মিহির স্যার : শিক্ষার্থীদের জীবন পথের আলোকদিশা

বদরুননেসা সাজু | শনিবার , ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

ছাত্রছাত্রীর জ্ঞান ও নৈতিক গুণাবলীর ভিত্তি গড়ে দেয়ার শিক্ষাগুরু: সুদীর্ঘ ৪২ বছর সবার প্রিয় মিহির স্যার শিক্ষকতা করেছেন। তিনি একজন আদর্শ এবং কর্তব্যপরায়ণ শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতাকে পেশা নয়, ব্রত হিসেবেই তিনি গ্রহণ করেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিনয়ী, সদালাপী, প্রচার বিমুখ ও মুক্ত চিন্তার অধিকারী ছিলেন। তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী ও সফল কৃতী শিক্ষার্থী রয়েছে। এমন শিক্ষাগুরুকে নিয়ে স্যারের অনেক ছাত্র ফেসবুকে স্মৃতিচারণ করেছেন। এমন নিঃস্বার্থ, নির্লোভ, শিক্ষার্থী দরদী মিহির স্যারকে কাটিরহাট হাই স্কুলের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে তথা পার্থিব জগতের লোভ লালসা ত্যাগ করা নিরহংকার, অত্যন্ত সাধাসিধে আদর্শ শিক্ষাগুরু হিসেবে স্যারের ছাত্ররা আখ্যায়িত করেছেন। কবি ও গীতিকার নানুপুর লায়লা কবির কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক পংকজ দেব অপু লিখেছেনতাঁর প্রতিটি ক্লাস এমন আকর্ষণ জাগানিয়া ছিলো মনে থাকতো না জটিল অংকের সমুদ্রে সাঁতার কাটছি বরং মনে হতো আমরা যেন সাহিত্যের রসে ভেসে ভেসে পৌঁছে গেছি সহজ সমাধানে। বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে শিক্ষাগুরু মিহির কান্তি শীল স্যারের উদ্দেশ্যে নিবেদিত নাম ‘সীমানা দেয়াল’ কবিতাটি ৮ অক্টোবর ২০১০ ইং তারিখ শুক্রবার দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয়।

ফেসবুকে মিহির বাবু স্যারের প্রাণপ্রিয় আরো অনেক ছাত্রের স্মৃতিচারণ দেখে খুব ভালো লেগেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জামাল নজরুল ইসলাম গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বাবু অঞ্জন কুমার চৌধুরীর লেখাটিও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তিনি লিখেন, ‘কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আশির দশকে যারা পাস করে বের হয়েছেন তারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সজ্জন ও সফল ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। এর কারণ হলো তখন এক ঝাঁক অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন। যেমন নৃপেন্দ্র নাথ দেব, রামকৃষ্ণ ভট্টচার্য, মিহির কান্তি শীল, হৃদয় বিকাশ মহাজন, ইখতিয়ার মুন্সি, নটু গোপাল ভৌমিক, মোঃ শামসুজ্জামান, আবুল ফারাহ, মোঃ আব্দুল্লাহ, গোলাম মওলা, মোঃ সিরাজুদ্দৌলা, আহমদ উল্লাহ হুজুর, কালীপদ দে পণ্ডিত মহাশয় প্রমুখ। এরা পাঠ্যপুস্তকের সাথে সাথে আচরণের শিক্ষা ও মানবতার দীক্ষা দিতেন। মূলত. হাইস্কুলেই মানুষের মানবিক গুণাবলীর ভিত্তি তৈরি হয়। পরবর্তীতে যা মানুষের ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে উঠে। আজ বিজ্ঞান শিক্ষক মিহির স্যারকে নিয়ে বলি। মিহির স্যারের ক্লাস মানেই হান্ড্রেট পার্সেন্ট প্রেজেন্ট। ১৯৭৯ সালে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান ক্লাসের একদিন। সৌম্য দর্শন সদা হাসিমুখ স্যার ক্লাসে ঢুকতেই পিনপতন নীরবতা। স্যারের ছাত্ররা আজ বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মেডিকেল কলেজ ইত্যাদিতে শিক্ষক হিসেবে বা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বা অন্য কোন পেশায় অত্যন্ত সুনামের সাথে আছেন।

