সবুজ পাহাড় আমাকে বার বার ডাকে, দূরের ওই নীল আকাশ তাকিয়ে থাকে এক গুচ্ছ মেঘ নিয়ে আমার অপেক্ষায়, আমাকে সবুজ পাহাড়ের ভেতর নিয়ে যাবার জন্য: তাইতো ছুটে গিয়েছিলাম, সুরম্য পাহাড়মালায় মেঘেরা উড়ে উড়ে ভেসে ভেসে যেখানে বেড়াচ্ছিল, যেখানে আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমিয়ে পড়ে, পাহাড়ের কত নীচে মেঘবালিকারা ভোরে ঘুমিয়ে থাকে সাগরের উর্মিমালার মতো। আর পাহাড়ভেদ করে সূর্য উদিত হলেই আস্তে আস্তে জেগে উঠে মেঘেরা ঘন কুয়াশার চাদর গুটিয়ে। সুপ্রিয় পাঠক বলছিলাম লামার মিরিঞ্জা ভ্যালির গল্প। এই পাহাড়ে যখন এই বর্ষায় যাচ্ছিলাম, নিস্তব্ধ বুনোপথে দুপাশে কেবল সবুজের অবারিত মূুর্চ্ছনা। এমন নিরিবিলি নিস্তব্ধ পথ পাড়ি দিতেই আমার দার্জিলিং, সিকিম আর লাচুং ট্রিপের কথাই মনে পড়লো! যেনো ‘দেখা হয়নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দুর মতোই। আসলেই তো মিরিঞ্জার কিছু কিছু জায়গা দার্জিলিং, সিকিম আর লাচুং এর ফ্লেভার পেলাম। তবে সেখানে প্রকৃতিকে ধ্বংস না করেই তারা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য উপভোগের সব ব্যবস্থাই করে রেখেছে। পথের দুপাশে ফুল আর ফুল। আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কাকে বলে, এসব দেশে না গেলেই কোনো ধারণাই হবে না। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম মানেই পাহাড়! আর পাহাড়ের সাথে বনভূমি এবং মেঘের মিতালী যেনো অনিবার্য। কোনো এক কবি বলেছিলেন, যেখানে শহরের কোলাহল শেষ, সেখানেই পাহাড়ের নীরবতার গল্প শুরু। কাজেই একবার যদি কেউ পাহাড়ের প্রেমে পড়ে, শহরের কৃত্রিম আলো তার আর ভালো লাগবে না। লামা উপজেলা থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে মিরিঞ্জা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২০০ ফিট উচ্চতায় মিরিঞ্জা পাহাড়। বান্দরবান জেলা প্রশাসন ও লামা উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মিরিঞ্জার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে নির্মাণ করা হয়েছে মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্স। এই পাহাড়ের দক্ষিণ পাশে টাইটানিক জাহাজের আদলে নির্মিত ভাস্কর্য পর্যটকদের নজর কাড়ে। এই পাহাড়চূড়া থেকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখার সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। নীল আকাশে মেঘের আনাগোনা, নীচে ছোট ছোট পাহাড়মালার খাঁজে খাঁজে টং আর মাচাং ঘরে ত্রিপুরা আর ম্রো আদিবাসীদের নিবাস। এখানে ‘গিরিদ্বার’ আর ‘বনরত্না’ নামের রেস্ট হাউস রয়েছে। এসব ছাড়াও মিরিঞ্জাতে এখন গড়ে উঠেছে অনেক ট্যুরিস্ট স্পট। লামা ফেলে মিরিঞ্জায় প্রবেশ করতেই পাহাড়ের পাদদেশে কিংবা পাহাড়চূড়া থেকে অনেক নীচে নামতে নামতেই সবুজ গাছপালা আর বিস্তীর্ণ বনভূমির আড়ালে আবডালে গড়ে উঠেছে নিরিবিলি পরিবেশবান্ধব নানান পর্যটন স্পট। আমি অং সিং দাদার আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম সদ্য নির্মিত স্পট ‘মেঘ মাচাং’–এ। মিরিঞ্জা বাজার থেকে এখানে যেতে কিছু পথ পাড়ি দিতে হয়। এই রাস্তার নির্মাণকাজের প্রক্রিয়া শেষের দিকে জানালেন মং সিং দাদা। যেহেতু বর্ষাকাল, তাই এই রাস্তা যেমন দুর্গম, তেমনি পিচ্ছিল! একেবারে খাড়া পাহাড় থেকে কত এঁকেবেঁকে নীচে নামতে হয়, নামতে নামতে আর পথের শেষই হচ্ছিল না। রাস্তা এতো খারাপ হবার কারণ হলো আগের রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে রাস্তা যান চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। একদিকে রাস্তা ভাঙ্গা আর কর্দমাক্ত, অন্যদিকে মাথার উপরে মেঘভাঙ্গা সূর্যের কি তেজ! হাতে লাঠি নিয়ে ট্র্যাকিং করেই এগুচ্ছি। এগুতে এগুতেই বাইক নিয়ে নিজাম এসে দুজনকে বাইকে করে নিয়ে গেলো। আমি বাইকে অভ্যস্ত না, লাঠি ভর করেই অনেক কষ্টে অবশেষে এসে পৌঁছালাম মেঘ মাচাং–এ। তবে দু’পাশে নিবিড় বন জঙ্গল, গাছপালার মৃদুমন্দ সমীরণ আমার প্রচণ্ড ক্লান্তিকে ধুয়ে মুছে নিমেষেই শীতল করে দিল। আর মেঘ মাচাং–এ গিয়েই এর অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর নির্জনতায় আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম।পাহাড়চূড়ায় নান্দনিক এক রিসোর্ট ‘মেঘ মাচাং’। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ কিলোমিটার উচ্চতায় সবুজ বনভূমি আর পাহাড়মালার অপূর্ব মেলবন্ধনে নির্মিত। রিসোর্টের অদূরে উঁচুনিচু পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে কুমারীর বেণীর মতো আনমনে বয়ে চলেছে মাতামুহুরী নদী। পুরো লামার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই রিসোর্টে বসেই উপভোগ করা যায়। এখানে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ছোট ছোট মাচাং ঘর, পুল, ফুলের বাগান, ওয়াচ টাওয়ার আর তাঁবুতে রাতযাপনের ব্যবস্থা আছে। শতভাগ নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা ‘মেঘমাচাং ‘পর্যটকদের হাতছানি দেবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রাকৃতিক জীব বৈচিত্র্যে ভরা শতভাগ পরিবেশবান্ধব রিসোর্ট ‘মেঘমাচাং’। সীমাহীন নির্জনতা যে কোনো মানুষকে কল্পনার রাজ্যে নিয়ে যাবে মেঘের পাখায় ভর করে। কি বিচিত্র এই পৃথিবী! সৃষ্টির কি সৌন্দর্য, তা এমন পরিবেশে না গেলে বোধগম্য হয় না যেন। আমি মেঘমাচাং–এর বাইরে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির এই অনাবিল রূপমাধুরী অবলোকন করছিলাম। এই কড়া রোদ, আবার ঘন কালো মেঘে সূর্যের আলো উধাও, মেঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। খন্ড খন্ড টুকরো মেঘমালা! আমি কালিদাসের বিরহী যক্ষপ্রিয়াকে যেনো কাছ থেকেই দেখলাম। রবীন্দ্রনাথের কবিতা মনে পড়লো।
তিনি কালিদাস কে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কবিবর, কবে কোন বিস্মৃত বরষে, কোন পূর্ণ আষাঢ়ের প্রথম দিবসে, লিখেছিলে মেঘদূত, মেঘমন্দ্র শ্লোক? এরই মাঝে ব্লগারদের পদচারণা,কেউ পরিবার নিয়ে, কেউবা কাপল। কেউ ছবি তুলছে, কেউ লাইভ দিচ্ছে। লামার সাংবাদিক রফিক মেঘমাচাং এসে আমাদের সঙ্গ দিল।
এর সাথে গল্পেগুজবে দুপুর হয়ে এলো। হঠাৎ মেঘেরা জমাটবদ্ধ হয়ে যেনো ক্ষেপে উঠলো। এখনি নামবে ঝমঝমিয়ে। আর বারিপাত হলেই আমাদের ফিরে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। তাই মেঘমাচাং এ শিল্পী ফারুক আর মং সিং এর আপ্যায়নশেষে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম মেঘমাচাং–এর মনোহর দৃশ্যপট ছেড়ে। ভাগ্যিস একটা পিকআপ ভ্যান এসেছিল নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে। সেই বাহনে চেপে শক্ত হাতে লোহার রডের হাতল ধরে বসেছিলাম। সেই বাহনই আমাদের মহা ঝাঁকুনি দিতে দিতেই তরতর গতিতে মেঘমাচাং–এর ১৫০০ ফিট থেকে নিয়ে এলো মিরিঞ্জায়।আমাদের গাড়ি সেখানেই অপেক্ষমান ছিল। এলো ঝুম বৃষ্টি। মিরিঞ্জার সবুজ পাহাড় তখন অন্য এক ক্যানভাসে চেতনায় ভর করলো। রফিকের সৌজন্যে মিরিঞ্জা রেস্ট হাউজে রিফ্রেশ হয়ে গাড়িতে চাপলাম।
পড়ন্ত বেলা,পাহাড়ি নির্জন পথ বৃষ্টিস্নাত। পত্রপল্লবে সবুজের মূর্চ্ছনা। পোকামাকড় আর ঝিল্লির সুর, বনমোরগের গান খরগোস, তক্ষক আর কাঠবেড়ালির ছোটাছুটি চোখে পড়বেই। আর পাহাড়মালায় যেনো সবুজের গালিচাপাতা। বড় বড় পাহাড়্গুলো যেনো এক–এক জন মুনিঋষি! গভীর ধ্যানে মগ্ন। আমার ইচ্ছে করছিল, ফিরে গিয়ে ওদের সাথে ধ্যানে বসি, কিন্তু পোস্ট মাস্টারের রতনের কথা মনে পড়লো, রতন বলেছিল দাদাবাবু, আমায় সাথে নেবে? উত্তর ছিল, সে কি করে হবে! বলে তিনি বেড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু বার বার রতনের কথা মনে পড়ছিল। তাঁর একবার ইচ্ছে হয়েছিল ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুতকারিণী এই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি। কিন্তু, তখন ঘাটে নৌকা লেগেছে, পালে হাওয়া বইছে,নদী কূলের শ্মশান অতিক্রম করিয়া নৌকা তরতর গতিতে এগিয়ে চলছে। তাহার মনে হইলো, ফিরিয়া ফল কি? পৃথিবীতে কে কাহার?