সোমবার বিকেল। টঙ্গী থেকে বাসায় ফিরছিলেন নাজমা বেগম। প্রতিদিনের মতোই ক্লান্ত শরীরে রিকশা থেকে নামছিলেন তিনি। ঠিক তখনই বেজে উঠল ফোন। অপর প্রান্তে পরিচিত এক কণ্ঠ জানাল, ‘আপনার ছেলের খোঁজ মিলেছে, ও চমেক হাসপাতালে ভর্তি।’
স্মৃতি, শঙ্কা আর আশা– তিনে মিলে বুকের ভেতর হঠাৎ করেই ঝড় বইতে শুরু করল। ১০ দিন ধরে নিখোঁজ ছেলের খোঁজে একের পর এক রেলস্টেশন আর হাসপাতাল ছুটেছেন নাজমা। থানায় যাননি, কারণ মনে আশা ছিল ছেলেটা ফিরে আসবে, আগেও যেমন এসেছে। কিন্তু এবার সময় পেরিয়ে গেছে ১০ দিন। ফেরার আশা রূপ নিচ্ছিল অজানা শঙ্কায়। সেই ভাঙাচোরা আশা আবার জেগে উঠল একটি ভিডিওর সূত্র ধরে। পরিচিত জনের ফোনের পর সোমবার রাতেই ভিডিওটি দেখেন নাজমা বেগম। তার ১০ বছরের ছেলে আবদুল্লাহ শুয়ে আছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি বেডে।
রাতেই সিদ্ধান্ত নেন, পরদিনই ছুটে যাবেন ছেলের কাছে। মঙ্গলবার সকাল। ঢাকার কমলাপুর থেকে ট্রেনে চেপে চট্টগ্রাম পৌঁছান নাজমা। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে রিকশায় করে চলে যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডের হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) এর দরজায় দাঁড়িয়ে নার্সদের অনুরোধ করেন ছেলেকে একবার দেখতে দেওয়ার জন্য।
দরজা খুলে গেল। চোখে চোখ পড়ল ছেলের সঙ্গে। মায়ের চোখ তখন জলে ভাসছে, ছেলের চোখে বিস্ময় আর ক্লান্তি। ‘মা, আমি এখানে,’ বলল আবদুল্লাহ। মা বুকে জড়িয়ে ধরেন ছেলেকে। দীর্ঘ ১০ দিনের অপেক্ষা আর দুশ্চিন্তার পর মা–ছেলের এ মিলন দেখে চোখ ভিজে উঠল আশেপাশে সকলের। নাজমা জানান, তার তিন সন্তানের মধ্যে আবদুল্লাহ সবচেয়ে বড়। বয়স ১০ বছর। ছোট মেয়ে ৫ বছরে পা দিয়েছে, আর ছোট ছেলের বয়স দুই বছর। আবদুল্লাহর আছে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পুরোনো অভ্যাস। আগে কয়েকবার ঢাকার আশপাশে ঘুরে ঘুরে আবার ফিরেও এসেছে। কিন্তু ৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে ভাত খাওয়ার পর হঠাৎ চুপিচুপি বেরিয়ে যায় সে। ভেবেছিলাম, আগের মতোই ফিরে আসবে। তাই প্রথমে থানায় যাইনি। কিন্তু দিন যেতে লাগল, ৫ দিন পেরোল, ৬ দিন, ৭ দিন… কোথাও খোঁজ মিলল না। এরপর শুরু হয় নাজমার নিঃশব্দ সংগ্রাম। ঢাকার বিভিন্ন জায়গা, রেলস্টেশন, বাজার– সব জায়গায় ছেলেকে খুঁজতে থাকেন তিনি। সেই সময়েই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে এক হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা অজ্ঞাত শিশুর ভিডিও। ভাগ্যক্রমে পরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে ভিডিওটি দেখতে পান নাজমা। চেহারা দেখেই চিনে ফেলেন, এ তো তারই ছেলে আবদুল্লাহ।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, ৮ সেপ্টেম্বর আবদুল্লাহকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। মাথায় ছিল গভীর আঘাত, এক পাশের হাড় ভেঙে মস্তিষ্কের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। পরদিনই জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচার করা হয়। তবে তখনও তার নাম–পরিচয় কিছু জানা যায়নি। হাসপাতালের রেকর্ডে সে ছিল ‘অজ্ঞাতনামা শিশু’।
চিকিৎসকরা বলেন, জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্ত তার পরিচয় জানা সম্ভব ছিল না। কয়েক দিন পর জ্ঞান ফেরে আবদুল্লাহর। তখন সে নিজের নাম বলে, জানায় মায়ের নাম, বাবার নাম, বাসার ঠিকানা। সেই সূত্র ধরেই নিউরো সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি দিয়ে খোঁজ শুরু করেন। আবদুল্লাহর ছবি দিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেওয়া হয়– ‘এই শিশুকে কি কেউ চিনেন?’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ওর মাথার এক পাশের হাড় ভেঙে মস্তিষ্কে ঢুকে গিয়েছিল। আমরা সফলভাবে অস্ত্রোপচার করেছি। এখন সে সুস্থ হয়ে উঠছে। আজ–কালকেই ওকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে। শিশুটি পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারছে– এই আনন্দ আমাদেরও।
নাজমা বেগম কৃতজ্ঞ জানালেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের প্রতি। ‘যদি ওরা ছেলের পরিচয় জানার চেষ্টা না করত, ফেসবুকে ভিডিও না দিত, আমি হয়তো কখনোই জানতে পারতাম না ও কোথায় আছে,’ বলছিলেন কান্নাভেজা কণ্ঠে।
চিকিৎসকেরা শুধু চিকিৎসা করেই দায়িত্ব শেষ করেননি তারা নিজ উদ্যোগে শিশুটির পরিচয় খুঁজেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করেছেন তথ্যের সন্ধানে। আজকের এই ডিজিটাল যুগে মানবিক যোগাযোগের নতুন এক উদাহরণ হয়ে উঠেছে এই ঘটনা। আবদুল্লাহ এখন শারীরিকভাবে সুস্থ। তবে মানসিকভাবে সে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সে কিছুটা আবেগপ্রবণ ও হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতায় ভোগে। এর আগে একাধিকবার বাসা ছেড়ে চলে যাওয়া সেই প্রমাণ।
চিকিৎসকেরা পরিবারকে পরামর্শ দিয়েছেন আবদুল্লাহর ভবিষ্যতের জন্য তাকে মানসিকভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার। দরকার প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং। নাজমা বেগম বলেন, ছেলেকে আর চোখের আড়াল হতে দেব না। স্কুলে ভর্তি করাব আবার, সঙ্গে কাউন্সেলিং করাব।
এই ঘটনা শুধু একটি নিখোঁজ শিশুকে ফিরে পাওয়ার গল্প নয়। এটি এক মায়ের বিশ্বাস, চিকিৎসকের দায়িত্ববোধ, প্রযুক্তির সহায়তা এবং মানুষের মাঝে এখনও বেঁচে থাকা মানবিকতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।