স্মরণীয় দিনের স্মরণিকা

শ্রদ্ধেয় মিহির স্যারের অবিস্মরণীয় কীর্তি কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পুনর্মিলনী’৯৩ এর স্মরণিকা সম্পাদনা করা। এটি প্রকাশ করেছে ৬০ বৎসর পূর্তি ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পুনর্মিলনী উদযাপন পরিষদ ’৯৩। সম্পাদকীয় এর মধ্যে স্যার লিখেনঃ ‘এই মহতী পুনর্মিলনী উৎসবের আয়োজক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র সমৃদ্ধ সুযোগ্য বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদ ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী, সাথে আছে প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের কাফেলা। পুনর্মিলনীর স্মৃতিকে ধরে রাখার প্রয়োজনে একটি স্মৃতিচারণমূলক ‘স্মরণিকা’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। প্রায় দুই যুগ ধরে ঐ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মহান ব্রত নিয়ে সংশ্লিষ্ট থাকার অপরাধে এই মূল্যবান স্মরণিকা সম্পাদনার দায়িত্ব আমার ওপর বর্তায়। আমার সামান্য জ্ঞানগুণের শতগুণে তেজোদ্দীপ্তরূপে বিকশিত প্রাণপ্রিয় ছাত্রছাত্রীদের আবার আমার সান্নিধ্যে মহাকলরবে দেখতে পাবোসেই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে সম্পাদনার গুরু দায়িত্ব মাথায় নিয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, এ কাজ কতো দুরূহ’। সময়ের স্বল্পতা, আর্থিক দৈন্যতা, পারিপার্শ্বিক অস্থিরতা এবং বিবিধ প্রতিকুলতার বাধা ডিঙ্গিয়ে মিহির স্যার স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং সহযোগীদের নিয়ে একটি মননশীল নিখুঁত স্মরণিকা (জনাব এম এ মোতালেব চৌধুরী, স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র, ইউনিক কমোডিটিজ, চট্টগ্রাম এর অকৃপণ সহযোগিতায়) প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন।

মিহির স্যারের মহতী সৃজনশীলতা চিত্তের উৎকর্ষতা ও উদার চিন্তার ফসল ‘অনন্ত ভাবনা’: শ্রদ্ধেয় মিহির স্যারের লেখা একটি অসাধারণ বই ‘অনন্ত ভাবনা’ যা তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় ছাত্রছাত্রী/শিক্ষার্থীদের উৎসর্গ (সমর্পণ) করেছেন। স্যারের ভাষায়, ‘আমি আজীবন একজন বিজ্ঞানের ছাত্র এবং পেশাগত ভাবে বিজ্ঞানের শিক্ষক। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে নানা বিজ্ঞ জ্ঞানীগুণী সহকর্মী ও সংগঠনের সাহচর্যে অনুকূল পরিবেশের উদ্ভব হয় এবং বিভিন্ন সভাসেমিনারে বক্তব্যের মাধ্যমে মতামত ও অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ হয়। কাটিরহাট এলাকার গুণীজন, যাঁরা আমজনতার শিক্ষাদীক্ষার সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এবং প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন আনুকূল্যের মাধ্যমে আমাকে লেখায় উদ্বুদ্ধ করেছেন; তাঁদের সেই সোনালী স্মৃতির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ ও শ্রদ্ধাশীল’।

স্যারের বইয়ে সন্নিবেশিত প্রবন্ধগুলো হলো : এসো গণিতের রাজ্যে, খাদ্য ও পুষ্টি, তোমার দেহ, অলস মুহূর্তের সংলাপ, সুস্থ দেহ সুস্থ মন, বিজ্ঞানুরাগী রবীন্দ্রনাথ, জাতীয় কবি নজরুল। শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধে আছে : শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক, জাতীয় উন্নয়নে মাধ্যমিক শিক্ষার গুরুত্ব, শিক্ষা একটি সমন্বিত কার্যক্রম, শিক্ষা পরিবেশে সংকট, বাংলা বর্ণ রহস্য। এরপর রয়েছে কাটিরহাট জনপদে শিক্ষা প্রসারে দুই মহানায়ক আলহাজ্ব আব্দুল অদুদ সেরেস্তাদার (১৮৭৯১৯৫৩) ও আলহাজ্ব আব্দুল মন্নান বিএ, আরো লিখেছেন ডাক্তার মাহমুদুল হক (১৯২০১৯৯৮) স্মরণে, শিক্ষানুরাগী আলহাজ্ব নুরুল হক চৌধুরী (১৯২৫২০০৪)। প্রবন্ধের মধ্যে এই শেষ লেখাটি (শিক্ষানুরাগী আলহাজ্ব নুরুল হক চৌধুরী) সাধু ভাষার নিপুণতায় মিহির স্যার অতি মনোরমভাবে রচনা করেছেন।

