এ শহরটি আরও একবার অভিভাবকশূন্য হলো। মাহবুব ভাইয়ের প্রয়াণ আমাদের অনেককেই একা করে দিল। ২৬ জুলাই–এর সকালে যখন শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণে রাখা হয় তখন তাঁকে শেষ দেখা দেখতে আসা অনেকের চোখমুখ যেন সে কথাটিই বলছিল। অজাতশত্রু নিরহংকারী মানুষটি যে সকলের প্রিয় ছিলেন। চট্টগ্রামী না হয়েও তিনি ছিলেন আপাদমস্তক চট্টগ্রামের। বাংলা ভাষাবিদ হয়েও তিনি যেভাবে চট্টগ্রামের ভাষাকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকে এটা রীতিমতো অবাক করার মতো। এরকম চট্টলপ্রেমিক চট্টগ্রামের অধিবাসীদের মধ্যেও বিরল। শৈশব থেকে জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত কাটিয়ে ছিলেন এ শহরে। শেষ ঠিকানাও হলো এই মাটিতে। চট্টগ্রামের ভাষা নিয়ে তাঁর চর্চা ও ভাবনা ছিল ঈর্ষণীয়। আমরা অনেকে এ বিষয়টিকে আঞ্চলিকতা ভেবে উপেক্ষা করি। অথচ তিনি সমৃদ্ধ এই ভাষাটিকে (জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্বের ৫৩ তম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত) গৌরবের সঙ্গে উপস্থাপন করতেন। অনেক তথ্য ও চিন্তামূলক লেখালিখি ও গ্রন্থ রয়েছে তাঁর। চট্টগ্রামের ভাষা বিষয়ক চাটগাঁ ভাষা পরিষদের তিনি ছিলেন সভাপতি। অথচ মাহবুব ভাইয়ের জন্ম তাঁর পৈতৃক জেলা ফরিদপুরের মধু খালীর ডুমায়ুন গ্রামে ১৯৪৮ সালের ৩ নভেম্বর। তাঁর আশৈশব বসবাস, অধ্যয়ন, কর্মজীবন তাঁর প্রিয় শহর চট্টগ্রামে।
তবে এটি তাঁর বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া জন্ম তারিখ যা বাকি জীবনে অনুসৃত হয়েছে। প্রকৃত জন্মতারিখ ১৯৪৭ সালের ১৪ জুলাই। এরপর পিতার কর্মসূত্রে ১৯৫৪ সাল থেকে তাঁর আশৈশব বসবাস, অধ্যয়ন, কর্মজীবন তাঁর প্রিয় শহর চট্টগ্রামে।
কৈশোরকাল থেকেই ড. মাহবুবুল শিল্প সংস্কৃতির সংযোগ। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ৮ম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই লেখালেখি যা জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত অব্যাহত। মাঝে মধ্যেই তাঁকে দেখতে যেতাম লালখান বাজারের বাঘঘোনার বাসায়। সবসময় দেখতাম প্রাণবন্ত। বৃহস্পতিবারে তাঁর কিডনি ডায়ালিসিস হতো। তাই সেদিন দুর্বল থাকতেন। তাঁর এক ছাত্রের সহায়তায় শ্রুতলিপির মাধ্যমে লেখালেখি করতে দেখতাম। প্রগতিশীল শিক্ষা সাহিত্য সাংস্কৃতি ও রাজনীতিতে ছিল তাঁর নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তাঁর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক সম্মান (প্রথম স্থান) এবং ১৯৭২ এ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর (প্রথম শ্রেণিতে ৩য়) করার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষকতার আমন্ত্রণ পেয়েও গ্রহণ করেননি নতুন দেশটির গঠনে আত্মনিয়োগ করার চিন্তায়। এ বছর তিনি রাশিয়ায় যান সমাজ বিজ্ঞান ও রুশ ভাষায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য। দেশে ফিরে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে দীর্ঘদিনের শিক্ষকতার পর ১৯৯৭ সাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন। এ বছরেই তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
অনেক পরিচয়ে ও গুণে গুণান্বিত ড. মাহবুবুল হকের বড় পরিচয় ভাষাবিদ এবং মাধ্যমিক শিক্ষার বাংলা পুস্তকের সম্পাদক হিসেবে। তিনি কেবল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নন, এদিক থেকে তিনি সারা দেশের বিদ্যালয় পর্যায়েরও শিক্ষক। তাঁর চলে যাওয়ার পর দেশের বিভিন্ন জেলায় আমার ছাত্রদের জিজ্ঞেস করে দেখলাম, সকলে এক নামে তাঁকে চেনে।
তবে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়, সংযোগ এবং ঘনিষ্ঠতা একটু অন্যভাবে। আমাদের ছাত্রাবস্থায় আন্দরকিল্লা ও মোমিন রোডের সংযোগস্থলের গ্রন্থ বিপণি ‘কথাকলি’ ছিল। প্রায় প্রতিদিনই যেতাম। বই তেমন কিনতে না পারলেও পড়ার সুযোগ পেতাম। প্রচুর আড্ডা হতো। কথাকলি ছিল আমাদের সম্মিলনী কেন্দ্র। আড্ডারুদের অনেকেই আজ দেশ বিদেশে সম্মানীয়। মাহবুব ভাইকে দেখতাম বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে গেলে। তিনি কিছুক্ষণ বসে দেখভাল করতেন। একটু রাশভারী মনে হতো। পরিচয় ছিল না তখন। ১৯৮০’র দশকের কথা এসব। তখন বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকা চট্টগ্রামে চলচ্চিত্র সংসদ চর্চার জমজমাট সময়। মাহবুব ভাই এরও আগে ১৯৭২ সালে যখন চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন থেকে তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কয়েক বছরের বিরতির পর ১৯৮১ সালের অক্টোবরে এই সংসদ পুনর্গঠিত হলে আমরা অনেকে সংযুক্ত হই। অনেক প্রদর্শনী হতো। প্রায় প্রতিটি প্রদর্শনীতে মাহবুব ভাইয়ের উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। সেই সূত্রে পরিচয় থেকে আপনজন হয়ে ওঠা। ক্রমশ অভিভাবকে এবং বন্ধুতে পরিণত হলেন মাহবুব ভাই। মাঝে মধ্যেই যাওয়া হতো লালখান বাজারের বাঘঘোনায় পাহাড়ের উপরে তাঁদের বাসায়।
সে বাসায় যাওয়ার অনেক কারণ ছিল। প্রদর্শনীর আমন্ত্রণপত্র বিলি, মাহবুব ভাই এবং সালেহা ভাবীর অত্যন্ত স্নেহময় আচরণ আর মনোমুগ্ধকর আড্ডা, তাঁদের বাড়ি ভরতি (প্রতিটি কামরায়) বই নেড়েচেড়ে দেখা ও ধার নেয়ার সুযোগ এবং ভাবীর হাতে তৈরি নানারকম মজাদার খাবার। তাঁদের ছেলে মেয়ে উপমা ও উপল তখন ছোটো। তাদের সঙ্গেও মজার মজার গল্পসল্প হতো। তারা দু’জন আজ পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত। সুদর্শন মাহবুব ভাইয়ের মিষ্টভাষে নানা প্রসঙ্গে আলাপ শুনে ঋদ্ধ হতাম। অনেক সময় নিজের লেখা নিয়ে বানান শুদ্ধ করে নিতাম। নানারকম সূত্র দিয়ে সহজে মনে রাখার জন্য বানান শেখাতেন তিনি। শব্দের ব্যুৎপত্তি বোঝাতেন মজা করে। একবার শুনলে আর ভোলা যায় না।
আরেকটা মজার বিষয় ছিল, মাহবুব ভাইকে আমরা মনে করতাম পয়া অতিথি। অর্থাৎ যে সব অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান ও বিশেষ অতিথি হতেন– সে অনুষ্ঠানটি বেশ জমে যেত। আমরা মজা করে বলতাম, আপনার হাতে মনে হয় জাদুর কাঠি আছে। সত্যিই তাই ছিল। সহজ–সরল এবং আন্তরিকভাবে যে কোনো বিষয়কে তিনি উপস্থাপন করতে পারতেন। যে কোনো মানুষকে খুব সহজে এবং অচিরে আপন করে নেয়ার একটা মোহময় ক্ষমতা তাঁর মধ্যে ছিল। আর ছিল চমৎকার সেন্স অব হিউমার, যা ছিল চরম বুদ্ধিদীপ্ত।
রুশ ভাষায় মাহবুব ভাইয়ের শিক্ষণের বিষয়ে শুরুর দিকে বলেছি। এ নিয়ে চমৎকার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। একবার খুলশীর সোভিয়েত (তখনকার) কনসুলেট চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদের এক প্রদর্শনীতে দেখা গেল রুশ ছবিটির সাবটাইটেল নেই। আমরা কেউই রুশ ভাষা বুঝি না। বিড়ম্বনায় পড়েছি সবাই। মাহবুব ভাই একটু পরে ওদের কাছ থেকে একটি মাইক্রোফোন চেয়ে নিয়ে পর্দার সামনে এক কোণে বসে পুরো ছবিটির সংলাপ বাংলায় তাৎক্ষণিকভাবে ভাষান্তর করে শ্রোতাদের কাছে উপভোগ্য করে তুললেন।
চলতি বছর (২০২৪) ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ বাংলা ভাষা নিয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিল। সেমিনারের প্রধান বক্তা ছিলেন ড. মাহবুবুল হক। অসুস্থ অবস্থাতেও অত্যন্ত প্রাণবন্তভাবে তিনি বাংলা ভাষা সম্পর্কিত চমৎকার একটি আলোচনা উপহার দিয়েছিলেন। সেই দীর্ঘ আলোচনার বেশির ভাগ জুড়েই ছিল চট্টগ্রামের ভাষা, যাকে তিনি আঞ্চলিক ভাষা বলতে চাইতেন না। সম্ভবত এটিই তাঁর শেষ ভাষণ।
তিনি চলে গেলেন ২৫ জুলাই রাতের প্রথম ভাগে (১.৪৫)। রেখে গেলেন অনেক সঞ্চয়, অনেক সম্পদ, অনেক স্মৃতি, অনেক ভালোবাসা আমাদের জন্যে, উত্তর প্রজন্মের জন্যে। আমরা হারালাম আমাদের মাহবুব ভাইকে যিনি ছিলেন আমাদের প্রিয় অভিভাবক, প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় বান্ধব। হারালাম একজন চট্টলপ্রেমিক।