মা যেন এক পরশপাথর

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২০ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

.সমাজে ভাইরাল হওয়া বিষয়গুলো যা আমাদের শিক্ষা সমৃদ্ধির নগ্নতাকে প্রকাশ্য করে দেয়, বিবস্ত্র করে দেয় সমাজ ও সভ্যতাকে, তা নিয়ে লিখতে গেলে অনেক যন্ত্রণা হয়। বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হয় ক্রমাগত। সন্তান, শিক্ষার্থী, পিতা-মাতা, বন্ধু-স্বজনের সামনে আমাদের যুবসমাজের আদিম উল্লাসে মেতে ওঠার ভীতিকর দিক নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করতে বড় বাঁধে। সভ্য সমাজের কাগজে, টেলিভিশনে, সভা সমিতিতে, পথে ঘাটে দিনরাত একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা, পুনরালোচনা। উঠতি বয়সীদের মুখে কথা নেই। চেয়ে চেয়ে দেখে। ওদের মনস্তত্ত্ব বোঝার অবকাশ নেই। এ-কেমন অসুস্থতা! কোন বিকৃত পথে চলেছে সমাজ!
দুহাজার বিশের মার্চে বাংলাদেশের সীমানায় কোভিড হানা দেওয়ার খবরে আতংকিত হলেও একটা বিষয় ভেবে স্বস্তি লাগছিল যে, দানব পিশাচ হায়েনা শকুনেরা শিকারের লোভে ওঁৎ পেতে থাকবেনা পাহাড় থেকে সমতলে, বাংলার আনাচে কানাচে । সুযোগ বুঝে হামলে পড়বেনা অরক্ষিত নারীজাতির ওপর। আমাদের মেয়েদের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হয়েই যেন পৃথিবীতে এসেছে করোনা নামের অণুজীব। করোনা শুদ্ধিকরণে নেমেছে বলেও অনেক নামজাদা পণ্ডিত মন্তব্য করেছিলেন সেই সময়ে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ পই পই করে বলে চলেছেন, সঙ্গনিরোধই করোনার হাত থেকে বাঁচার প্রধানতম উপায়। ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে চলতে হবে সমাজের সকলকে। যত মানসিক বিকৃতিই থাকুক না কেন, প্রাণের মায়া কার না আছে? এবার নিশ্চয় হাত গুটিয়ে নেবে হায়েনারা। কিন্তু সব স্বস্তি নিমিষে উবে যায় একের পর পাশবিকতার খবরে। সেপ্টেম্বর শেষে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে গত নয় মাসে মোট ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা- ৯৭৫। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ জুড়ে যেসব তাণ্ডবের খবর এসেছে, এবং বিরতিহীনভাবে যেভাবে উর্ধগতি লাভ করে চলেছে, তাতে ইতোমধ্যে এই সংখ্যা চার অংক ছুঁয়ে ফেলেছে, একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এই গণনার কী শেষ নেই? আমার সোনার বাংলাদেশ আজ ধর্ষকদের স্বর্গরাজ্য। তবু আকাশ ভেঙে পড়ছেনা মাথার ওপর। আমরা আজও শ্বাস নিচ্ছি। প্রবৃদ্ধির সাফাই গাইছি। উন্নয়নের বড়াই করছি।
অশিক্ষা থেকেই যাবতীয় বর্বরতা অন্ধকারের জন্ম- পৃথিবীতে মানব বসতির ছয় মিলিয়ন বছরের ইতিহাস তাই বলে। অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করার জন্য সভ্যতার আবির্ভাব হয়, তা প্রায় ছ’হাজার বছর আগের কথা। শিল্পায়নের হাত ধরে আধুনিকতার যাত্রা শুরু উনিশ শতকের গোড়া থেকে। দুশো বছর পার হল মাত্র। এত স্বল্প সময়ে এত অর্জন মানবজাতির! বাংলায় তার ঢেউ এসেছিল দেরী করে। তবে শিক্ষার হার ও অর্থনৈতিক বিপ্লবের দিক থেকে উন্নত বিশ্বের অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গিয়েছে আমাদের বাংলাদেশ। শতকরা সত্তরের অধিক শিক্ষিত নাগরিকের দেশে এমন আদিম বর্বরতা চলছে একুশ শতকের মহাপ্রযুক্তির যুগে। তবে কী শিক্ষিত হওয়ার মানে মানুষ হওয়া নয়? আমাদের শিক্ষা আলো ছড়ায়না, অন্ধকার দূর করেনা। কেন তবে এত আয়োজন? পৃথিবীর আর কোথাও বিএ, এমএ পাস ধর্ষক আছে কী না জানা নেই। আইন ও সালিশ কেন্দ্র কেবল ধর্ষণের প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সমগ্র বাংলাদেশে কত ধর্ষক আছে তার পরিসংখ্যান তৈরি করে সবিস্তারে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করাও আবশ্যক।
প্রতি ঘটনার পর গণমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। পর মুহূর্তেই পর্দায় ভেসে নতুন খবর। অণুজীবের হামলায় মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের সংখ্যা। মহামারীকে হার মানিয়ে দেওয়া হায়েনা পিশাচেরা নির্বিকার। কোমরে দড়ি, হাতে হাতকড়া, তবু ভয় ডরের চিহ্নমাত্র নেই চোখেমুখে। লজ্জা অনুতাপের লেশমাত্র নেই। ওরাতো আমাদেরই সন্তান। সবার মা’ই নয়টি মাস গভীর মমতায় ওদের বহন করেছিল আপন জঠরে। নিজের ভেতরে প্রাণের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার পর স্বপ্ন বোনার পালা শুরু, যা তাকে সব যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার কালে দেবশিশু যখন আকাশ বাতাসকে জানিয়ে আর্তচিৎকার করে ওঠে, পৃথিবী তখন হেসে ওঠে । মায়ের কোলে চাঁদ হাসে। সাত রাজার ধন মানিক হাত পা নাড়তে শেখে, বোল ফোটে মুখে। সব ঘরের গল্পই এক। তবু যেন ভিন্ন, বিচিত্রতায় ভরা। বড় বড় হাত পা গজানোর পর মায়ের পাশে বসে মায়ের আনন্দ বেদনা, স্বপ্ন-যন্ত্রণার গল্পগুলো আমরা কী আর শুনতে চাই?
মহামনীষীগণের আত্মকথা, কী দেশে কী বিদেশে, কী পূর্বে কী পশ্চিমে- মায়ের কথায় ভরা। মায়ের আদর, মায়ের যন্ত্রণা, মায়ের সংগ্রাম ভিত গড়ে দিয়েছিল তাঁদের জীবনের, তাঁদের খ্যাতির। কারও মা-ই কিন্তু নামীদামী নারী ছিলেননা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও ছিলনা তাঁদের। কেমন করে সোনা ফলেছে তাঁদের হাতে!
যে সন্তান মাকে ভালোবাসে সে কখনও অপকর্ম করতে পারেনা, অপরাধবৃত্তিতে জড়াতে পারেনা। মা সে ঘুঁটে কুড়ানিই হোক, কী রাজরানী। মা এক পরশপাথর। মাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারলে কোন অপশক্তির সাধ্য নেই সন্তানকে বিপথে নেওয়ার। জীবনের তাগিদে জনমভর মাকে জড়িয়ে থাকার সুযোগ নেই, তবে মায়ের মুখখানি চিরকালের জন্য স্থিরচিত্র করে বসিয়ে রাখা যায় বুকের ভেতর, পৃথিবীর যে গোলার্ধেই থাকিনা কেন, যত বড়ই হইনা কেন। ব্যস্তসমস্ত জীবনসূচীতে ক্ষণকালের জন্য সেই ছবিতে হাত বোলালে, মায়ের সঙ্গে কথা বললে শান্তি আনন্দ কেবল নয়, শক্তিও পাওয়া যায়। এ শক্তি সত্যকে বুকে নিয়ে লড়ার শক্তি যোগায়, মিথ্যাকে পরাজিত করার সাহস যোগায়, অশুভ শক্তির হাতছানিকে উড়িয়ে দেওয়ার মনোবল যোগায়।
মা মানেই কিন্তু ‘সুপার হিরো’। প্রতিটি মা’-ই একেক জন দার্শনিক। শিক্ষকতো বটেই, এমনকি যদি তিনি নিরক্ষরও হন । ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ র মতো মা পথ দেখিয়ে চলেন সন্তানকে জীবনভর। কিন্তু একুশ শতক আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে মায়ের ছায়ার নিচে আর নয়। পরিবার গোল্লায় যাক; পাতানো বড় ভাই আর নেতাদের জীবনাদর্শ করে নিতে পারলে আখেরে লাভের শেষ নেই। দ্রুততম সময়ে টাকা কড়ি, বাড়ি গাড়ি, ক্ষমতা প্রতিপত্তি হাতের মুঠোয় আনতে হলে নেতার বাধ্যগত হতে হবে। ধরাকে সরা জ্ঞান করার হাতেখড়ি হয় এভাবেই। এরপর আর পেছন পানে তাকানোর সময় নেই, প্রয়োজনও নেই। শিক্ষককেই যখন চাকরি কিংবা সম্মান বাঁচানোর জন্য ছাত্রের দয়ার ওপর নির্ভর করে বসে থাকতে হয়, তখন বাদবাকি সমাজের ওপর ছড়ি ঘোরানোতো চলতেই থাকবে। সমাজে চলমান অস্থিরতা ওদের এই বার্তা দেয় যে অপরাধ করলে ভয়ের কিছু নেই। সুরক্ষার সব ব্যবস্থা করা আছে। অতঃপর কার সাধ্য ওদের থামায়!
এমনি করেই কী এগিয়ে যাবে আমাদের সমাজ? সবাই কী কেবল প্রকাশ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের ধিক্কার জানিয়ে যাবে? ওদের জন্মদাতা, অন্তরালের অপশক্তিকে চিহ্নিত করা হবেনা? যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ঘৃণা অপরাধীদের বিন্দুমাত্র তাড়িত করেনা। ভয় সঞ্চার করেনা ওদের হৃদয়ে। ভুল থেকে শিক্ষা নেয়না কেউ, বরং অনুপ্রাণিত হয় অনেকে। জড়িয়ে পড়ে নতুন উদ্যমে। অপরাধ বান্ধব সমাজে ওদের উত্থান ও অগ্রগতি কণ্ঠরোধ করে সাধারণ জনগোষ্ঠীর।
আশার কথা। নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী যুবকদের বিপরীতে ‘শান্তি বাঁচাতে লড়ার’ শক্তিও রাখে আমাদের যুবকেরা। ওরাই আমাদের নতুন সূর্যোদয়ের গান শোনাবে। কিন্তু পথভোলাদের পথে আনার কোন পথই কী খোলা নেই? মৃত্যুদণ্ডই কী একমাত্র সমাধান? চাঞ্চল্যকর রিফাত হত্যামামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত তরুণ হাসিমুখে রেরিয়ে এসেছে আদালত থেকে- এই তো সেদিনের কথা। ভারতে নির্ভয়া হত্যামামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত অপরাধীরা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অনুতপ্ত হয়নি। পৈশাচিকতা অন্তরকে এমনভাবে দগ্ধ করে ফেলে যে মৃত্যুভয় ওদের স্পর্শ করেনা। অনেকের কাছে এটাই নায়কোচিত বলে মনে হয়। ফলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার যে বিচার, তার আসল উদ্দেশ্যই অর্জিত হয়না।
আইন ও বিচারকে প্রভাবিত না করে, স্বাধীনভাবে চলতে দিয়ে পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির খোলনলচে পাল্টে দিতে হবে আমাদের। উন্নতি ও সাফল্যের পেছনে ঊর্ধ্বশ্বাসে না ছুটে ‘ধর্মেতে ধীর, কর্মেতে বীর’ হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে আমাদের সন্তানদের। ওদের বোঝাতে হবে নেতা বা পাতানো বড় ভাই নয়, ফিরে যেতে হবে মায়ের কাছে। মাতৃজাতির প্রতি সম্মানের হাতেখড়ি দিতে হবে পরিবার থেকেই। মায়ের আলো, মায়ের শক্তি, মায়ের মর্যাদা ওদের সুস্থ জীবনের প্রেরণা যোগাবে। কাজটা সহজ নয়, সময় সাপেক্ষও। কিন্তু বড় অভিযানের যাত্রা শুরু একটি মাত্র পদক্ষেপ দিয়ে- এই আপ্ত বাক্য প্রাণে ধরে সবাইকে যে যার জায়গা থেকে সমাজে মানবিকতা ছড়িয়ে দেয়ার যুদ্ধে নামতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধধর্ষণ রোধে প্রয়োজন আমূল মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক পরিবর্তন
পরবর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা