকার আদায়-আন্দোলনে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে ‘ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন’ প্রদত্ত সুপারিশমালার আলােকে একটি যুগোপযোগী, আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, অসামপ্রদায়িক ও বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন এবং শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবি জানিয়ে আসছে। শিক্ষক সংগঠনগুলোর এই দাবি আজ শিক্ষকসমাজ ছাড়াও সচেতন ও দেশপ্রেমিক মানুষের গণদাবিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকার টানা তৃতীয় বারের মতো ক্ষমতায় এসে ইতোমধ্যে যুগ পূর্তি পালন করেছে। বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জনবান্ধব আওয়ামী লীগ এক টানা তৃতীয় দফা সরকার গঠন করলে শিক্ষানুরাগী জনগণ ও শিক্ষকসমাজ আশার আলো দেখতে শুরু করে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে অনতিবিলম্বে শিক্ষকসমাজ, শিক্ষানুরাগী, সচেতন ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের দাবি- ২০১০ সালে ঘোষিত জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন, বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ না করে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ এবং একমুখী ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ জরুরি। অতিসমপ্রতি মহামারি করোনা (কোভিড-১৯) শিক্ষাক্ষেত্রে যে বিপর্যয় ও শূন্যতা তৈরি করেছে তা সচেতন শিক্ষকসমাজের সাথে দেশপ্রেমিক সকল নাগরিককেও উদ্বিগ্ন করছে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা পুনরুদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়াও সময়ের দাবি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে একটি যুগোপযোগী, আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, অসামপ্রদায়িক ও বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন এবং শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবি বাস্তবায়ন সদাশয় সরকারের কাছে আশা করাই যেতে পারে।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, সাংবাদিক ও লেখক