জন্মের সময় মাকে হারায় একজন, দলছুট ও দুর্ঘটনার শিকার দুইজনসহ তিন হাতি শাবক। কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে বেড়ে ওঠেছে স্বজনহারা তিন শাবক। পার্কে আগত দর্শনার্থীদের নজর কাঁড়ছে তারা। বিশেষ করে মাহুতের সঙ্গে শাবকগুলোর খুনসুটি বেশ আনন্দ নিয়ে উপভোগ করছেন পার্কে আগতরা।
পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, পার্কের বন্য প্রাণী হাসপাতালের অভ্যন্তরে পর্যটক–দর্শনার্থীদের যাওয়ার তেমন সুযোগ নেই। এরপরও পার্কে আগত পর্যটক–দর্শনার্থীরা যাতে নিরাপদ দূরত্ব থেকে এসব হাতি শাবকের সাথে মাহুতের খুনসুটি উপভোগ করতে পারে সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
সরজমিন দেখা যায়, পার্কের গগণচুম্বি মাদার ট্রির (গর্জন) ছায়া–সুনিবিড় পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে বন্য প্রাণী হাসপাতাল। সেই হাসপাতালের একে একে তিনটি কোয়ারেন্টাইন শেডে বেড়ে ওঠছে হাতি শাবকগুলো। আর এসব হাতি শাবকের নিয়মিত পরিচর্যা তথা গোসল, ব্যায়াম করানোসহ নিয়ম করে খাবার খাওয়ানোর কাজ করছেন একাধিক মাহুত। চলতি শীত মৌসুমে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে সপরিবারে কক্সবাজার আসেন হাবিবুর রহমান ও নিলুফা আক্তার দম্পতি। তাদের সঙ্গে রয়েছে চার ও সাত বছর বয়সী দুই সন্তান। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতসহ নানা দর্শনীয় স্থান বেড়ানো শেষে বাড়ি ফেরার পথে ঢুঁ মারেন চকরিয়ার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে।
এই পর্যটক দম্পতি আজাদীকে বলেন, প্রতিনিয়ত সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর বন্যহাতি এবং মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে হাতি ও মানুষ মারা যাওয়ার খবর আসে। কিন্তু পার্কের বন্যপ্রাণী হাসপাতালের কোয়ারেন্টাই শেড ও পাদদেশে মাহুতের সঙ্গে হাতি শাবকের খুনসুটি দেখে মনটা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। যা দেখে আমাদের দুই সন্তান সজিব ও মুজিব বেশ উৎফুল্ল।
পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০২১ সালের মার্চের ১০ তারিখ থেকেই এই পার্কের বন্যপ্রাণী হাসপাতালে ঠাঁই হয় কঙবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাভুক্ত টেকনাফের পাহাড়ের পাদদেশে ওই বছরের শুরুর দিকে জন্ম নেওয়া একটি বন্য হাতি শাবকের। এ সময় মা ও শাবককে ঘিরে ছিল হাতির পাল। দুই–তিন দিন পর পুরো হাতির পাল সেখান থেকে বনের গভীরে সরে যায়। এর মাস দুয়েক পর হঠাৎ মরদেহ মেলে একটি মাদি হাতির। তারও কয়েকদিন পর লোকালয়ে আসে একটি হাতির শাবক। সঙ্গে অন্য কোনো বড় হাতি খুঁজে না পেয়ে অপেক্ষা করা হয় দুই দিন। কিন্তু বড় কোনো হাতির পাল হাতির শাবকটিকে খুঁজতে আসেনি আর। পরে অ্যালিফেন্ট রেসকিউ টিমের (ইআরটি) সহায়তায় বন বিভাগ শাবকটিকে উদ্ধার করে চকরিয়ার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে প্রেরণ করেন। সেই থেকে মাহুতের স্নেহে দিন দিন বড় হচ্ছে হাতির শাবকটি। পার্কে আনার পর এই মাদী শাবকের নাম রাখা হয় ‘যমুনা’। বর্তমানে যমুনার বয়স প্রায় চার বছর। ওজন দাঁড়িয়েছে প্রায় এক টনে। প্রতিদিন নিয়ম করে ৩০ কেজি করে ঘাঁস, ২০০ কেজি কলাগাছ, ২ কেজি ভুষি, ২ কেজি জাও ভাত, ৫ কেজি মিষ্টি কুমড়া, ৩ কেজি শসা খেতে দেওয়া হচ্ছে।
২০২৩ সালের ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বনের ভেতর কাদা মাটিতে আটকে পড়া এক মাস বয়সী আরেকটি শাবক উদ্ধার করে জলদীর বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য রেঞ্জের একটি দল। এরপর লালন–পালনের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় এই সাফারি পার্কে। বীর বাহাদুর নাম দিয়ে চিকিৎসা শেষে হাসপাতালটির শেডে রাখা হয় শাবকটিকে। বর্তমানে পুরুষ হাতিটির বয়স প্রায় এক বছর তিন মাস। প্রতিদিন নিয়ম করে তাকে খেতে দেওয়া হচ্ছে ৫০টি কলা, ৬ কেজি শসা, ৫ কেজি মিষ্টি কুমড়া, ১ কেজি গাজর, ল্যাকটোজেন (দুধ) ৮ প্যাকেট। বর্তমানে এটির ওজন প্রায় ২৫০ কেজি।
সর্বশেষ চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি পার্কে নতুন অতিথি হিসেবে আসে টেকনাফের সংরক্ষিত বনের ভেতর জন্মের সময় মাকে হারানো সদ্যেজাত একটি পুরুষ শাবক। প্রসবের সময় অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণজনিত কারণে মা হাতির মৃত্যু হয়েছিল। এটিকে পার্কের বন্য প্রাণী হাসপাতালের কোয়ারেন্টাইন শেডে রেখে তরল দুধ (ল্যাকটোজেন–১) দেওয়া শুরু হয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে সেই শাবকটিও মায়ের ন্যায় মানবের পরম মমতায় বেড়ে ওঠছে। বর্তমানে এই শাবকটির ওজন প্রায় ১৩০ কেজি। এই শাবকটির নাম এখনও রাখেনি পার্ক কর্তৃপক্ষ।
পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, এতিম হওয়া ছাড়াও দুর্ঘটনার শিকার হয়ে একের পর এক পার্কে ঠাঁই হওয়া হাতি শাবকগুলোর পরিচর্যায় বীরসেন চাকমা ও সুশীল চাকমা নামের দুইজন মাহুত নিয়োজিত রয়েছে। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক মো. মাজহারুল ইসলাম।
মাহুত সুশীল চাকমা আজাদীকে বলেন, এতিম হাতি শাবককে সন্তানের মতোই লালন–পালনের মাধ্যমে বড় করে তোলার কাজটি খুবই কষ্টদায়ক। এরপরও নিজের শিশু–সন্তানের মতো করে সেবা–শুশ্রূষা দিয়েই বড় করে তোলা হচ্ছে হাতি শাবকগুলোকে। তিনি বলেন, প্রথমবারের মতো পার্কে আনা হয় কয়েকমাস বয়সী মাদী হাতি শাবককে। এরপর যমুনা বলে দূর থেকে ডাক দিলেই বেশ সাড়া দেয়। লাফিয়ে লাফিয়ে যমুনা একদম কোলে উঠে যেত। এতে মনে হতো আমার নিজের সন্তানই কোলে উঠছে।
আরেক মাহুত বীরসেন চাকমা বলেন, সারাদিন লাফালাফি ও খুনসুটিতে দিন পার করে হাতি শাবক যমুনা ও বীর বাহাদুর। নিয়ম করে প্রতিদিন গোসল, খাবার ও ব্যায়াম করানো হয়। পার্কে আনার পর কয়েকদিনে শাবকটি বেশ স্বাস্থ্যবান হয়েছে। এভাবে নিয়ম করে আগামী একবছর পর্যন্ত ল্যাকটোজেন–১ দুধ খাইয়ে বড় করে তোলা হবে বীর বাহাদুরকে। আর যমুনা অনেক বড় হয়েছে এবং তাকে স্বাভাবিক খাবার দেওয়া হয়।
পার্কের বন্য প্রাণী হাসপাতালের চিকিৎসক (ভেটেরিনারী সার্জন) হাতেম সাজ্জাদ মো. জুলকার নাইন হাতি শাবক তিনটির সার্বিক অবস্থা দেখভাল করছেন। নিয়মিত শারিরিক চেকআপসহ শাবকগুলোকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবাও দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তিনি আজাদীকে বলেন, বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার হওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় পার্কে প্রেরিত হাতি শাবকগুলো বেশ সুস্থ ও সবল হয়ে ওঠছে। নিয়ম করে খাবার ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা প্রদানের মাধ্যমে বড় করে তোলা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক মো. মাজহারুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, বনের প্রাণী আর মানুষের স্বভাব কিন্তু একেবারেই আলাদা। এরপরও মানুষের পরিচর্যায় বনের প্রাণীও যে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, তা পার্কের হাতি শাবক যমুনা ও বীর বাহারদুরকে দেখলেই প্রমাণ মিলবে।
তত্ত্বাবধায়ক মাজহার বলেন, পার্কের বড় হাতি আর এসব শাবকের মধ্যে বেশ তফাৎ রয়েছে। বড় হাতিগুলো বনের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে বড় হওয়ার পর পোষ মানিয়ে পার্কে আনা হয়েছে। কিন্তু যমুনা ও বীর বাহাদুরসহ তিন শাবককে সম্পূর্ণ মা–বাবার আদর, স্নেহ–ভালোবাসায় বড় করতে হচ্ছে। দিনের বেলা প্রকৃতির মধ্যে আর রাতে পার্ক হাসপাতালের আইসোলেসন কক্ষে রাখা হয় এসব শাবককে। আবদ্ধ জঙ্গলে রাখার সময় পরিচর্যাকারী বীরসেন ও সুশীল চাকমাকে না দেখলে অবিকল মানুষের বাচ্চার মতোই আচরণ করে শাবক যমুনা ও বীর বাহাদুর। এক ধরনের ডাক, পায়চারি, ঘেরার দরজায় ধাক্কা দিয়ে নিজেদের চঞ্চলতা ও খুনসুটি প্রকাশ করে তারা। এই অবস্থায় বীরসেন ও সুশীল শাবকের কাছে গেলেই শুঁড় দিয়ে আদর করে একদম শান্ত হয়ে যায়। মানুষ এবং বন্য প্রাণীর বাচ্চার মধ্যে খুনসুটি দেখলে মনে মনে অন্যরকম প্রশান্তি চলে আসে।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক আবু নাছের মো. ইয়াছিন নেওয়াজ আজাদীকে বলেন, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশের মধ্যে গড়ে তোলা এই সাফারি পার্ক বিভিন্ন ধরনের বন্য প্রাণীর প্রজননেও বিরাট সফলতা দেখিয়েছে অতীতে। একইসাথে দেশের বিভিন্নস্থান থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধারের পর একে একে তিনটি হাতি শাবককে প্রেরণ করা হলে তাদের বড় করে তোলা হচ্ছে মায়ের মমতায় বেশ যত্ন–আত্তির মাধ্যমে। আগামীতেও এই প্রয়াস অব্যাহতভাবে চলমান থাকবে পার্কে।