নিজেকে একজন শিক্ষাকর্মী আখ্যায়িত করে যেভাবে প্রাঞ্জল ভাষায় শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় শিক্ষা দরদী দানবীর ব্যক্তিদের পিতৃতুল্য মর্যাদায় মিহির স্যার উপস্থাপন করেছেন, তা সত্যিই অতুলনীয়। স্যারের বই লেখার মাধ্যমে তাঁদের অর্থাৎ ঐ কর্মবীরদের কর্মপরিধি আরো বিস্তৃত পরিসরে যুগযুগ ধরে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে। অত্যন্ত মেধাবী শ্রদ্ধেয় মিহির বাবুর গবেষণামূলক মূল্যবান প্রবন্ধ সমূহ রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী অনুষ্ঠান, শিক্ষা বিষয়ক সেমিনার, খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান সেমিনার সহ বিভিন্ন আলোচনা সভা/সেমিনারসিম্পোজিয়ামে মূল প্রবন্ধ হিসেবে সেই সময় পঠিত হয়। স্কুল বার্ষিকী উদ্গম, বিজ্ঞান সাময়িকী এবং ছিন্নমূকুল, পদক্ষেপ ইত্যাদি বিভিন্ন ম্যাগাজিনে তাঁর প্রবন্ধ, কবিতা প্রকাশিত হয়।

অনন্ত ভাবনাএর শেষাংশে স্থান পেয়েছে চল্লিশটি লিমেরিক। প্রতিটি পাঁচ লাইন এবং স্যারের ধর্মীয় অনুভূতি সহ বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের ফসল। প্রতিটিতে শিরোনাম যোগ করে এগুলোকে মিহির স্যার আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। শিক্ষাগুরু মিহির বাবুর জ্ঞানগর্ভ খনি থেকে উত্তোলিত গুরুত্বপূর্ণ অর্থবহ লিমেরিকগুলো শিক্ষার্থীদের জীবন গঠনের দিশা স্বরূপ।

কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের আলোচনা সভায় অনেক তরুণ শিক্ষক মিহির বাবু স্যারের কাছে শিক্ষক হিসেবে তাঁর সাফল্যের রহস্য জানতে চান। তিনি মৃদু হেসে জবাব দেন, ‘কোনই রহস্য নাই। আপন কাজকে সম্মান করতে হবে, ভালোবাসতে হবে, আন্তরিক হতে হবে। ছাত্রদের প্রত্যেকের প্রকৃতি আলাদা আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে, তদনুযায়ী পাঠদান করতে হবে। বিষয়টির প্রতি আন্তরিক ও একাগ্র হলে, মনোযোগী ও একটু সৃজনশীল হলে কাজটি সহজ’।

মিহির বাবু স্যার গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখ ভোর রাতে কলকাতায় চিকিৎসাধীন থাকাকালীন মৃত্যুবরণ করেন। স্যারের মৃত্যু সংবাদ সকল পত্রিকায় ছবি সহ প্রকাশিত হয়। মৃত্যুর পরেও শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে প্রিয় স্যার সম্পর্কে লিখেছেন। শিক্ষা বিষয়ক পূর্বে ধারণকৃত ও প্রচারিত টিভি সাক্ষাৎকার শেয়ার করেছেন অধ্যাপক পংকজ দেব অপু।

তথ্যপঞ্জী : ১। স্মরণিকা : কাটিরহাট হাই স্কুলের ৬০ বছর পূর্তি এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থী পুনর্মিলনী ’৯৩। সম্পাদকমিহির কান্তি শীল। ২। অনন্ত ভাবনা মিহির কান্তি শীল। প্রকাশকাল : সেপ্টেম্বর ২০১১, চট্টগ্রাম।

লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, মহিলা কলেজ, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধসন্দ্বীপ নদী বন্দর : দ্বীপবাসীর প্রত্যাশা
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে