মাস্টারদা সূর্য সেনের স্মৃতিবিজড়িত গৈড়লা গ্রাম

রশীদ এনাম | সোমবার , ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:৫০ পূর্বাহ্ণ

পটিয়া ‘গৈড়লা’ ধলঘাট ইউনিয়নের একটি গ্রাম। গ্রামের নামকরণটিও বেশ সুন্দর। পাখি ডাকা ছায়াঘেরা, দিঘি, পুকুর, চির সবুজের হাতছানি দেওয়া জলছবির মতো গৈড়লা। গ্রামটি ছিল কর্ণফুলি নদীর কাছাকাছি। এক সময় গ্রামের পাশে নৌঘাট ছিল। নৌকা সাম্পানও ভিড়ত ঘাটে। নদীর ছোটো ছোটো ঢেউ তুলে গড়াগড়ি দিত। ‘গৈর’ শব্দটি গড়াগড়ি থেকে এসেছে ধারণা করা হয়। গড়াগড়ি থেকে গৈড়লা নামের উৎপত্তি।

গৈড়লার মোড় থেকে নেমে হেঁটে যাওয়া যায় ঘোষের হাট পেরিয়ে গৈড়লা গ্রাম। তৎকালীন জমিদার গোপী ঘোষ। তাঁর নামে ‘ঘোষের হাট’। পাশে সদানন্দ ঘোষের হাতে গড়া গৈড়লা কেপি (করণখাইন প্রাণহরি) উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের পাশে মাস্টারদা সূর্যসেন সড়ক। পাশে মাস্টারদা সূর্যসেন স্মৃতিবিজড়িত বিপ্লবী ক্ষিরোদ প্রভা বিশ্বাসের বাড়ি। সূর্যকুমার সেন ওরফে মাস্টার দার জন্ম ১৮৯৪ সালে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামে।

