বাংলা ভাষায় শিশুসাহিত্য রচনার শুভ যাত্রা শুরু হয় ১৮১৮ সালের ‘দিগদির্শন’ নামক সাময়িকীর মাধ্যমে। শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন এই মাসিক পত্রিকাটি প্রকাশ করে। তারপর থেকে ছোট নদীটি অসংখ্য সৃজনশীল সাহিত্যিকদের কলমে একটি টুইটুম্বর নব যৌবনা নদী। এই নদীর অভিমুখ আগামীর শিশুসাহিত্যের মহাসমুদ্র। যেখানে নেই কোনো সীমানা, নেই সুনির্দিষ্ট গভীরতা, আছে শুধু সৃজনশীলতার রত্ন ভাণ্ডার।
আজকের শিশুরা রূপকথার রসভাণ্ডারের দরজা খুলে প্রবেশ করেছে প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনার যুগে। শিশু–কিশোরদের নিয়ে রচিত আগামী দিনের সাহিত্য সেই খোলা দরজায় পা রেখেছে। লোক সাহিত্যের খোলা দরজায় লৌকিক, ঐতিহাসিক, পৌরাণিক ও ধর্মীয় কাহিনির জনপ্রিয়তার এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার আমাদের শিশুসাহিত্যের কপালে রাজ তিলক পরিয়ে দিয়েছে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘মেয়েলি ছড়া’ প্রবন্ধে শিশুসাহিত্য (১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ; ১৩০১ বঙ্গাব্দ) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। অন্যদিকে এর ঠিক পাঁচ বছর পরে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে (১৩০৬ বঙ্গাব্দ) যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘খুকুমনির ছড়া’ সংকলনের ভূমিকায় ‘ছড়া সাহিত্য’ ও ‘শিশুসাহিত্য’ শব্দ দুটি উল্লেখ করেছেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। যোগীন্দ্রনাথই প্রথম শিশুদের বইয়ের নিরস জগত থেকে আনন্দময় জগতের দরজা খুলে দিয়েছিলেন আর আমরা শিশু সাহিত্যিকরা এই প্রযুক্তির যুগে এসে সেই আনন্দযজ্ঞকে পরম সাধনায় ভরিয়ে দিব।
উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক শিশুসাহিত্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত। বিগত পাঁচ দশকের এবং আমাদের বর্তমান শিশুসাহিত্য একটি শক্তভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যদি আমরা এটাকে এগিয়ে দিতে না পারি তাহলে ভবিষ্যতে সোনালি শিশুসাহিত্য তৈরি হবে না। আগামী দিনের শিশুসাহিত্যিকদের মনে রাখতে হবে, শুধু আনন্দ দেওয়ার জন্যই সাহিত্য নয়, সাহিত্যের কাজ দিগন্ত বিস্তৃত। সমাজের ও জীবনের এবং আগামী প্রজন্মের কাছে রয়েছে দায়বদ্ধতা। এই দায়বদ্ধতা নতুন সমাজ ও প্রজন্ম গড়বার। যদিও নব্বই দশকের স্বপ্ন দেখা শিশুকিশোরদের সাথে প্রযুক্তিবান্ধব শিশু কিশোরদের মধ্যে বিরাট ফারাক তৈরি হয়েছে। তবুও মনে রাখতে হবে এবং ভাবতে হবে হাতে যতই প্রযুক্তির ইঁদুর থাকুক এই যুগে শিশুরাও কল্পনার রঙিন স্বপ্নময় রাজ্যে হারিয়ে যেতে ভালোবাসে। কারণ শিশুরা চিরকালেরই শিশু। কবিগুরু তাইতো বলেছেন, ‘ভালো করিয়া দেখিতে গেলে শিশুর মত পুরাতন আর কিছুই নাই’।
শিশুসাহিত্যিকদের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো আধুনিক সময়োপযোগী অর্থাৎ নতুন সময় উপযোগী নতুন ভাষা এবং নতুন বিষয় তৈরি করা। শিশুকিশোরদের প্রাণের কথা, কল্পনার কথা, কৌতূহলের কথা এবং আনন্দ–বেদনার কথা উঠে আসতে হবে। দেশপ্রেম, বিজ্ঞানমনস্কতা, মানবিক মূল্যবোধ এবং সমাজ সচেতনতার মুক্তামালা দিয়ে আগামী সাহিত্য রচনা করে শিশুদের জাগিয়ে দেওয়াই সময়ের দাবি। স্বদেশের প্রকৃতি, মাটি ও মানুষ, জীববৈচিত্র্য, শিল্প–সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাইন্স ফিকশন এবং গোয়েন্দা কাহিনিকে বিনি সুতায় গেঁথে আগামীর শিশু–কিশোরদের মনস্তত্ত্বের প্রভাব ফেলতে পারে এমন শিশু সাহিত্য রচনা করাই যুগের দাবি। আমাদের সোনার বাংলার সোনালি শিশুরা স্বদেশ প্রেমের কাব্যময় ছন্দে আবেশিত হবে। কেবল কাল্পনিক উপাদান নির্ভর শিশুসাহিত্য নয় জীবনধর্মী ও বাস্তবমুখী সাহিত্যের সৌন্দর্যে তাদের হৃদয় নতুন জীবনবোধের স্বর্ণ ভাণ্ডারে ভরে উঠুক।
জগত সংসারের বাস্তব চিত্র তাদের সাহিত্যে উঠে আসবে কিন্তু সেখানে থাকবে না কোনো নেতিবাচক ধারণা। শিশুর মনের সরল রাজ্যে মূল্যবোধ সম্পন্ন জীবন গাথা যেন প্রভাব ফেলতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এখন আর শিশুরা রূপকথা ও ভৌতিক গল্প পছন্দ করে না।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসের সঠিক তথ্য তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। এই পবিত্র দায়িত্ব অর্থাৎ দেশ গড়ার মহান ও পবিত্র দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দিতে হবে প্রেরণামূলক ও উদ্দীপনামূলক সাহিত্যের মাধ্যমে। তারা যেন অতীতের কোনো কাহিনির মত বিভ্রান্ত হতে না পারে।
আমরা আগামীর শিশুসাহিত্যিকরাই সাহিত্যের মাধ্যমে নৈতিকতা ও সহমর্মিতার শান্তিময় সহাবস্থান ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার হাতিয়ার তাদের হাতে তুলে দিতে পারব। আমাদের শিশুসাহিত্যের বিগত দুইশত বছরের ইতিহাস স্বর্ণালী আলোয় উদ্ভাসিত আর আগামী শিশুসাহিত্য হবে হীরক জ্যোতির্ময়। যেই জ্যোতিতে জেগে উঠবে আমাদের নতুন একটি সাহিত্য ভাণ্ডার আর এই ভাণ্ডার হাতে নিয়ে এগিয়ে যাবে নতুন প্রজন্ম। শিশুসাহিত্যের আগামী অভিযান শিকড় থেকে যেন শিখর পানে বেগবান হয়। তবেই শিশুর সাহিত্যের জয়যাত্রার হীরকগাথা রচিত হবে। মানসম্মত শিশুসাহিত্য রচনা করতে হলে –১) সংস্কৃতির অচলায়তন অর্থাৎ যা শিশুর উপর কর্তৃত্ববাদ হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হয়। আগামী দিনের শিশুসাহিত্য রচনার মাধ্যমে সেই অন্ধকূপ থেকে শিশুদের বের করে আনতে হবে। ২) আনন্দহীন শিক্ষা ব্যবস্থা মুখস্থকে যেন তারা না বলতে পারে। শিক্ষা ব্যবস্থায় মূল্যবোধসম্পন্ন শিশুসাহিত্যকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জাতীয় শিক্ষাক্রমে এর সংযোজন জরুরি। ৩) পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতির অগ্রাসন মুক্ত সাহিত্য ভাণ্ডার তাদের হাতে তুলে দেওয়া। যেখানে স্থান পাবে আমাদের সংস্কৃতি, নৃতাত্ত্বিক সংস্কৃতি ও প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্কৃতি। যা পাঠ করে শিশু হয়ে উঠবে আগামী দিনের আলোকিত সূর্য। যার আলোয় স্নাত হবে জাতীয় ঐতিহ্য।
আগামী দিনের শিশুসাহিত্যের মধ্যে ভাষা, অমর ব্যক্তিত্ব, অবিস্মরণীয় কীর্তি, বাঙালির ইতিহাস, বিশ্বপরিচয়, ভূগোল, শিল্প–সংস্কৃতির উপাদান সমৃদ্ধ হলে তবে শিশুর সাহিত্যের সোনার তরী বাইতে পারব।
একটি মানসম্মত শিশু–কিশোর চলচ্চিত্র যেখানে থাকবে গীতময় ছন্দ যা শিশুর জীবনের বাঁকই ঘুরিয়ে দিতে পারবে। তাই এই সকল হাতিয়ার স্ব–স্ব অবস্থান থেকে ধারণ করে কলমের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে।
গদ্য, ছন্দ, গল্পকথা, নাটক, উপন্যাস, গান, প্রবন্ধ নিবন্ধ এর নতুন ধারা সৃষ্টির মাধ্যমে জাগ্রত হবে এক নতুন রঙিন শুধুমাত্র স্বপ্নময় নয় সম্ভাবনাময় এক নতুন প্রজন্ম। শিশুর কল্পনার জগত হবে সম্ভাবনাময় আর বুদ্ধিদীপ্ত। পুরাতন ধারণাকে ছেড়ে তাদেরই যুগোপযোগী আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা রচনা করব নতুন শিশুসাহিত্য। যেখানে থাকবে না কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা। অনেকে হয়তো বলবেন আধুনিক ডিভাইস তাদেরকে পিছিয়ে দিচ্ছে। মোটেও না নতুন যুগের চাহিদাকে অস্বীকার না করে বরঞ্চ প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের মনোজগতে বিচরণ করে তাদেরকে অন্ধকার থেকে নতুন আলোর জগতে উদ্ভাসিত করতে হবে।
শিশুসাহিত্যিক সুজন বড়ুয়া যথার্থই বলেছেন, ‘শিশুসাহিত্য তো এখন শিশুর মতই ঝলমলে রঙিন মোহনীয়। রং আর ছবি ছাড়া শিশুসাহিত্যের বই এখন কল্পনাই করা যায় না। রং ছবিতে জমজমাট না হলে ছোটদের বই কিসের।’
তাই আগামী দিনের প্রকাশনা শিল্পকে এই ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে। আগামী শিশুসাহিত্য বিষয় বৈচিত্র্য, ছন্দে আর নির্মাণ কৌশলে হবে পরিপক্ক ও পরিপূর্ণ। সমাজ ও জীবনের লেখনীর সাথে ফুটে উঠবে তারই এই রঙিন ছবি। সেই উজ্জ্বলতম লেখা প্রকাশে শিশু কিশোর সন্ধান পাবে এক স্বর্ণালী রেখা। শিশুসাহিত্যিকদের হাত ধরে উঠে আসবে নতুন সোনালি অধ্যায়। শব্দ ও ছন্দের মাধ্যমে খুলে দিতে হবে শিশুদের অন্তর্দৃষ্টি। বিগত সময়কার শিশুসাহিত্যিকদের ইতিহাস জানানোর পাশাপাশি সেই সকল মহান লেখকদের লেখাকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা যেতে পারে। আমাদের শিশুসাহিত্য যেন আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয় এটাই হোক আজকের প্রত্যাশা।
লেখক: প্রাবন্ধিক, বিভাগীয় প্রধান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, নিজামপুর সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।