মায়ের জন্য ভালোবাসা প্রতিদিন

ডা. দুলাল দাশ | রবিবার , ১৪ মে, ২০২৩ at ৬:৫১ পূর্বাহ্ণ

মা’ একটি শব্দ মাত্র কিন্তু তার পরিব্যাপ্তি বিশাল। ‘মা’ ডাকটা কত মধুর, কত শান্তির, কত নির্ভরতার জায়গা, কত আনন্দেরযার কোলে মাথা রাখলে সর্বসুখ পাওয়া যায়। জন্মলগ্ন থেকে সন্তান মা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। ব্যথা পেলে ‘মা’ কেটে গেলে ‘মা’ পানির তৃষ্ণা পেলে মা, পানি দাও। ভয় পেলে দৌড়ে মায়ের কোলে। কথায় আছে সন্তানের বিপদে পশুপাখি না জানতে আগে জানে মা। একটা গানের কলি আছে ‘মায়ের এক ধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চাম, পাপশ বানাইয়া দিলেও এ ঋণ শোধ হবে না।’ ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে/ মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে।’ এরকম আরো কত প্রবাদ প্রচলিত আছে। মায়ের তুলনা একমাত্র মায়েই। ১৯০৫ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্টে ‘আনজারভিস’ নামে এক মহিলা মারা গেলে তার মেয়ে ‘আনা মারিয়া রিভস’ তার মায়ের কাজকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তিনি তার সানডে স্কুলে প্রথম দিনটি মাতৃদিবস হিসাবে পালন করেন। ১৯০৭ সালে তিনি দিবসটির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। পরে ১৯১৪ সালে ৮ মে ‘মার্কিন কংগ্রেসে মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ‘মা’ দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। সেই থেকেই মা দিবসটি পালিত হয়। অন্যান্য বহু দেশের সাথে বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হয়। আমি আমার মায়ের একমাত্র সন্তান। ১৯৪৩ সালে মায়ের সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে আমার জন্ম হয়। তখন ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু শুরু ভাব। সারাদেশে ১৯৪৩ এর মন্বন্তর (দুর্ভিক্ষ) চলছিল। টাকা দিলেও খাদ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। নরকঙ্কালের মতো হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। ব্রিটিশের গড়া চট্টগ্রামের জেনারেল হাসপাতালে মায়ের অপারেশন হয়। সে যুগে শুধু ইথার অ্যানাসথেশিয়ার মাধ্যমে অপারেশন করা হতো নিবিড় পরিচর্যার ব্যবস্থা ছিল না। গ্রাম থেকে শহরে আসর নৌকা, সাম্পান ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। প্রসব ব্যথা নিয়ে সাম্পান করে মাকে শহরে নিয়ে আসা হয়। এত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে এত কষ্ট স্বীকার করে মা আমাকে জন্ম দেয়সেই আমার মা। একমাত্র সন্তান বলে আমাকে সব সময় চোখে চোখে রাখত। কারো কোলে দিত না। আমার যখন দুই বৎসর বয়স আমার গুটি বসন্ত হয়। তখন বসন্তে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যায়। ডাক্তারী চিকিৎসা পায়নি। কোথায় ডাক্তার; দুই মাইল দূর থেকে ফোঁরকা বৈদ্যকে এনে ঝার ফোঁকের মাধ্যমে আমাকে মা সুস্থ করে তোলেন। আমি যতদিন অসুস্থ ছিলাম মা তাঁর ঘুম আহার ত্যাগ করে সর্বদা আমার পাশে থাকতো। সন্তানের প্রতি মায়ের ত্যাগ, ধৈর্য, স্নেহ, মায়া, মমতা অশেষ। সংসারে মায়ের কোনো বিকল্প নেই। নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ায়। সমস্ত বিপদ থেকে সন্তানকে আগলে রাখেসেইত মা। ক্ষিধা পেলে মা ভাত দাও। কত আবদার। মা সব নীরবে সহ্য করে যায়। আমাদের ছোট বেলায় খাতা কলম ছিল না। মা স্লেটে চক দিয়ে অক্ষর লেখা শেখাতো। কান্না করলে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে দিত। ঘুম পাড়ানী গান গেয়ে সকালে হাত বুলিয়ে দোলনায় ঘুম পাড়াতো। আমি আড়াই বৎসর পর্যন্ত মায়ের দুধ খেয়েছি। মাকে কান্না করতে দেখলে সন্তান যদি জিজ্ঞেস করে, মা কাঁদো কেন মা বলে কই, আমিত কাঁদছি না। চোখে যেন কি একটা পড়েছে। অর্থাৎ শত দুঃখেও মা ছেলে মেয়েদের তার বুকের চাপা কষ্ট বুঝতে দেয় না। গ্রামে গঞ্জে স্বামী পরিত্যক্ততা কত মায়েরা স্বামীর ফেলে যাওয়া সন্তানদের কীভাবে কত কষ্ট স্বীকার করে তাদের লালন পালন করে। এখন গ্রামে গঞ্জে শহরে মায়েরা অনেকে কর্মজীবী। সেই ব্যস্ততার মধ্যেও তারা সন্তানদের লালন পালনে সচেষ্ট। অনেক প্রতিষ্ঠানে স্টেশনে শিশুদের জন্য ফিডিং কর্ণারের ব্যবস্থা আছে। বিদ্যাসগারের মাতৃ ভক্তি একটা স্মরণীয় দৃষ্টান্ত। বিদ্যাসগরকে বাড়ির একটা অনুষ্ঠানে মা উপস্থিত থাকতে বললেন। তখন তিনি কোলকাতায় চাকরিরত। ছুটি চাইলেন কর্তৃপক্ষ দিলেন না। সাথে সাথে চাকরি ইস্তফা দিলেন। বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। কারণ মাতৃ আজ্ঞা পালন করতে হবে। দামোদর নদীর পাড়ে গিয়ে দেখল নদীতে উত্তাল ঢেউ, ঝড় বইছে। পারাপারের ব্যবস্থা নেই। তখন তিনি মাতৃ আজ্ঞা পালন করতে গিয়ে মা বলে দামোদরে ঝাঁপ দিলেন। ঠিকই পার হয়ে গেলেন। পৌঁছে মা বলে ডাক দিলেনমা আমি এসেছি। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ভারতের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এ পি জে আবদুল কালাম বাংলাদেশে এসেছিলেন। শিশুদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন– ‘যদি তুমি তোমার মাকে খুশি করতে পারো, তাহলে সমাজ খুশি হবে। আর সমাজ খুশি হলে বাংলাদেশ খুশি হবে। আরো বলেছিলেন মা তার পেটে ৯ মাস সন্তান ধারণ করে, ৩ বৎসর পর্যন্ত কোলে নেয়, এবং সারাজীবন তাকে হৃদয়ে রাখে।

নোবেল বিজয়ী জার্মান সাহিত্যিক ‘গুন্টার গ্রাস’ বলেছেন– ‘আমার জীবনে সব চেয়ে বড় দুঃখ আমার মায়ের মৃত্যু। ৫৭ বছর বয়সে আমার মা ক্যান্সারে মারা যায়। আমি অনেক কেঁদেছি এখনও কাঁদি। আমি মাতৃ ভক্ত ছিলাম। আমি চেয়েছি আমার মৃত্যুর পর আমার কবরের গায়ে যেন খোদিত থাকে– ‘এখানে শায়িত আছে ’গুন্ডার গ্রাস’ যে তার মাকে সব চেয়ে বেশি ভালোবাসতো। আন্তর্জাতিক মা দিবসে সকল মা দের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো খুবই উচিত। রাষ্ট্রীয় ভাবে, পারিবারিকভাবেও এই সম্মাননা জানানো যায়। নিজ সন্তানকে পূর্ণাঙ্গ রূপে মানুষ করে গড়ে তোলার পিছনে মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। বর্তমান সরকার নারীদের ক্ষমতায়নে বিশেষ কাজ করছে। সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশের নিরাপদ মাতৃত্ব কর্মসূচি জাতিসংঘ কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে। সরকার সারা দেশে কমিউনিটি ক্লিনিক ও হেলথ কমপ্লেঙ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রসূতি মায়েদের ঝুঁকিমুক্ত নিরাপদ ডেলিভারী ব্যবস্থা করেছে। এখন বাংলাদেশে প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর হার অনেক হ্রাস পেয়েছে। মা সন্তানের প্রথম ও সর্বজনীন শিক্ষক। সন্তানের পরিপূর্ণ বিকাশ ও সুখ দুঃখের সাথী মা। খুবই পরিতাপের বিষয় যে মা সারাজীবন এত কষ্ট করে ছেলে মেয়েকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন, সে মাকে বোঝা মনে করে বৃদ্ধ বয়সে তাকে ঘর ছাড়া করে, বৃদ্ধাশ্রমে স্থান করে দেয়। অপরদিকে অনেক সন্তানেরা মায়ের সেবা করে বেহেস্তে যাবার পথ পরিষ্কার করে। উপযুক্ত ছেলেমেয়েরা মাবাবার নামে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বা অনেক সামাজিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে দেয়। আমরা আদর্শমাদের গল্প শুনি। রত্নাগর্ভা মায়েদের সন্তানদের কীর্তি কাহিনি শুনে মুগ্ধ হই। জয় হোক মায়ের।

লেখক : প্রাক্তন চিফ অ্যানাসতেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসমরেশ মজুমদারের কালবেলা এবং নকশাল আন্দোলন