হযরত আদম (আ) এর রোজা ছিল আইয়ামে বীজ এর মাসগুলো, যেমন : প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ। নফল রোজার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ রোজা হল পবিত্র আশুরার রোজা-এরপরেই আইয়ামে বীজের রোজাসমূহ। আমার রাসূল (সা) আইয়ামে বীজের রোজাসমূহ কখনো ভঙ্গ করেননি, যেখানে ফরজ রোজা ভাঙ্গার বিধান রয়েছে। হযরত দাউদ (আ) এর রোজা ছিল একদিন পর পর। হযরত মুসা (আ) এর রোজা ছিল পুরো ৪০ দিন আর বিশ্বনবীর রোজা ৩০ দিন। এ মাসের মূল শিক্ষা তাকওয়া। প্রত্যেক মুমিন বান্দা যেন তাকওয়া গুণের অধিকারী হতে পারে সেজন্যে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বার বার তাগাদা দেয়া হয়েছে। তাকওয়া মানে বেছে বেছে চলা, খোদাভীতি অর্জন করা। বিখ্যাত সাহাবী ও সবচেয়ে শ্রদ্ধাস্পদ হযরত কা’ব (রা) কে উদ্দেশ্য করে বিশ্বনবী বললেন, হে কা’ব-তুমি কোরআন তেলাওয়াত কর। তোমার কন্ঠে আমি কোরআন তেলাওয়াত শুনতে চাই। হযরত কা’ব একটু বিচলিত হয়ে রাসূল (সা) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা), আল্লাহ কি আমার নাম ধরে বলেছেন? রাসূল (সা) বললেন, হ্যাঁ তোমার নাম ধরে বলেছেন। হযরত কা’বকে হযরত ওমর (রা) বললেন, হে কা’ব-তুমি আমাদের তাকওয়া সম্পর্কে বল। হযরত কা’ব বললেন, হে ওমর (রা) তুমি কি ঘন ঝোপ-জঙ্গল পরিবেষ্টিত দু’ পাহাড়ের সরু পথ দিয়ে হেঁটেছ? যে পথের দু’পাশে রয়েছে কাঁটা বন। সামনেও কাঁটা, পেছনেও কাঁটা, নিচেও কাঁটা। সে পথ দিয়ে হাঁটতে হলে সতর্কতার সাথে হাঁটতে হবে কাঁটাগুলো সরিয়ে। হে ওমর (রা) জীবনের সমগ্র পথ হচ্ছে এই গিরিপথ-যার দু’পাশ কন্টকাকীর্ণ। এখানে প্রতিটি কদম ফেলতে হবে অতি সাবধানতার সাথে-এটিই হচ্ছে তাকওয়া। ইবনে হিব্বান ও ইমাম তাবারানী রেওয়ায়েত করেছেন, ‘বিশ্বনবী একদা সাহাবীদের উদ্দেশ্যে খুতবা দেওয়ার জন্য মিম্বরে উঠছিলেন, এ সময় তিনি তিনবার আমিন বললেন। খুতবা শেষে সাহাবীরা তাঁকে ঘিরে ধরলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা) আপনি কার উদ্দেশ্যে আমিন বললেন। রাসূল (সা) বললেন: এই মাত্র জিবরাইল (আ) আগমন করলেন এবং সেই হতভাগাদের উপর লানত করলেন, যারা রমজানের রোজা পেয়েও নিজের জিন্দেগীর গুনাহখাতা মাফ করাতে পারল না। হযরত জিবরীল আমিন এর দোয়া যেন কবুল হয় সেজন্যে আমি আমিন বললাম। এ মহান ও মর্যাদাবান মাসটিকে এত কাছে পেয়েও যে ব্যক্তি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সাথে কাটিয়ে দিল, তার চে’ হতভাগা আর কে হতে পারে? মহান রাব্বুল আ’লামিন শুধুমাত্র এ মাসটিকে সমগ্র কুরআনুল করিমে সম্মানিত মাস হিসাবে বিবেচিত করেছেন, যেটি অন্য কোন মাসকে করেননি। এ মাস দহনের মাস, নিজেকে জ্বালিয়ে দেয়ার মাস, ভস্মিভূত করে দেয়ার মাস, সমগ্র জীবনের গুনাহকে জ্বালিয়ে দেয়ার মাস-সুবাহানাল্লাহ। শুধু পোড়া নয়, পুড়ে ছারকার করে দেওয়া। মহান আল্লাহতায়ালা যেন সারা রমজান মাসের আগুন দিয়ে আমাদের জিন্দেগীর সমস্ত গুনাহকে জ্বালিয়ে দেন। এ মাস সেই মহিমান্বিত মাস যার গর্ভে ধারণ করেছে সে কিতাব, যে কিতাব সৃষ্টির পর থেকে কেয়ামত পর্যন্ত উজ্জ্বল ও জীবন্ত থাকবে সেই মহাবিস্ময়কর কিতাব আল্-কোরআন। এ মাসটিকে পাওয়ার জন্য আমার রাসূল (সা) দোয়া করেছেন এভাবে, হে আল্লাহ, তুমি আমার জন্যে