একজন বিজ্ঞ সন্তান বাবার মনে আনন্দ দেয়, আবার একজন অকৃতজ্ঞ সন্তান মায়ের মনে দু:খ দেয়’–সলোমন। সলোমনের উক্তির মধ্যে ধারণা দেওয়া হয়েছে যে একজন বিজ্ঞ সন্তান বাবার মনে আনন্দ দেয়, আবার একজন অকৃতজ্ঞ সন্তান মায়ের মনে দু:খ দিয়ে থাকে। আসলে উক্তিটির মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত আনন্দ ও কষ্টের কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে একজন বিজ্ঞ সন্তান মা–বাবা উভয়কে আনন্দ দেয়, তেমনি বিপরীত ভাবে একজন অকৃতজ্ঞ সন্তান সমানভাবে মা–বাবা উভয়কেই কষ্ট দেয়। তবে আমাদের সমাজে কিছু লোক আছে যারা প্রশংসনীয় কাজের জন্য সন্তানদের বাপের বেটা বাপের বেটি বলে আহ্লাদিত বোধ নিয়ে সন্তানের প্রশংসা করে। পক্ষান্তরে সন্তানের নিন্দনীয় কাজের জন্য জন্মদাত্রী মাকে নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করতে শুনি। বিষয়টি কিন্তু একপেশে বিচারের মতো মনে হয়। তাই সন্তানের প্রশংসনীয় কাজের জন্য মা–বাবা উভয়ে সমানভাবে গৌরবান্বিত আবার সন্তানের মন্দ ও নিন্দিত কাজের জন্য মা–বাবা উভয়কেই সমানভাবে লজ্জিত ও হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়।
কিছুদিন আগে পিতার ঔরসজাত ও মাতার গর্ভজাত সন্তানের হাতে পিতা মাতার অসহায়ত্বের চিত্র দেখে আমি ‘পিতামাতার আশ্রয় হোক সন্তানের বুকে, বৃদ্ধাশ্রমে নয়’ একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। যে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রবন্ধটি লিখেছিলাম তা ছিল সম্পূর্ণ তিনটি বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তার মধ্যে একটি ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভাগ্য বিড়ম্বিত প্রফেসরের মর্মন্তুদ জীবন কাহিনির বর্ণনা। কৃতঘ্ন ২ পুত্র সন্তান ও ১ কন্যা সন্তান কর্তৃক নিগৃহীত সর্বস্বান্ত হওয়া সেই প্রফেসরের আশ্রয় এখন একটি বৃদ্ধাশ্রমে। কন্যা সন্তান নাকি আমেরিকা প্রবাসী। বড় পুত্র সন্তান নাকি অর্থ এবং বাড়িটি হাতিয়ে নিয়েছে। ছোট সন্তান তাঁর অবসর কালীন পাওয়া গ্র্যাচুয়িটির বড় অঙ্কের অর্থ নিয়ে বৃদ্ধ বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে সোনার হরিণের খোঁজে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেয়। সে সন্তান নাকি সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে একবার দেশে এসে বাবাকে বৃদ্ধাশ্রম থেকে ডেকে নিয়ে মিরপুরের একটি দোকানে বসে তার বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করে। জন্মদাতা পিতা বৃদ্ধাশ্রমে মানবেতর জীবনযাপন করলেও রক্তের তথা স্নেহ ভালোবাসার বন্ধন অসহায় পিতা ভুলতে পারেনি। পিতা তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের হবু স্ত্রীকে দেখতে চেয়েছিলেন। অদৃশ্য কোনো কারণে সে পুত্র বাবাকে তার হবু স্ত্রীকে দেখাতে রাজি হয়নি। এমনটা হতে পারে, পিতা যে বৃদ্ধাশ্রমে সে বিষয়টি তার শ্বশুরকুল বা হবু স্ত্রীর কাছে গোপন রেখেছিল অথবা তার পিতা মৃত বলে ঘোষণা দিয়ে থাকতে পারে।
আরেকজন মা উচ্চশিক্ষিত স্বামী কর্তৃক ডিভোর্স প্রাপ্ত। সন্তান জন্মের কয়েক বছর পর তাঁকে ডিভোর্স দেওয়া হয়। ভদ্রমহিলা উচ্চশিক্ষিত সরকারি উচ্চপদে আসীন ছিলেন। অবসর গ্রহণের পর অসহায় মা, মা–বাবার অর্থে বিদেশে পড়ালেখা করা প্রবাসী পুত্রের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম, হঠাৎ আশায় যেন গুড়ে বালি। বাধ সাধলো কলিজার টুকরো সদৃশ পুত্রের উচ্চশিক্ষিত পুত্রবধূ। সে পুত্রবধূ তো সরাসরি শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে ‘আপনি এখন অবসর গ্রহণ করেছেন, বিদেশে গেলে আপনি হয়তো আর আসতে চাইবেন না’। আপনি বিদেশ গেলে আমি বাংলাদেশে থেকে যাবো।
বিদেশ যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করা সে মায়ের জন্য স্বাভাবিক। দেশে তাঁর ফ্ল্যাট নামের রুদ্ধগৃহ সদৃশ ঘর একাকীত্বের মাঝে এক দু:সহ যন্ত্রণা। অথচ বিদেশে গেলে দেখতে পাবে সাত রাজার ধন মানিক তাঁর একমাত্র সন্তান যাকে বুকের দুধ খাইয়ে, অন্তহীন শ্রম, আদর স্নেহ ও কষ্টার্জিত অর্থের বিনিময়ে লেখাপড়া শিখিয়ে উচ্চশিক্ষিত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এখানেই এখন স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। সন্তান যে এখন তার স্ত্রী এবং শ্বশুর শাশুড়ির হাতের পুতুলের মতো। যেমনটি নাচায় তেমনি নাচে। এখানে পুত্র সন্তানের মায়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ছেলের সংসারে ভুল বুঝাবুঝির অশনি সংকেতের কথা ভেবে অসহায় মা বুকের কান্না বুকে পুষে রেখে নিজ অর্থে বিদেশ যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ এসব পুত্রবধূ, পুত্র এবং তাদের ইন্ধন দাতারা এহেন জন্মদাত্রী মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ কখনো কি হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করে? তারা যেভাবে নিজের সন্তানদের নিয়ে সুখের স্বপ্ন দেখে, ঠিক একই অভিন্ন স্বপ্ন নিয়ে পুত্র সন্তানের পিতামাতা, পুত্রবধূর শ্বশুর শাশুড়ি বিনিদ্র রাত কাটায় নি?
এ রকম হাজারো ঘটনার চিত্র যে দেশের অনেক ঘরে ঘরে। তার খবর আমরা ক’জনই রাখতে পারি? চট্টগ্রামের রাংগুনিয়ার বৃদ্ধ সেলিম মাস্টার দীর্ঘ ৩৫ বছর শিক্ষকতা শষে ২০১২ খ্রিস্টাব্দে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর সরকার প্রদত্ত এককালীন পেনশন, কল্যাণ ভাতা ও সঞ্চয় পত্রের টাকা সহ তাঁর ব্যাংক একাউন্টে জমা হয় ৪২ লক্ষ টাকা। এ বৃহৎ অঙ্কের টাকার উপর লোভদৃষ্টি পড়ে নিজের ঔরসজাত সন্তান নামের কলঙ্ক কৃতঘ্ন দুই কন্যা সন্তানের। তারা উভয়ে পরিকল্পিত ভাবে পিতার সমস্ত অর্থ আত্মসাৎ করে বৃদ্ধ পিতার হার্নিয়া অপারেশনের নাম করে তাঁকে চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী মাঝার সংলগ্ন রাস্তার উপর ফেলে চলে যায়। অনাহারে অর্ধাহারে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে ঢাকার ‘চাইল্ড এন্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ কর্তৃপক্ষ তাঁকে ঢাকায় নিয়ে গেলে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে সেলিম মাস্টারের ঠিকানা এখন ঢাকার সেই বৃদ্ধাশ্রমে। কত নির্দয়, হীন মনোবৃত্তি ও পাষাণ হৃদয়ের কৃতঘ্ন সন্তান না হলে নিজের জন্মদাতা পিতা ও জন্মদাত্রী মাতার প্রতি অমানবিক আচরণ দেখিয়ে এসব কুলাঙ্গার কারো না কারো আশ্রয় প্রশ্রয় ও ইন্দন পেয়ে মা–বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে নিজ সন্তানদের বুকে নিয়ে নিলর্জের মতো দর্পভরে মাথা উঁচু করে অবলীলাক্রমে জৌলুসপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করে চলেছে। তারা নিজ সন্তানদের ভবিষ্যৎ, নিজের চাকচিক্যময় জীবনকে সমৃদ্ধ করতে দিনরাত ব্যস্ত থাকে। তারা তো একটি বারও ভাবে না, আজকের বৃদ্ধাশ্রমের এবং সমাজে ধুঁকে ধুঁকে মরা অবহেলিত মা–বাবারাও এসব সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে অর্থ বিত্ত ব্যয় ও ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে এসব কৃতঘ্ন সন্তানদের পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করার স্বপ্নে বিভোর থাকতেন। দুর্ভাগ্য, অনেকে পড়ালেখা শিখেও কিন্তু সত্যিকার মানুষ হতে পারে না।
যে কোনো সন্তানকে স্মরণ রাখতে হবে, সুকর্ম বা পুণ্য কর্মের ফলশ্রুতিতে পিতার ঔরসে বা মাতার গর্ভে জন্ম নিয়ে মানব সন্তানের মনুষ্য লোকে আবির্ভাব ঘটে। পিতামাতার অপরিমেয় স্নেহ যত্ন ও ত্যাগের মাধ্যমে জন্ম জাত সন্তান বড় হয়ে উঠে। যৌক্তিকতার নিরিখে বলা যায় সন্তানের জীবন গঠনে মাতাপিতার অবদান অপরিসীম এবং যুগপৎভাবে সন্তানরা–ও পিতামাতার প্রতি অপরিশোধ্য ঋণে আবদ্ধ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। পিতামাতা শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত হোক, সন্তানের কাছে তাঁদের প্রধান পরিচয় তাঁরা মাতাপিতা। পিতামাতাকে সম্মানের সাথে হৃদয়াসনে প্রতিষ্ঠিত রাখাসন্তান মাত্রেরই আরাধ্য কর্তব্য। প্রাশ্চাত্য মনীষী রাস্কিনের কথায় মানুষের জীবনে তিনটি প্রধান কর্তব্য হলো ‘সৃষ্টিকর্তার প্রতি কর্তব্য, পিতামাতার প্রতি কর্তব্য এবং মানবতার প্রতি কর্তব্য’। এই তিনটি কর্তব্য প্রতিটি সন্তানের মেনে চলা উচিত। পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ বলেছেন, ‘মাতা পিতার প্রতি উত্তম আচরণ কর তাঁদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাঁদেরকে ‘উফ‘ বলো না এবং তাঁদের সাথে ধমক দিয়ে কথা বলো না। তাঁদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কথা বলো’।(সুরা বনী ঈসরাইল)। রাসুলুল্লাহ (সা🙂বলেছেন ‘ পিতামাতা হলো তোমার জান্নাত আর জাহান্নাম অর্থাৎ তুমি ইচ্ছে করলে তাঁদের খেদমত করে উত্তম আচরণের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করতে পারো, আবার ইচ্ছে হলে তাঁদের অবাধ্য হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করতে পারো (ইবনে মাজাহ মিসকাত)। পিতামাতার অবাধ্যতার জন্য যেমন রয়েছে অভিসম্পাত, তেমনি তাঁদের আনুগত্যের জন্য রয়েছে পুরস্কার।
বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে (অঙ্গুত্তর নিকায়) :‘ মাতাপিতা ব্রহ্মার চেয়েও শ্রেষ্ঠ, তাঁরা পূর্বাচার্য ও আবাহনীয় হিসেবে আখ্যায়িত। ধর্মপদে বুদ্ধের বাণীতে বলা হয়েছে -‘মাতৃভক্তি সুখকর, শ্রমন ও ব্রাহ্মণ (বিমুক্ত পুরুষ) পরিচর্যা সুখকর’। তাই ভক্তি প্রদর্শনপূর্বক মাতাপিতার সেবাযত্নে নিয়োজিত থাকা সন্তানের একান্ত কর্তব্য। পিতামাতা সন্তানের মাথার উপর ছাতা সদৃশ। পৃথিবীতে সন্তানের প্রতি সর্বাধিক স্নেহ, মমতা ও অনুগ্রহ প্রদানকারী ব্যক্তি হচ্ছেন মাতাপিতা। শ্রীমদভগবদগীতায়
বর্ণিত আছে ‘পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই শ্রেষ্ঠ তপস্যা। পিতা সন্তুষ্ট হলে দেবতারাও সন্তুষ্ট হন। বৈদিক শাস্ত্রে এ–ও উল্লেখ আছে ‘জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। খ্রীষ্টধর্মেও মাতা পিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যাদির বিশদ উল্লেখ রয়েছে। মহামঙ্গল সূত্রে ‘বুদ্ধ মাতাপিতার সেবা করাকে উত্তম মঙ্গল বলে আখ্যায়িত করেছেন। বুদ্ধ নির্দেশিত ৩৮ প্রকার উত্তম মঙ্গলের মধ্যে মাতাপিতার সেবা করা অন্যতম উত্তম মঙ্গল।
সকল ধর্মমতে মাতাপিতার অবদান ও ঋণের কথা গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়ে আসলেও আজকালকার সমাজে মাতাপিতারা অনেক সন্তানের হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিগৃহীত হয়ে আসছে। অনেক অকৃতজ্ঞ সন্তান ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পিতামাতার অর্থ সম্পত্তি আত্মসাৎ করে পিতামাতাকে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে অথবা বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য করছে। কৃতঘ্ন সন্তানদের নিষ্ঠুরতার যাঁতাকলে পড়ে অনেক বৃদ্ধ জীবন মৃত মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেকে হয়তো দিন গুনছে কখন বাবা–মার মৃত্যু হলে তাড়াতাড়ি অর্থ সম্পদ ভাগ করে নিতে পারে। অথচ অনেক মা–বাবার সন্তানের টাকা পয়সার কোনো প্রয়োজনও হয় না, তাঁরা চায় বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা সম্ভব হলে তাদের একটু পরিচর্যা যা দিয়ে তাদের পিতামাতা তাঁদের জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করে এসব সন্তানদের মানুষ করার লক্ষ্যে স্বপ্ন দেখতেন। পৃথিবীতে কোনো মা–বাবা শত লাঞ্চিত হয়েও সন্তানের অমঙ্গল চিন্তা করে না, পক্ষান্তরে তাঁদের জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করে সন্তানের জন্য দোয়া ও আশীর্বাদ করে যায়। ঔরসজাত সন্তানদের দিকে তাকিয়ে এসব সন্তানগণ তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও অবহেলার দৃষ্টি পরিবর্তন করে জন্মদাতা পিতা ও জন্মদাত্রী মাতার প্রতি সত্যিকার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে তাদের অবহেলিত মা–বাবার সেবায় এগিয়ে আসুক, এই শুভ প্রত্যাশা হোক সকলের। পিতামাতার পদতলে হোক সন্তানের বেহেশত।
লেখক : প্রাবন্ধিক, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাঙ্গুনিয়া সরকারি কলেজ।