মা-বাবাকে হারিয়েই ফেলল অর্ক ও জুঁই

পটিয়ায় মহাসড়কে ৬ মৃত্যু

পটিয়া ও চন্দনাইশ প্রতিনিধি | বৃহস্পতিবার , ১৪ জুলাই, ২০২২ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

স্ত্রী রূপ্না সেনকে (৩৮) ডাক্তার দেখানোর জন্য গত ১১ জুলাই বিকেলে চন্দনাইশের মোহাম্মদপুর সেনবাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন বিশ্বজিৎ সেন বিষু (৪৮)। পটিয়ায় ডাক্তার দেখিয়ে সন্ধ্যার পর সিএনজি টেক্সিতে বাড়ি ফিরছিলেন। কিন্তু জীবিত নয়, স্বামী-স্ত্রীকে ফিরতে হলো লাশ হয়ে।
গত ১১ জুলাই সোমবার রাত সোয়া ৮টার দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়ার ভাইয়ের দিঘির পাড় এলাকায় দ্রুতগতির একটি বাস তাদের বহনকারী টেক্সিকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান স্বামী-স্ত্রী। এই ঘটনায় তারাসহ প্রাণ হারান ৬ জন। বাসটি কক্সবাজার থেকে আসছিল। গত মঙ্গলবার বিকেলে সেনবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নিহত বিশ্বজিৎ সেন ও তার স্ত্রী রূপ্না সেনকে পারিবারিক শ্মশানে দাহ করে এসেছেন স্বজনরা। তাদের ছেলে দ্বীপ সেন অর্ক (১৬) ও কন্যা অমি সেন জুঁইকে (১২) নিয়ে বাড়ির দাওয়ায় বসে আসেন পিসি, কাকা-কাকিসহ স্বজনরা। এ সময় নীরবতা বিরাজ করছিল সেখানে। মাঝে-মধ্যে কেঁদে উঠছে অর্ক ও জুঁই। তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন পরিবারের সবাই।
বিশ্বজিৎ সেনের ছোট ভাই জিষু সেন জানান, তার বড় ভাই বিশ্বজিৎ চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকায় রিজেন্সি নামে একটি গার্মেন্টসে সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কোরবানির ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন তিনি। আগামী শনিবার কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। মা-বাবাকে হারিয়ে অনাথ হলো অর্ক ও জুঁই। ওইদিন বিশ্বজিৎ ও তার স্ত্রী বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় অর্ক ও জুঁই ঘুমাচ্ছিল। তাই মা-বাবার সঙ্গে শেষ কথাও বলা হয়নি তাদের। একসাথে মা-বাবাকে হারিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিল দুই ভাই-বোন।
উপজেলার কাঞ্চননগর বেগম গুল চেমন আরা একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১০ম শ্রেণীতে পড়ে অর্ক। একই স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে জুঁই। তারা জানায়, দুপুরে ওরা একসাথে ভাত খেয়েছে। মা আর বলবে না পড়তে বস, ভাত খেতে এসো। আমরা কাকে মা ডাকব? কাকে বাবা ডাকব? এ কথা বলতে বলতে কান্না করছিল ওরা।
মহাসড়কে ৬ মৃত্যু : পটিয়ায় ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় মহাসড়কে ঝরল সিএনজি টেক্সির যাত্রী স্বামী-স্ত্রীসহ ৬ জনের প্রাণ। নিহতদের মধ্যে চন্দনাইশের বিশ্বজিৎ সেন ও তার স্ত্রী রূপ্না সেন ছাড়াও আছেন গাছবাড়ীয়া বণিক পাড়ার শুভ ধর (২৭), পটিয়ার রশিদাবাদ গ্রামের সাব্বির হোসেন (২৮), কমলমুন্সির হাট এলাকার রেজাউল করিম রফিক (৪৫) ও হুলাইন গ্রামের সিএনজি টেক্সি চালক মো. ইছমাইল (৫০)। নিহত সবাই টেক্সির যাত্রী। এতে ১০-১২ জন বাসযাত্রী আহত হন। গত ১১ জুলাই রাত সোয়া ৮টার দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ভাইয়ের দিঘির পাড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় আহতরা হলেন বরিশালের সরওয়ারের পুত্র আরিফুল ইসলাম (২৩), চকরিয়ার শামসুল আলমের পুত্র শাহ আলম (৪০), সাতকানিয়ার রাসেলের স্ত্রী সুখী (২৩), চকরিয়ার দেবরাজ শর্মার পুত্র শিপলু শর্মা (৪৩), শাহ আলমের কন্যা আদিবা (৭) ও সাতকানিয়ার রাসেলের কন্যা রাখি (৭)। আহত অনেকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিলেও গুরুতর আহত ৬ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার থেকে আসা রিল্যাক্স পরিবহনের বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি সিএনজি টেক্সিকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে নিয়ে যায়। পরে বাসটি উল্টে টেক্সিটিকে চাপা দিয়ে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যায়। এ সময় টেক্সির যাত্রীরা ৫০ গজের মধ্যে একে একে ছিটকে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, পটিয়া থানা পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ ও স্থানীয়রা নিহত ও আহতদের উদ্ধার কাজে সহায়তা করে।
পটিয়া ক্রসিং হাইওয়ে থানার ওসি মোজাফফর হোসেন জানান, দুর্ঘটনায় ৬ জন মারা গেছেন। দুর্ঘটনায় নিহত বিশ্বজিৎ সেনের ভাই কাঞ্চন সেন বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। আমরা দুর্ঘটনা কবলিত বাসের ড্রাইভার ও হেলপারকে আটক করার চেষ্টা চালাচ্ছি। তাদের আটক করতে পারলে অনেক কিছু জানা যাবে। বাস ও টেক্সিটি হাইওয়ে থানার হেফাজতে রয়েছে।
পটিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রাশেদুল ইসলাম জানান, ঘটনাস্থলে ৫ জন নিহত হন। ঘটনাস্থল থেকে আহত অবস্থায় ৮ জনকে পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর সেখানে আরেকজনের মৃত্যু হয়।
হাল না ধরে হারিয়ে গেলেন শুভ : মাস্টার্স শেষ করেছিলেন শুভ ধর (২৭)। খোঁজ করছিলেন চাকরির। একটি ভালো চাকরির জন্য বায়োডাটাও জমা দিয়েছেন সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে। ইচ্ছা ছিল চাকরি করে পরিবারের হাল ধরবেন। বাবাকে হারিয়েছেন ৬ মাস আগে। কিন্তু দুর্ঘটনায় স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।
চন্দনাইশ পৌরসভার ৮ নং ওয়ার্ডের গাছবাড়ীয়া বণিকপাড়ার মৃত মিন্নাত ধরের পুত্র শুভ ধর গত সোমবার রাতে চট্টগ্রাম শহর থেকে সিএনজিযোগে বাড়ি ফেরার পথে পটিয়ায় দুর্ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান। স্বামীকে হারানোর ৬ মাসের মাথায় বড় ছেলেকে হারিয়ে মা আন্না ধর এখন পাগলপ্রায়। বাড়ির দাওয়ায় বসে ছেলের জন্য আর্তনাদ করছিলেন তিনি। তার আহাজারিতে এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। গত মঙ্গলবার বিকেলে বণিকপাড়ায় নিহত শুভ ধরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় এমন চিত্র।
জানা যায়, শুভ ধর গত সোমবার সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে চট্টগ্রাম শহরে যান অসুস্থ বোনকে দেখতে। সেখান থেকে আসার পথে চাকরির আশায় পটিয়ায় বায়োডাটা জমা দেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে। সেখান থেকে সন্ধ্যায় বাড়ি আসার উদ্দেশ্যে সিএনজি টেক্সিতে উঠেন। ভাইয়ের দিঘির পাড় এলাকায় দুর্ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পরদিন সকালে পারিবারিক শ্মশানে দাহ করা হয় তাকে।
নিহত শুভ ধরের চাচা ঝন্টু ধর জানান, মিন্নাত ধরের ২ ছেলের মধ্যে শুভ ধর ছিল বড়। বাগিচাহাট এলাকায় স্বর্ণের দোকান দেখাশুনা করত তারা দুই ভাই। পাশাপাশি টিউশনি করত শুভ। গত ডিসেম্বরে তাদের বাবা মারা গেলে পরিবারের হাল ধরার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য বায়োডাটা জমা দেয় শুভ। ঘাতক বাস অকালেই তার প্রাণ কেড়ে নিল।
শুভ’র বন্ধু আল কবির সুজন জানান, শুভ ধর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসীতাকুণ্ডে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই নারীর মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধসমুদ্র সৈকত দেখা হলো না দুই বন্ধুর