রজব-শাবানকে বরকতময় করে দাও এবং আমার হায়াতকে রমজান মাস পর্যন্ত নিয়ে যাও। কোরআন নাযিল হওয়ার এ পবিত্র মাসটিতে যে হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে সে হাদীসের রাবী বিখ্যাত সাহাবি হযরত সালমান ফারসি (রা) যিনি বৃদ্ধ অবস্থায় আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপর ঈমান এনেছেন। ষাটোর্ধ এ বয়স্ক ব্যক্তি সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন, সালমান ফারসি এমন ব্যক্তি যার জন্যে জান্নাত অপেক্ষা করছে। আমরা গুনাহগার বান্দারা সেই মহাকাংখিত জান্নাত পাওয়ার আশায় ছুটে চলছি অপ্রতিরোধ্য গতিময়তায়, জানি না আল্লাহর সেই সুন্দরতম জান্নাতের স্বাদ আস্বাদন করতে পারব কিনা অথচ কিছু কিছু মানুষের জন্যে সেই জান্নাতই অপেক্ষা করছে। পাঁচ শ্রেণীর মানুষের জন্যে জান্নাত অপেক্ষা করে থাকে : ১) যাঁরা বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করেন (ইমামে আজম হযরত আবু হানিফা (রা)) পবিত্র রমজান মাসে ৬১ বার কোরআন খতম করতেন, দিনে এক খতম, রাতে এক খতম, তারাবিতে এক খতম। ২) জিহ্বা সংযতকারী। রোজা ধংসকারী শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল : মুখ বা জবান, যেমন: মিথ্যা কথা বলা, অশ্লীল গালিগালাজ করা, মিথ্যা কসম করা ইত্যাদি জবান দিয়ে হয়ে থাকে। অনেক নবী-পয়গম্বরদের আমলে রমজান মাসে কথা না বলা নাজায়েজ ছিল। সহিহ্ বোখারীতে বর্ণিত, ‘সে ব্যক্তির উপবাস আল্লাহতায়ালার কোন প্রয়োজন নেই- যে ব্যক্তি তার জিহ্বা হেফাজত করতে পারল না’। ৩) ক্ষুধার্ত মানুষকে যে আহার দেয়। কবি বলেন, কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে? কভু আশি বিষে, দংশেনি যারে। যারা ক্ষুধার্ত, অভাবী, শীতার্ত তাদের কষ্ট ও মর্মবেদনা বোঝার মাস হল এটি। সেজন্য অনাহারে-অর্ধাহারে থাকা অভাবী মানুষদের বেশি বেশি খাবার দেয়া ও দান করা এ মাসের অন্যতম আবেদন। ৪) যে ব্যক্তি রাসূল (সা) এর উপর বেশি বেশি দোয়া-দরুদ পড়ে ৫) বিবস্ত্র মানুষকে বস্ত্র দানকারী। আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন, হে মানুষেরা তোমাদের উপর এক পবিত্র বুজুর্গ মাস ছায়া বিস্তার করছে। এ মাস এমন একটি বরকতময় ও রহমতের মাস, যে মাসে এমন একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। আল্লাহতায়ালা এ মাসে দিনে আমাদের উপর সিয়াম ফরজ করেছেন এবং রাসূল (সা) রাত্রি জাগরণ জরুরত করেছেন। এ মাসের নফল এবাদত অন্যান্য মাসের ফরজের সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এ মাসের প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ-প্রতিটি মুহূর্তের নফল এবাদতের ভেতর লুকিয়ে রয়েছে অন্যান্য মাসের শত শত বছরের এবাদত। এ মাসের একটি ফরজ এবাদত অন্যান্য মাসের ৭০ ফরজ এবাদতের সমান। যাঁরা ঈমান ও এহ্তেছাব এর সাথে সিয়াম ও কিয়াম পালন করেন তাঁদের গুনাহ ধুয়ে মুছে এমনভাবে সাফ হয়ে যায় যেন তারা নবজাতক শিশু হিসাবে নিষ্পাপ অবস্থায় এইমাত্র জন্মগ্রহণ করেছে। এ মাসের মূলমন্ত্রই হল জিন্দেগীর গুনাহ মাফ, গুনাহ মাফ। এ পৃথিবীর মালিকানা যাঁর, তাঁরই আদেশ: হালাল জিনিসকে হারাম, বৈধ জিনিসকে অবৈধ করে দেয়া। রমজান হচ্ছে ছবরের মাস। ইসলাম দু’টি মৌলিক জিনিসের উপর স্থাপিত : ছবর ও প্রশস্ততা। রাসূল (সা) ফরমায়েছেন, যে ব্যক্তি ঈমান আনল সে যেন জ্বলন্ত কয়লা হাতে নিল। ছবরের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। অন্যত্র বলা হয়েছে, আমলের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। বেদনাক্লিষ্ট ও দুঃখী মানুষদের প্রতি সহানূভূতির মাস হচ্ছে রমজান। মেজাজ ও উত্তেজনা প্রশমনের মাস রমজান। এ মাসে মোমিনদের রিজিক প্রশস্ত করে দেয়া হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে। যে ব্যক্তি এ মাসে রোজাদারদের ইফতার করান তার জন্য তিনটি পুরস্কার রয়েছে : ১) গুনাহ মাফ হয়ে যাবে (ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, হযরত মোহাম্মদ (সা) এর আগে ও পরের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়েছে-যেটা আল্লাহর কোরআনে ওহী করা, যেটি অন্য কারো জন্যে বলা হয়নি অথচ তিনি সবচেয়ে বেশি তওবা করতেন আল্লাহতায়ালার কাছে। দিনে অন্তত ১০০ বার তওবা করতেন। রাসূল (সা) বলেন, আমি সবচেয়ে বেশি তওবাকারী পয়গম্বর। আল্লাহর রাসূল (সা) কে সবচেয়ে বেশি কাঁদতে দেখেছেন আরাফাতের ময়দানে হযরত ইবনে আব্বাস (রা)। তিনি আরো বলেন, রাসূল (সা) এর চোখ এবং নাকের পানি গড়িয়ে যেন আরাফাতের ময়দান ভিজে যায়। রাসূল (সা) বলেন, হে আল্লাহ-আমার গর্দান তোমার দিকে ঝুঁকে আছে, আমার নাকে- মুখে মাটি, চোখ অশ্রুতে সিক্ত হয়ে আছে। সূর্য হেলান দেয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর রাসূল (সা) আরাফাতের ময়দানে অবিরত কাঁদছিল-যাঁর জীবনে গুনাহের কোন কালো দাগ নেই আর ইবনে আব্বাস (রা) তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ২) জাহান্নামের ভয়ংকর আগুন থেকে নিষ্কৃতি। ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা) এর মোনাজাতের মধ্যে ছিল জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার ক্রন্দন। ৩) একটি পূর্ণ রোজার ছওয়াব বখশিশ করা হবে, যদিও ইফতারকারককে তার রোজার ছওয়াব থেকে বঞ্চিত করা হবে না। হাদিসটি বয়ান করার পর দরিদ্র সাহাবিরা সমস্বরে বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা), আমরা তো দরিদ্র সাহাবি, আমাদের তো ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই। আল্লাহর রাসূল (সা) বললেন, তোমরা উপরোক্ত তিনটি ছওয়াবই লাভ করবে যারা শুধুমাত্র এক কাপ দুধ খাওয়াবে অথবা একটি খোরমা অথবা এক ঢোক পানি অথবা শরবত অথবা খোরমার একটি অংশ। আল্লাহর কোরআন ঘোষনা করছে, যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে পূর্ণ আহার করাল (ইফতারী অথবা সাহরী) মহান রাব্বুল আ’লামিন তাদেরকে কেয়ামতের দিন হাউজে কাউছার থেকে পানি পান করাবেন। আকাশ থেকে জমিনের দিকে ফেরেশ্তারা মানুষ ও জ্বিনদের উদ্দেশ্যে ঘোষনা করছেন, তোমরা এবাদতের জন্য কোমর বাঁধ। এটা অলসতার মাস নয়, ঘুমিয়ে থাকার মাস নয়। আকাশ থেকে ঘোষণা আসছে, হে নেক্কার বান্দারা-গুনাহ মাফের মাস চলে যাচ্ছে, হে গুনাহগারেরা-গুনাহ না করার কসম কর। আল্লাহতায়ালা বলছেন, এ মাসে তোমরা তোমাদের কর্মচারী-কর্মচারীনী, চাকর-বাকরদের উপর রহম কর। যারা তাদের উপর রহম করল, আমি তাদের জাহান্নামের আগুনে জ্বালাবো না এবং তাদেরকে মাফ করে দেব- সুবহানাল্লাহ্।
লেখক : সভাপতি-রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি)