মীরসরাইয়ের রেল দুর্ঘটনা সমগ্র দেশে এক ধরণের শোকাবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। কতগুলো তরুণের তাজা প্রাণ হারানোর হৃদয়বিদারক এ ঘটনা বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে দেখলো সমগ্র জাতি। ঘটে যাওয়া রেল দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা খুবই কঠিন। এক নিমিষেই অনেকগুলো পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। আমরা বলে থাকি, একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না। কিন্তু এ দুর্ঘটনা অনেকগুলো পরিবারের একসাথে কান্না। একজন বা দুইজন মানুষের ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে শত শত মানুষকে।
মীরসরাইয়ের দুর্ঘটনাটি ঘটার পরদিন কালের কণ্ঠ পত্রিকার প্রথম ও দ্বিতীয় পাতায় দুটো ছবি ছাপা হয়েছে। প্রথম পাতায় দুর্ঘটনায় পতিত মাইক্রোবাসটিকে টেনে এক কিলোমিটার নিয়ে আসার পরের অবস্থা, যা দেশব্যাপী সকল পত্রিকায় দেখেছি আমরা। আর দ্বিতীয় পাতার ছবিটি হলো ঢাকা বিমানবন্দরের অরক্ষিত রেল ক্রসিং, যেখানে ট্রেন নিকটে আসা সত্ত্বেও লোকজন দৌড়ে রাস্তা পাড় হচ্ছে। লেভেল ক্রসিংয়ের গেটবার দেওয়া ছিল না। এখানেও একটি দুর্ঘটনা মুহূর্তেই ঘটতে পারতো। প্রশ্ন হলো এত বড় দুর্ঘটনা ঘটার পরও ঐ মানুষগুলোর অসচেতন কেন? আচ্ছা জীবনটা কার, রেলওয়ের নাকি আমাদের? জীবন বাঁচাতে রেলওয়ের কি পদক্ষেপ নিল সেটার চেয়ে বেশি জরুরি নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা কতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করছি তা। মনে রাখতে হবে ট্রেন হচ্ছে এমন একটি যানবাহন যা চাইলেও সাথে সাথে কন্ট্রোল করা যায় না, সামনে যা পাবে ভেঙে চুরে নিয়ে যাবে। তাই নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রাখাটা যুক্তিযুক্ত।
মীরসরাইয়ের দুর্ঘটনায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া পাঁচজনের একজন জুনায়েদ। তাঁর ভাষ্যমতে, ওরা পাঁচজন মাইক্রোবাসের পেছনের সিটে বসেছিল, বাকীরা সামনে। উক্ত স্থানের ক্রসিংয়ে গেট খোলা ছিল। রেলের কোনো গেটম্যান দেখা যায়নি। গাড়িটি লাইনে ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন এসে ধাক্কা দেয়। বিকট শব্দে মাইক্রোবাসের পেছনের ডালা খুলে পাঁচজনের সবাই নিচে পড়ে যায়। এইভাবে তাঁরা বেঁচে যায়। আবার দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় বাসিন্দার মতে, দুর্ঘটনার সময় লেভেল ক্রসিংয়ের গেটবার দেওয়া ছিল না, গেটম্যানও ছিলেন না। এ সময় দ্রুতগতির মহানগর প্রভাতি ট্রেনটি মাইক্রোবাসটিকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার ঠেলে নিয়ে যায়। অন্যদিকে মহানগর প্রভাতি ট্রেনের একজন যাত্রীর ভাষ্য হলো, ‘আমি ট্রেনের সামনের দিকে ছিলাম। তখন হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ ট্রেনের সামনে একটি মাইক্রোবাস পড়ে গেলে দুর্ঘটনা ঘটে। গেটবার আমি দেখিনি’। উক্ত তিনজনের বক্তব্য একরকম হলেও রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্ঘটনার সময় গেটবার দেওয়া ছিল। মাইক্রোবাসের চালক গেটবার সরিয়ে লেন পার হওয়ার চেষ্টা করলে দুর্ঘটনা ঘটে। এটাই আমাদের সমস্যা। দোষ স্বীকার না করার প্রবণতা। তাহলে মহামান্য আদালত গেটম্যান সাদ্দামকে কেন কারাগারে প্রেরণ করলেন? আমাদের আরো এক ধরনের খুবই বাজে স্বভাব আছে, হাত উঁচু করে দিয়েই রাস্তা পার হওয়ার প্রবণতা, এখানে গাড়ি কেমন স্পীডে কোন অবস্থানে আছে বিবেচ্য বিষয় নয়। বিশেষ করে বাইক, সিএনজি, রিক্সা চালকদের একটা স্বভাব হচ্ছে ট্রেনের সিগন্যাল পড়ে গেলেও চিপাচাপা দিয়ে লেভেল ক্রসিং পারাপারের প্রবণতা। লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত কিংবা সুরক্ষিত যাই হোক না কেন পারাপারের আগে অবশ্যই ট্রেন লাইনের দুপাশে দেখে নেওয়া জরুরি আমাদের নিজেদের জীবনের স্বার্থে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯-এর জুন পর্যন্ত গত ৫ বছর দুর্ঘটনা হয়েছে ৮৬৮টি। এই দুর্ঘটনাগুলোতে ১১১ জন নিহত এবং আহত হয়েছে ২৯৮ জন। তবে সমপ্রতি দু’টি দুর্ঘটনা ধরলে এই সংখ্যা হবে ৮৭০টা। এই দুর্ঘটনাগুলোতে ১২৭ জন নিহত এবং আহত হয়েছে তিন শতাধিক। আর মীরসরাইয়ের দুর্ঘটনায় নিহত ১১ জন ও আহত ৫ জন। এই যে এত মানুষ মারা যায় রেলের দুর্ঘটনায়, এ ধরনের দুর্ঘটনার মূল যে কারণগুলো তারমধ্যে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং ছাড়াও যেগুলো উল্লেখ করার মতো সেগুলো হলো পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল সংকট, ক্ষেত্র বিশেষে ডাবল লাইন না থাকা, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন, দুর্বল লাইন, অসতর্কতা ও অবহেলা, এবং দুর্বল সিগনালিং সিস্টেম। বিভিন্ন লেভেল ক্রসিংয়ে লোকবল সংকটে অসচেতন ভাবে মানুষ ও গাড়ি রেললাইনে উঠে যাওয়ার কারণে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। যেমন সমপ্রতি মীরসরাইয়ের ঘটনাটি। গবেষণার সূত্রমতে, রেল দুর্ঘটনার ৮০ শতাংশের বেশি ঘটছে কর্মীদের ভুলে ও অবহেলায়। গত পাঁচ বছরের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনার প্রধানত দু’টি কারণ পাওয়া যায় তা হলো মানবিক ভুল ও কারিগরি ত্রুটি। গড়ে ৮০% ভুলের মধ্যে রয়েছে লাইন পরিবর্তনের জোড়া ভুলভাবে স্থাপন করা ও ভুল সংকেত দেওয়া। সংকেত ও গতিনির্দেশিকা না মেনে ট্রেন চালান চালক ও সহকারী চালকেরা। জনগণের অসচেতনতা ও অন্যান্য কারণে বাকী ২০ শতাংশ দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। অতএব সতর্ক দুপক্ষকেই হতে হবে। অযথা একে অপরকে দোষারোপ না করে সতর্কতা জরুরি।
আমরা মীরসরাইয়ের ঘটনায় দেখলাম কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি করেছে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হোক সেটা সবার প্রত্যাশা। পাশাপাশি ট্রেনের দুর্নীতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রনির যে যৌক্তিক আন্দোলন সেটাও খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। দেশের জনগণ একবাক্যে বিশ্বাস করে রেলখাত দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতি ও ট্রেন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে রেলে দক্ষ জনবল বৃদ্ধি করা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের নিয়মিত তদারকি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, আধুনিক সিগনালের ব্যবস্থা করা এবং অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা জরুরি। সেই সাথে রেল পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের বিশেষ করে রানিং স্টাফ যারা তাদের সঠিক ট্রেনিং নিশ্চিত করা। এসব বিষয়ে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিয়ে রেলের দুর্ঘটনা এড়ানো এবং সেবার মান বাড়ানো যেতে পারে।
রেল দুর্ঘটনা আমাদের দেশে বা বিশ্বে নতুন কিছু নয়। মাঝে মধ্যেই এ রকম মর্মান্তিক খবর আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়। কিন্তু কিছু দিন পর আমরা ভুলে যাই। দুর্ঘটনা থেকে যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ করি না। প্রতিকারেরও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। ফলে যা হবার তাই হয়। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে ভাবা উচিত। সাধারণ জনগণকেও সতর্ক হতে হবে ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে। নাহলে এভাবে ঝড়তে থাকবে প্রাণ। আমরা চাই না – অকালে হারিয়ে যাক আর কোনো প্রাণ, খালি হোক আর কোনো মায়ের কোল।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।