এজাহার, চার্জশিট, তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া ১৬১ ধারার জবানবন্দি, এমনকি আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি অনুসারেও মনোয়ারা বেগম একজন ভিকটিম। কিন্তু বিচার শুরু হওয়ার পর সাক্ষ্য দিতে এসে সেই তিনি আদালতকে জানালেন, আসামিদেরকে তিনি চেনেন না, অনেক আগের ঘটনা। এমনকি ঘটনা সংক্রান্তেও কিছু জানেন না। গতকাল চট্টগ্রামের মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের ১১ ও ১২ ধারার একটি মামলায় হাজির হয়ে মনোয়ারা বেগম এ সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত তাৎক্ষণিক মনোয়ারা বেগমকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নাছিমা বেগম নামের এক নারী বায়েজিদ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার এজহারে তিনি উল্লেখ করেন, ৪ বছর পূর্বে তার স্বামী মারা যান। ষোলশহর এলাকায় বসবাস করেন। বাবা ও মা তাকে পুনরায় বিয়ে দেওয়ার কথা বললে তিনি তার পূর্ব পরিচিত লিটন বড়ুয়া ও মো. আরাফাত হোসেনকে বিষয়টি জানান। তখন এ দুজন তাকে বলেন যে, তাদের কাছে ভালো একজন পাত্র রয়েছে। একপর্যায়ে লিটন ও আরাফাত কৌশলে তাকে নগরীর বায়েজিদের রৌফাবাদ কলোনি খালপাড় এলাকার কাঞ্চন মিয়া নামের একজনের বাসায় নিয়ে যায় এবং কাঞ্চনকে পাত্র হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ সেপ্টেম্বর ও ১৪ সেপ্টেম্বর বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে কাঞ্চন মিয়া তাকে ধর্ষণ করেন।
মামলার এজাহারে আরো বলা হয়, ১০ সেপ্টেম্বর রোকসানা আক্তার শারমিন এবং ১৭ সেপ্টেম্বর মনোয়ারা বেগমকে চাকরি বা কাজের প্রলোভন দেখিয়ে উক্ত কাঞ্চনের বাসায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখে লিটন বড়ুয়া। একপর্যায়ে লিটন, কাঞ্চন, আরাফাত ও সাইফুল ইসলাম নামের অপর একজন রোকসানা ও মনোয়ারাকে মারধর ও ভয়ভীতি দেখিয়ে পতিতার কাজ করতে বাধ্য করে। নাছিমা বেগম মামলার এজাহারে আরো বলেন, একপর্যায়ে ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি সেখান থেকে কৌশলে পালাতে সক্ষম হন এবং পুলিশকে ঘটনার বিষয়ে জানালে পুলিশ কাঞ্চনের বাসা থেকে রোকসানা ও মনোয়ারা এবং সাইফুল ইসলামকে থানায় নিয়ে যায়। আদালত সূত্র জানায়, থানা থেকে তাদেরকে আদালতে পাঠানো হলে সেখানে রোকসানা ও মনোয়ারা দুজনই জবানবন্দি দেন।
জবানবন্দিতে মনোয়ারা বেগম উল্লেখ করেন, আসামি লিটন কাজ দেওয়ার কথা বলে তাকে কাঞ্চনের বাসায় নিয়ে যান। সেখানে লিটন ও কাঞ্চন দুজনই তাকে ধর্ষণ করেন। এবং অন্তত ১০ জন লোকের সাথে খারাপ কাজ করতে বাধ্য করেন। আসামিরা পতিতাবৃত্তির সাথে জড়িত মর্মেও তখন আদালতকে জানান মনোয়ারা বেগম।
ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, ঘটনার পর মনোয়ারার আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে প্রদত্ত স্বাক্ষরের সাথে আজকে (গতকাল) ট্রাইব্যুনালে প্রদত্ত স্বাক্ষ্যরের মিল পরিলক্ষিত হয়েছে। এমনকি উক্ত সাক্ষী ডাক্তারি পরীক্ষাকালে প্রদত্ত দলিলসমূহ অর্থাৎ ডাক্তারি পরীক্ষার সম্মতিপত্র, রেডিওলজিক্যাল ও ইমেজিং পরীক্ষার প্রতিবেদনে সমরূপ স্বাক্ষর প্রদান করেছেন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, সাক্ষী মনোয়ারা বেগম আইনি প্রক্রিয়ার অপব্যহার করে ট্রাইব্যুনালে ‘মিথ্যা’ সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। যা মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০০২ এর ১৫ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি মো. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, নাছিমা বেগমের দায়ের করা মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের মামলায় ২০২২ সালের ৬ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজকে (গতকাল) প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাদী নাছিমা বেগম ও ভিকটিম মনোয়ারা বেগমকে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়েছিল। নাছিমা বেগম হাজির হননি। মনোয়ারা বেগম হাজির হয়ে আসামিদের উপস্থিতিতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। কিন্তু তিনি ‘মিথ্যা’ সাক্ষ্য দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি আসামিদেরকে চেনেন না, অনেক আগের ঘটনা। এমনকি ঘটনা সংক্রান্তেও কিছু জানেন না বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কোনো ধরনের জবানবন্দি দেননি এবং আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামিদেরকে চেনেন না বলেও জানান তিনি। এমন অবস্থায় মনোয়ারাকে বৈরী সাক্ষী ঘোষণা করা হয়েছে। পিপি বলেন, ‘মিথ্যা’ সাক্ষ্য দেওয়ার ঘটনায় মনোয়ারাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হবে।