তাজুর মুল্লুক মামার সাথে গৈড়লার ক্ষিরোধ প্রভা বিশ্বাসের বাড়ি পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সাথে ছিলেন নিপু দাদা। বাড়িটি ছিল বাঁশের তৈরি টিনের ছালা। তাজু মামা ও নিপু ভাই দেখিয়ে বললেন, এই সেই ঐতাহাসিক বাড়ি। বাড়ির পেছনে মাস্টারদাসূর্যসেন স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছিল। স্তম্ভটির জরাজীর্ণ ভগ্নাবশেষ আজো আছে। ১৯৩৩ সনে ১৬ ফেব্রুয়ারি পটিয়া থানার গৈড়লা গ্রামে ইংরেজ এবং বিপ্লবীদের মধ্যে এক সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। গৈড়লা গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ বিধবা ক্ষীরোদ প্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে মাস্টারদা সূর্যসেন, শান্তি চক্রবর্তী, সুশীল দাশগুপ্ত, কল্পনা দত্ত, মণিলাল দত্তসহ কয়েকজন বিপ্লবীরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। মাস্টারদার বিশ্বস্ত সহচর বিপ্লবী ব্রজেন সেন। গৈড়লা গ্রামে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের গোপন সভার আয়োজনে ব্যস্ত। গৈড়লা গ্রামের পুষ্পলতা বিশ্বাস নামের এক মহিলা হঠাৎ ক্ষীরোদ প্রভার বাড়িতে ঢুকে পড়েন। সে অনেক প্রবীণ ও তরুণ যুবককে দেখতে পায় এবং পাশে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পায় বিপ্লবী কল্পনা দত্তকে। ঘরে ফিরে খবরটি তার স্বামী প্রসন্ন বিশ্বাসকে জানায়। প্রসন্ন খবরটি ছুটে গিয়ে গ্রামের মাতব্বর ও পুলিশের সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী ব্রজেন সেনের অগ্রজ নেত্র সেনকে জানায়। দশ হাজার টাকা পুরস্কার ও সরকারি সুযোগসুবিধা পাবার লোভে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ খবরটি চট্টগ্রাম গোয়েন্দা হেডকোয়ার্টারসে পৌঁছে দেয়। গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ক্যাপ্টেন ওয়াসলীর নেতৃত্বে তিন শত গুর্খা সেনার একটি দল পটিয়া ক্যাম্পসহ গৈড়লা গ্রামের ক্ষিরোদ প্রভার বিশ্বাসের বাড়ি ঘেরাও করে। কয়েকজন বিপ্লবী ঘটনাস্থল থেকে পালাতে সক্ষম হলেও মাস্টারদা বের হতে পারেননি। ব্রজেন সেন লিখেছেন, “প্রথমে ছিলাম আমি পেছনে ছিল মাস্টারদা সূর্যসেন, কল্পনা দত্ত, মণি দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী ও সুশীল দাশ গুপ্ত। বাড়ির পূর্বদিকে সামনের পথে বাঁশের ঘেরার কাছে যেতেই কোন হ্যায়, ডাক শোনা গেল। বোঝা গেল মিলিটারি সৈন্য। ঘন অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখছে না। তিন কদম পিছে সরে হাতে ঠেলে মাস্টারদা সূর্য সেনকে সরিয়ে দিই। স্থির কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ত্বরিত পরামর্শ করে সবচেয়ে গোপন ও নিরাপদ পথ ঠিক করে চলি। বাঁশ ও গাছ ঘেরা ঘন অমানিশার অন্ধকারে গুর্খা বেষ্টনী ভেদ করে চুপিচুপি যেতেই তিন দিক থেকে তিনজন মিলিটারি আমাকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। এরই সঙ্গে সঙ্গে গুলির শব্দ হয়। অন্য দিকে মাস্টারদা গুর্খা বেষ্টনী ভেদ করে যাওয়ার সময় ফৌজি সেনাদের ওপরে ছুড়ে দেয়। ভিয়ারি লাইট বা হাউই বাজি জ্বলে উঠে সমগ্র এলাকাটিকে যখন দিনের বেলার ন্যায় আলোকিত করে ফেলল, তখন এ আলোতে পাশ থেকে দৌড়ে এসে কজন গুর্খা সৈন্য মাস্টারদাকে জাপটিয়ে ধরে ফেলে। পরে দুজনকেই পাশাপাশি রেখে ওদের পায়ের ও কোমরে পট্টি খুলে পা ও হাত পেছনে বেঁধে ফেলে। সে সময় অন্যান্যরা বেষ্টনী ভেদ করে যেতেই উভয়পক্ষে গুলি বিনিময় হয়। শান্তি চক্রবর্তী ও সুশীল রক্তাক্ত দেহে গুর্খা সেনাদের বেষ্টনী ভেদ করে চলে যান। অপরদিকে কল্পনা দত্ত ও মণি দত্ত পা ফসকে ডোবায় পড়ে যায়। পরে তারা ডোবা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে পালিয়ে যায়। আশ্রয়দানকারী ক্ষীরোদ প্রভা ও তার নাবালক ছেলে মনোরঞ্জনসহ পাশের বাড়ির হরি বিশ্বাসের পরিবারের সবাইকে গ্রেফতার করা হয়।

এদিকে মাস্টারদা সূর্য সেন ও ব্রজেন সেনকে নির্যাতন করে সদ্য লাঙল দেওয়া মাঠের শক্ত চাকের ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পটিয়া মিলিটারি ক্যাম্পে। মাস্টারদা সূর্য সেন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে তারা তাঁকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। মাস্টারদার সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। পরিধানের কাপড় খুলে পায়ে জড়িয়ে যায়। গায়ে শুধু খদ্দরের শার্ট আর পায়ের জুতো ছাড়া সবই দিগম্বর।

ঐ সময় ব্রজেন সেন ক্যাপ্টেনকে বলেন, we think you are a man of civilized nation, but what is this? ক্যাপ্টেন সাথে সাথে পিস্তল উঁচিয়ে ধরেন ব্রজেন সেনের বুকের দিকে। তারপর অর্ধশায়িত মাস্টারদার দিকে একনজর দেখে আত্মসংবরণ করে বলেন, Get him clothing হাতের বাঁধন শিথিল করে দিলে মাস্টারদা কাপড় পরে নেন। পটিয়া ক্যাম্পে নিয়ে আসার পথে কৌতূহলী লোকজন কাছে এসে ওদের দেখতে চাইত। গুর্খারা এদের লক্ষ্য করে বলত, বাঙ্গাল কো রাজাকো পাকড়ায়া। প্রহারাধীন অবস্থায় মাস্টারদা সূর্য সেন এক সময় ব্রজেন সেনকে বলেন, আমার ফাঁসি হবে। তোর জেল হবে, আবার কাজের সুযোগ হবে। অতঃপর ১৯৩৩ সালের ১৪ আগস্ট প্রহসনের বিচারে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার রায়ে মাস্টারদা সূর্যসেন ও তাকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির রায় হয়। মাস্টারদা সূর্য সেনকে চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে যাওয়ার পথে ইংরেজ এক কর্মচারী জিজ্ঞাসা করলেন, where is the lion of chittagong? সে সময় মাস্টারদা সূর্যসেন ফাঁসির মঞ্চ থেকে সাথীদের উদ্দেশ্য বলেছিলেন– “আমার স্বপ্ন স্বাধীনতার স্বপ্ন, আমার সাধনা তোমরা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিও। বিপ্লবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে। আমার জীবন স্বাধীনতার পূজারিদের প্রেরণার উৎস হোক। বন্ধুগণ এগিয়ে চলো, জয় আমাদের সুনিশ্চিত। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। বন্ধুগণ বিদায়, চির বিদায়”

ব্রজেন সেনের ভাই নেত্র সেনের গতিবিধি বিপ্লবীদের কাছে সন্দেহ হয় এবং নেত্র সেনের ওপর বিপ্লবীরা নিবিড় নজর রাখেন। ১৯৩৪ সালের ৯ জানুয়ারি সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত এলো। নেত্র সেন দশ হাজার টাকা পেয়ে মনের আনন্দে চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রফুল্ল মনে বাজার করে নিয়ে এলো। বাড়িতে মাছ রান্না হয়েছিল, মাছের মুড়ো নিয়ে খেতে বসেছিল নেত্রসেন। তার স্ত্রী রান্না করা তরকারি আনার জন্য রান্নাঘরে প্রবেশ করে। রান্নাঘর থেকে খাবার এনে দেখে তার স্বামী নেত্র সেনের মাথাটি বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাতের থালার কাছে গড়াগড়ি করছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে, অপর পাশে পড়ে আছে নিথর দেহ। নেত্র সেনের স্ত্রীর চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর কিরণ সেন ও খোকা নন্দী ফিরে এলেন। ওঁরা দুজনেই সূর্যসেনকে ধরিয়ে দেয়ার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন বিশ্বাস ঘাতক নেত্র সেনকে হত্যা করে। নেত্র সেনকে আক্রমণ করার জন্য বড়ো দা এনেছিলেন হাবিলাসদ্বীপ গ্রামের দেবেন দত্তের কাছ থেকে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে পটিয়ার বিপ্লবীরা বিশেষ করে প্রীতিলতা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল পুরো দক্ষিণ এশিয়ায়। প্রীতিলতা ছিলেন নারী মুক্তিযোদ্ধার আদর্শ এবং নারী সাহসী যোদ্ধার প্রতীকও বটে। তেমনি আবার বিশ্বাসঘাতকতা করে সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেওয়াটাও ছিল গৈড়লা গ্রামবাসীর জন্য বিষাদের। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি রাত ১২.৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে মাস্টারদার ফাঁসি কার্যকর হয়। সূর্যসেনের আত্মদান ব্যর্থ হয়নি। তাঁর ফাঁসির ১৩ বছর পর ভারতবর্ষ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ। ৯১তম ফাঁসি দিবসে মাস্টারদা সূর্য সেনের প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

তথ্যঋণ: আহমদ মমতাজ, মুক্তিযোদ্ধা তাজুর মুল্লুক, মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম

লেখক: সমন্বয় সহকারী, ইতিহাসের খসড়া

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি করুণ অধ্যায়ের যবনিকাপাত
পরবর্তী নিবন্ধআন নিসা একাডেমির ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম