মাছ ব্যবসায়ী আবু তৈয়ব থেকে মাসোহারা না পেয়ে পূর্বপরিকল্পিতভাবে বিচারের নাম করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, হত্যাকারীদের চেষ্টা ছিল ঘটনাটিকে গণপিটুনিতে রূপ দেওয়ার। তার জন্য যা যা প্রয়োজন নাটকের প্রতিটি দৃশ্যপট সাজানো হয়েছিল।
নগরীর বাকলিয়া থানাধীন নতুন ফিশারিঘাটের ভেড়া মার্কেট এলাকার আবু তৈয়ব (৪৫) হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশী তদন্তে এ রহস্য উদঘাটিত হয়। প্রথমে কয়েকজন হত্যার উদ্দেশ্যে তাকে ছুরিকাঘাত করে। পরে লোকজন জড়ো করে তাতে গণপিটুনির রং দেওয়ার কাজটি করেও শেষ রক্ষা হয়নি।
হত্যাকাণ্ডের তিন ঘণ্টার মধ্যেই বাকলিয়া থানা পুলিশ আকতার হোসেন প্রকাশ কসাই আকতারসহ (৪১) ৭ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে। অন্য ৬ জন হলেন মো. সাইফুদ্দিন (৪০), রায়হান উদ্দিন ওরফে রানা (২৫), আশরাফুল ইসলাম (২৮), মো. সবুজ (৩৫), মো. আবু তাহের ওরফে কালু (২০) ও হাসিনা (২৬)।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিন। তিনি বলেন, বাকলিয়া থানায় তৈয়ব হত্যাকাণ্ডে শনিবার একটি মামলা (নং ৫১) দায়ের করা হয়েছে।
কে এই আবু তৈয়ব? কেন তাকে হত্যা করতে এত আয়োজন? গতকাল এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) মেহেদী হাসান। তিনি জানান, শিকলবাহা মাস্টারহাট এলাকার আহমদ মিয়ার সন্তান তৈয়ব লেবার দিয়ে ফিশারিঘাটে ফিশিং ট্রলার থেকে মাছ নামানোর কাজ করতেন। নতুন ফিশারিঘাট আকতারের (মামলার প্রধান আসামি) কলোনিতে শ্রমিক সরবরাহের কাজ পরিচালনা এবং শ্রমিকদের রাখার জন্য তিনি একটি ছোট কক্ষ ভাড়া নিয়েছিলেন। আকতারের নির্দেশে তার ম্যানেজার সাইফুদ্দিন গিয়ে শ্রমিক সরবরাহের আয় থেকে অর্ধেক ভাগ দাবি করেন। বৃহস্পতিবার এ নিয়ে কথা কাটাাকটির জেরে আকতারের ভাই মুন্না, সাইফুদ্দিন ও হাসিনার সঙ্গে তৈয়বের ধাক্কাধাক্কি হয়। তৈয়ব তার কলোনির মালিক হিসেবে আকতারকে নালিশ করেন। সেই বিরোধ মীমাংসার কথা বলে তৈয়বকে ডেকে নিয়ে খুন করা হয়।
আকতার ও তার অনুসারীদের সঙ্গে নিহত তৈয়বের তিন ধরনের বিরোধের তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এ প্রসঙ্গে ওসি বাকলিয়া নেজামউদ্দিন আজাদীকে বলেন, তৈয়ব ফিশিং ট্রলারে শ্রমিক সরবরাহ করেন। এছাড়া নদীর তীরে নির্মিত কাঠের ট্রলার নদীতে ভাসানোর সময় যে শ্রমিক প্রয়োজন হয়, সেগুলো সরবরাহেও তার একক আধিপত্য ছিল। এই দুই সেক্টরে শ্রমিক সরবরাহের কাজ তার থেকে ভাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল আকতার। কিন্তু তৈয়বের প্রভাবের কারণে না পেরে আয়ের ভাগ বা চাঁদা দাবি শুরু করে। তৈয়ব চাঁদা দিতেও অস্বীকৃতি জানান। এছাড়া ভেড়া মার্কেট এলাকায় তৈয়বের একটি দোকান আছে। সেখানে গিয়ে আকতারের ভাই মুন্না (পলাতক) প্রতিদিন এক হাজার টাকা করে চাঁদা দাবি করেছিল। সেটাও তৈয়ব দেননি।
তিনি বলেন, দাবি করা টাকা না দেওয়ায় তাকে বিভিন্ন সময় দেখে নেওয়ার হুমকি দিত। এই বিষয়ে আবু তৈয়ব আকতার হোসেন প্রকাশ কসাই আকতারের কাছে অভিযোগ দেন। ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে শুক্রবার সন্ধ্যার পর আকতার হোসন একটি বৈঠক ডাকে। ওই বৈঠকে উপস্থিত হওয়ার জন্য আকতার নিহত আবু তৈয়বকে ফোন করে ফিশারিঘাট ভেড়া মার্কেটে আসতে বলে। আকতার হোসেনের কথায় শিকলবাহা থেকে আবু তৈয়ব ফিশারিঘাট এলাকায় যাওয়ার পথে বাকলিয়া থানার নতুন ফিশারিঘাট ওয়ালটন শো-রুমের সামনে পাকা রাস্তার উপর আকতার হোসনের ওরফে কসাই আকতার নেতৃত্বে ১০/১২ জন মিলে তৈয়বের গতিরোধ করে। এ সময় কসাই আকতার অন্যদের নির্দেশ দেয়, আবু তৈয়বকে মেরে ফেল। তার নেতৃত্বে অন্য আসামিরা তৈয়বকে লোহার রড, পাইপ দিয়ে পিটিয়ে এবং কিরিচ, রামদা, বঁটি দিয়ে বিভিন্ন অংশে কুপিয়ে মাথায় আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
হত্যার পর অভিযুক্তরা হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্য এলাকায় মিথ্যা রটনা ছড়িয়ে দেয়। প্রথমে ৮-১০ জন, পরে হামলে পড়ে আরও ২০-৩০ জন। ঠিক এভাবেই ঘর মালিক কসাই আকতারের নেতৃত্বে হামলে পড়া ৪০ জনের ওই দলের উপর্যপুরি আঘাতে নিহত হন ফিশারিঘাটের মাছ ব্যবসায়ী তৈয়ব প্রকাশ তৈয়ব মাঝি। পরে বলা হয়, বাড়ি ভাড়া নিয়ে কথাকাটি করতে গিয়ে বাড়িওয়ালাকে আঘাত করতে গেলে স্থানীয়রা গণপিটুনি দেয়। এতে তৈয়বের মৃত্যু হয়।
এর আগে গত শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তৈয়ব মাঝির সাথে ঘর মালিক কসাই আকতার ও তার ঘরের ইনচার্জ হাসিনার কথা কাটাকাটি হয়। ঘটনার এক ঘণ্টা পর তৈয়বের ওপর হামলা করে তারা। তৈয়বকে যখন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হচ্ছিল, সামনেই ছিলেন তার ছেলে শাহজাহান। তিনি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, আমার আব্বার কাছে ট্যাঙ (চাঁদা) চেয়েছিল। আব্বা যখন দেয়নি, তখন তার সঙ্গে আকতারের লোকজনের হাতাহাতি হয়েছিল। আকতার আমার আব্বাকে মীমাংসা করার জন্য ডেকেছিল। আব্বাকে দেখেই আকতার বলে ওঠে, ওকে একেবারে মেরে ফেল। তখন সবাই মিলে আব্বাকে মারতে শুরু করে। কোপ খেয়ে আব্বা দৌড় দিয়ে রাস্তায় চলে আসে। সেখানেও আকতার এবং তার সন্ত্রাসীরা এসে আব্বাকে কোপাতে থাকে।
কর্ণফুলী নদীসংলগ্ন এলাকায় সরকারি খাসজমিতে গড়ে ওঠা বিশাল বস্তির একটি কলোনির মালিক দাবিদার আকতার হোসেন (৪১) স্থানীয়ভাবে ‘কসাই আকতার’ নামে পরিচিত। গ্রেপ্তারের পর আকতার নিজেকে স্থানীয় বকশিরহাট ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। একই পদবি লেখা ব্যানারও ভেড়া মার্কেটে ঝুলছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
নিহত তৈয়বের ভাতিজা মোহাম্মদ হোসেন জানান, একটি সমবায় সমিতি বানিয়ে ভেড়া মার্কেট বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন আকতার। সেখানে সমিতির অফিসে নিয়মিত সালিশ-মীমাংসা হয়। এছাড়া ওই অফিসে মাদক-জুয়ার আসরও বসে। তার অনুসারী কমপক্ষে ৪০ জন সন্ত্রাসী আছে।
দুই বছর আগে ভেড়া মার্কেটের বস্তিতে আগুন লেগে কয়েক হাজার কাঁচা ঘর পুড়ে গিয়েছিল। এই জায়গাগুলো সরকারি খাস জমি হিসেবে চিহ্নিত। তবে জায়গাগুলো দখল করে একাধিক কলোনি বানিয়েছেন বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী। ভূমির দাবিদারদের সঙ্গে প্রশাসনের উচ্চ আদালতে মামলা চলমান আছে। আগুনে পুড়ে যাওয়ার মাসখানেকের মধ্যে তারা আবার সেখানে কাঁচা বসতি গড়ে তোলে। এই বস্তিকে ঘিরে দখল-বেদখল, সংঘাত, চাঁদাবাজি নিয়মিত হয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।