মাসে কোটি টাকার চাঁদাবাজি

বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগবাঁটোয়ারা হয় অর্থ

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১০ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:৫৮ পূর্বাহ্ণ

প্রতি মাসে কোটি টাকার উপরে চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করতে হয় বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের রাস্তা দখল করে থাকা ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের। এখানে বছরের পর বছর ধরে চলছে চাঁদাবাজি। স্থানীয় মাস্তান থেকে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগবাঁটোয়ারা হয় আদায়কৃত অর্থ। রাস্তা দখল করে গড়ে ওঠা কাঁচাবাজারে পথচারীদের পথচলা দায় হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) নিয়ন্ত্রণাধীন এই বাজারটি অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
সরেজমিনে অনুসন্ধান এবং স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারে বছর দেড়েক আগে সাবেক মেয়রের সময়কালে একটি নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়। ৮ কোটি ১৫ লক্ষ ৩৪ হাজার টাকা ব্যয়ে ৩৯ হাজার ২০০ বর্গফুটের দোতলা ভবন নির্মাণের কথা থাকলেও পরবর্তীতে শুধুমাত্র নিচতলায় বাজার চালু করা হয়। ভবনটির নিচতলায় কাগজে-কলমে ১০০ বর্গফুটের ১০টি দোকান, ৩০ বর্গফুটের ১৯০টি দোকান থাকার কথা। ২য় তলায় ১০০ বর্গফুটের ৯০টি দোকান থাকার কথা ছিল। অভিযোগ রয়েছে, কোটি কোটি টাকার ঘাপলার কারণে অপরিকল্পিতভাবে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ভবনটির দক্ষিণ-পূর্ব পাশে চলাচলের মূল সড়কটি সরু হয়ে গেছে। আশপাশের ভবন মালিকরা অভিযোগ করেন, বাজারের মূল ভবন নির্মাণ করার সময় প্ল্যানে না থাকলেও উত্তর পাশে ১০টি দোকান নির্মাণ করা হয়। এতে সড়কটির বেশ কিছু অংশ মার্কেটের ভেতরে ঢুকে যায়। অবশ্য সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়টি অস্বীকার করে পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্পোরেশনের জায়গায় ভবন নির্মাণ করে মার্কেট চালু করা হয়েছে বলে দাবি করেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারে রাস্তা দখল করে শত শত দোকান চললেও নতুন ভবনটিতে বেশিরভাগ দোকান খালি পড়ে আছে। এসব দোকান কেউ ভাড়া নিতে আগ্রহ দেখান না বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান। আবার যেসব দোকান চলছে সেগুলোতেও বেচাবিক্রি কম। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাজারের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে লোহার গ্রিল ও দেয়াল থাকায় ক্রেতারা বাজারে প্রবেশ করতে পারেন না।
সিটি কর্পোরেশনের বৈধ বাজারটি না চললেও এই বাজার ঘিরে গড়ে উঠেছে জমজমাট অবৈধ বাজার। অবৈধ এই বাজারের কারণে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেও মূল মার্কেটের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের অভিযোগ, বাজারের ভেতরে রাস্তার উপর দোকান বসিয়ে কিংবা মালামাল রেখে ক্রেতা সাধারণের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। বাজারের ভেতরে যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনার ছড়াছড়ি। ছাগল জবাই, মাছ মাংস কাটার ময়লা মিলে বেহাল অবস্থা।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, সিটি কর্পোরেশনের কাঁচাবাজার ভবনের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের রাস্তাটি এই বাজারে মানুষের চলাচলের প্রধান রাস্তা। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে মার্কেট নির্মাণের কারণে সরু হয়ে যাওয়া ৬/৭ ফুট প্রস্থ সড়কের দুই পাশে অসংখ্য ভাসমান মাছের দোকান বসানো হয়েছে। এতে করে মানুষ চলাচলে বেগ পেতে হয়। একসাথে দুজন হাঁটারও সুযোগ নেই। এই চিত্র বাজারের মুখ থেকে নিউ সিডিএ আবাসিকের মুখ পর্যন্ত।
অপরদিকে ফরিদের পাড়ার প্রধান সড়ক আকবর আলী মুন্সী লেইন। কিন্তু রাস্তার দুই পাশে শত শত অবৈধ কাঁচাবাজারের কারণে এই রাস্তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। রাস্তাটির দুই পাশে চার শতাধিক ভাসমান দোকানে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র বিক্রি করা হয়।
দোকানিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দোকান ভাড়া বাবদ দৈনিক ৪শ টাকা দিতে হয়। স্থানীয় একটি চক্র এই টাকা আদায় করে। ৪শ টাকার বাইরে প্রতিটি দোকানের জন্য ইজারাদারকে প্রতিদিন ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত হাসিল পরিশোধ করতে হয়। বিদ্যুৎ সংযোগ প্রতি লাইটের জন্য দিতে হয় দৈনিক ২০ টাকা। ঝাড়ুদারের জন্য দিতে হয় ২০ টাকা। সিকিউরিটি গার্ডের নামে আদায় করা হয় ২০ টাকা। এভাবে একেকটি অবৈধ দোকান থেকে প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ দফায় গড়ে ৮শ টাকার মতো আদায় করা হয়। একটি প্রভাবশালী চক্র এই টাকা আদায় করে নিজেদের মাঝে ভাগবাঁটোয়ারা করে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।
আকবর আলী মুন্সী লেইনের দুই পাশে গড়ে ওঠা শত শত অবৈধ দোকানের জন্য স্থানীয় বিভিন্ন ভবনের নিচতলার দোকানগুলোতে তালা ঝুলছে। বিভিন্ন আবাসিক ভবনের নিচতলায় দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দেয়ার চেষ্টা করা হলেও সন্ত্রাসীদের উৎপাতে তা তালাবদ্ধ করে রাখতে হয়েছে।
ছালেহ মঞ্জিল নামের একটি ভবনের নিচতলার একটি দোকানের মালিক জানান, ২০১২ সাল থেকে তাদের দোকানে তালা ঝুলছে। স্থানীয় একটি সন্ত্রাসী চক্র জোরপূর্বক দোকানে তালা ঝুলিয়ে দেয়। পরবর্তীতে দফায় দফায় দোকান খোলার চেষ্টা করা হলেও সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। ওই দোকানের সামনে কাঁচাবাজার বসিয়ে দৈনিক চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। তাই তাদেরকে দোকান খুলতে দেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, বহুজনের কাছে ধর্ণা দিয়েছি। অনেক আবেদন নিবেদন এবং আকুতি জানিয়েছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী এবং প্রভাবশালী চক্র পুরো বাজারকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি করছে।
শুধু ছালেহা মঞ্জিল নয়, স্থানীয় আরো কয়েকটি বাড়ির নিচতলার দোকানপাটে তালা ঝুলছে বছরের পর বছর। অপরদিকে বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাজারটি ঘিরে মাদক ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা শুরু হয়। স্থানীয় বখাটে এবং কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতাও চলছে। বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারে গড়ে ওঠা চাঁদাবাজ চক্রটি ঘাটে ঘাটে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর অপতৎপরতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
বহদ্দারহাট বাজার কমিটির সেক্রেটারি বদিউল আলম বলেন, যারা মার্কেটে দোকান নিতে পারেননি তারাই বাইরে রাস্তার পাশে ফুটপাতে বসে ব্যবসা করেন। সীতাকুণ্ডসহ গ্রামাঞ্চল থেকে টাটকা তরিতরকারি এনে তারা বিক্রি করেন। মার্কেট অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হয়েছে। সেখানে ৫ ফুট বা ৬ ফুটের দোকান। তাই মার্কেট জমেনি। কোনো ধরনের চাঁদাবাজি হয় না দাবি করেন তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ১১৩ দিন পর শনাক্তের সংখ্যা একশ ছাড়াল চট্টগ্রামে
পরবর্তী নিবন্ধআজ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস