মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুজিবনগর সরকারের অবদান চিরস্মরণীয়

| রবিবার , ১৭ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:০৭ পূর্বাহ্ণ

আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য এক দিন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের এই দিনে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। নবজাত রাষ্ট্রের এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জনগণকে তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে অদম্য স্পৃহায় মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। পরে বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর হিসেবে নামকরণ করা হয়। মুজিবনগর সরকারের সফল নেতৃত্বে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
মুজিবনগর শুধু ঐতিহাসিক স্থানই নয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাষ্ট্র গঠনের ভূমিও। যুদ্ধ করে বিজয়ী হওয়া প্রতিটি দেশের এমন একটা জায়গা থাকে, যেটি মানুষের আবেগের সঙ্গে যুক্ত। যেমন আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে চিহ্নিত। ঠিক সেভাবে মুজিবনগর বড় উৎসবের এক জায়গা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানোর পর একই বছরের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। তৎকালীন সরকারের ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়। সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী হিসেবে ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী করা হয় এএইচএম কামরুজ্জামানকে। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার এবং মেজর জেনারেল আবদুর রব চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৭ এপ্রিল সকালে মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
মুজিবনগর সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন আদায়, শরণার্থী ব্যবস্থাপনা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশবাসীর পাশে দাঁড়ানো ও তাঁদের মনে আশা সঞ্চারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধকে সুচারুভাবে পরিচালিত করে সফল পরিসমাপ্তির দিকে ধাবিত করে। মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের অবদান অপরিসীম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় এনে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সমর্থন আদায় ও গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তিতে মুজিবনগর সরকারের বলিষ্ঠ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের ভূমিকা অপরিসীম।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের রচয়িতা ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম তাঁর এক লেখায় লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে হলে মুজিবনগর সরকার এবং এই সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে হবে, বুঝতে হবে। আমি মনে করি মুজিবনগর সরকারের ইতিহাস ও তাৎপর্য পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। মুজিবনগর সরকার নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। বিশেষ করে শিক্ষার্থী এবং নতুন প্রজন্ম মুজিবনগর সরকার বিষয়ে আগ্রহ নিয়ে গবেষণা করবে, এটিই প্রত্যাশা। স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা, এই সরকারের বিচক্ষণতা ও কৌশল সম্পর্কে বর্তমান সময়ের তরুণ রাজনীতিবিদদেরও জানা থাকা দরকার। যে ত্যাগ, সাহস ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনের পথে নিয়ে যায় মুজিবনগর সরকার, সেই গৌরবের ইতিহাস কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিতে এবং রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত ওই সময়ের নেতাদের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগর সরকার গঠনের দিবস, দেশের নতুন প্রজন্ম ও ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। আমরা আগামীতেও দিনটি যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করব’।
বিশ্লেষকদের মতে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টি ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় নবগঠিত এই সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এই সরকারের যোগ্য নেতৃত্ব ও দিক-নির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধ দ্রুততম সময়ে সফল সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যায়। এই সরকার গঠনের ফলে বিশ্ববাসী স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামরত বাঙালিদের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। মুজিবনগর সরকারের হাত ধরে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুজিবনগর সরকারের গুরুত্ব ও অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে