মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে নারীর চরিত্র নির্মাণ

ড. আনোয়ারা আলম | বৃহস্পতিবার , ৩০ মার্চ, ২০২৩ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

মার্চ মাস মুক্তিযুদ্ধের মাস। ১৯৭১ সালের এ মাসে পুরো বাঙালি জাতি কাটিয়েছেন এক বিভীষিকাময় সময়। একদিকে লড়ছিলেন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা, অন্যদিকে দেশের ভেতরে আমরা ছিলাম এক অদৃশ্য কারাগারে।

মুক্তিযুদ্ধে লড়েছেন নারী ও পুরুষ, কারণ এটি ছিল এক জনযুদ্ধ। যদিও ইতিহাসের পাতায় নারীর ভূমিকা একটা সময়ে থিতু হয়েছে শুধু একটি বিন্দুতে তথা বীরাঙ্গনা! আর চলচ্চিত্রেও নারীর চরিত্র আবর্তিত হয়েছে নির্যাতিতা নারী হিসেবে।

চলচ্চিত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আধুনিকতম গণ ও শিল্পমাধ্যম। জনসংস্কৃতি হিসেবে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে এর বিকল্প নেই।

চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় ‘যুদ্ধ সিনেমা বা ওয়ার মুভি’ নামে একটা ঘরানা আছে। যেখানে উঠে আসে একটি ভূখণ্ডের ইতিহাস, যুদ্ধের ভয়াবহতা, বিজয়ের কথা, কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র আর দাগ কেটে যাওয়ার মতো গল্প।

বিশ্বের প্রেক্ষিতে আমরা দেখি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত হয়েছে অনেক চলচ্চিত্র যেমন রোম, ওপেন সিটি(১৯৪৫), দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই, (১৯৫৭), দ্য ব্যটল অব আলজিয়ার্স(১৯৬৬), প্ল্যাটুন(১৯৮৬), প্রাইভেট রায়ান(১৯৯৮), দ্য পিয়ানিস্ট(২০০২)ইত্যাদি। ডাউনফল (২০০৪) চলচ্চিত্রে হিটলারের শেষ দিনগুলোর বর্ণনা রয়েছে। অর্থাৎ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমরা যুদ্ধের বিভীষিকার সাথে সাথে নারী ও পুরুষ উভয়ের সংগ্রামের কথা জানতে পারি।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে জহির রায়হান এর ‘জীবন থেকে নেওয়া’ বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে চমৎকার ভাবে তুলে ধরেন। ‘লেট দেয়ার বি লাইট’আরও একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যা আলোর মুখ দেখেনি। একই সাথে আরও একটি প্রামাণ্য চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মাণ করেন যেখানে যুদ্ধের ভয়াবহতার সাথে শরণার্থী শিবিরের দুঃখ বেদনা ও কষ্টের বাস্তবতা এতোটা মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে যা এক অসামান্য দলিল হিসেবে ইতিহাসে আসন নিয়েছে। আমাদের দুর্ভাগা এমন এক অসাধারণ নির্মাতাকে আমরা হারিয়েছি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র। স্বল্পদৈর্ঘ্য থেকে শুরু করে পূর্ণদৈর্র্ঘ চলচ্চিত্র। তবে প্রশ্নটা এসে যায় নারী চরিত্র কিভাবে চিত্রায়িত হয়েছে! এখানে গবেষক কাবেরী গায়েনের গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধে চলচ্চিত্রে নারী চরিত্র নির্মাণ’ এ লরা মালভির বরাত দিয়ে ব্যাখ্যা করেন চলচ্চিত্রে কিভাবে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতে অর্থ উৎপাদিত হয়, পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতে উৎপাদিত চলচ্চিত্রে নারী অর্থের বাহক মাত্র আর অর্থের নির্মাতা হিসেবে পুরুষ তার জায়গা করে নেয়। নারীকে প্রচলিত কাঠামোর অনুকরণে যৌনবস্তু হিসেবে দেখানো হয়।

গভীর পর্যবেক্ষণে ক্ষোভে ও বেদনায় দেখি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দিকের চলচ্চিত্রে নারীর ভূমিকা শুধু মাত্র যেন বীরাঙ্গনার ভূমিকায়। অথচ নারীরা মুক্তিযুদ্ধের আবহ সৃষ্টি থেকে শুরু করে একেবারে শেষ পর্যন্ত বহুমুখী ভূমিকায় অংশগ্রহণ করেছেন তা দেশের বাইরে ও ভেতরে।

দুই লক্ষ মাবোনের ইজ্জতের বিনিময়ে’ এ বক্তব্যের মুক্তিযুদ্ধকে মোড়কজাত করা হয়েছে। লিঙ্গ বিভাজিত সমাজে নারীর বহুমাত্রিক ভূমিকা আড়াল হয়ে যায় আর আমরা প্রত্যক্ষ করি পুরুষের গৌরবগাথা।

মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে ভারতীয় চলচ্চিত্রকার আই জোহরের নির্মিত ‘জয় বাংলাদেশ’ (১৯৭১) এর অধিকাংশ দৃশ্যই ছিল নর্তকীর শরীর প্রদর্শন। চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা এগারজন’ চলচ্চিত্রে নারী শুধুই নির্যাতিতা, ‘রক্তাক্ত বাংলা’ তেও একই ভাবে। সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে নির্মিত গেরিলাতে একজন সাধারণ নারীকে সাহসী ভূমিকায় দেখালেও শেষ দৃশ্যে মেজরের ‘আই এম গেটিং হট নাও’ এ যেন পুরুষতান্ত্রিক সংলাপের প্রতিধ্বনি।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দিকের দুটো চলচ্চিত্র দেখে চলচ্চিত্র পরিচালক ও সমালোচক আলমগীর কবির হতাশা নিয়ে বলেন-‘অত্যন্ত দুঃখ ও হতাশার সাথে লক্ষ্য করছি যে,এ যেন মুক্তি আন্দোলনের তাৎপর্যের চাইতে ব্যবসায়িক সাফল্যের চেষ্টা এবং পাক সেনাবাহিনী কতৃক মা বোনদের ধর্ষণের চলচ্চিত্রায়নের মধ্যে এক বিরাট বাজারি সম্ভাবনা রয়ে গেছে’।

মুক্তিযুদ্ধের মূল থিমে পরিলক্ষিত হয় কেবলই পুরুষদের জয়গাথা আর নারীর প্রতি লাঞ্চনা। যদিও এসব নারীদের প্রতি পরিবার ও সমাজের নির্মম আচরণ বা তাঁদের শেষ পরিণতির দিকটা অবহেলিত হয়েছে। নারীবাদীক চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক লরা মালভি তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘ভিজ্যুয়াল প্লেজার অ্যান্ড ন্যারেটিভ’ সিনেমা (১৯৭৫) এ বলেছেন, “এটি পুরুষের দৃষ্টি বা মেলগেজ। তিনভাবে এটি কাজ করে। প্রথমত পরিচালকের ক্যামেরার ব্যবহার, চলচ্চিত্রে পুরুষ চরিত্র এবং পুরুষ দর্শকের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার ও মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যবস্ততে পরিণত করা। এই দর্শনটি মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়েছে।

তবে আশা ও প্রত্যাশা নিয়ে বলতে হয়অনেক তরুণ প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতা এগিয়ে আসছেন নারী প্রধান চলচ্চিত্র নির্মাণে। যেমন সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, মায়া দ্যা লস্ট মাদার ‘কালবেলা’ নির্মিত ও প্রশংসিত হয়েছে।

তারেক মাসুদ ও ক্যাথারিনা মাসুদ পরিচালিত ‘নারীর কথা’ চলচ্চিত্রে ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিবর্তে তাঁর মুখেই মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনানো হয়েছে।

কালবেলা চলচ্চিত্রে একদল গারো নারী মুক্তিযোদ্ধার সংগ্রামের বিষয়টি তুলে আনা হয়েছে।‘তারামন বিবি’ কে নিয়ে নির্মিত হচ্ছে একটি চলচ্চিত্র। স্বাধীনতার এতোটা বছর পরে হলেও এগুলো মনের মাঝে আশা ও প্রত্যাশার আলো জাগায়। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে নারীর বীরত্বগাথা নিয়ে নির্মিত হোক আরও অনেক চলচ্চিত্র। নারীর বহুমাত্রিক ভূমিকায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ইতিহাস যেন কথা বলে।

লেখক: প্রাবন্ধিক; সাবেক অধ্যক্ষ, আগ্রাবাদ সরকারি মহিলা কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদৈনিক আজাদীতে একাত্তরের মার্চ
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম