মাল্টা ও ড্রাগন ফল আমদানি নির্ভর বিদেশি ফল হিসাবে পরিচিত ছিলো এতদিন। সে যুগ এখন আর নেই। কৃষির বৈপ্লবিক পরিবর্তনে দেশেই বাণিজ্যিকভাবে এসবের উৎপাদন হচ্ছে। সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে এবং মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, এমপি এর সঠিক নির্দেশনায় মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। দেশে বর্তমানে ফলের মোট উৎপাদন প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন। মৌসুমী ফল ছাড়াও দেশে এখন অনেক বিদেশি ফলের চাষ হচ্ছে। তার মধ্যে বারি মাল্টা-১ ও ড্রাগন ফল অন্যতম। বিদেশ থেকে প্রতিবছর চাহিদার প্রয়োজনে এসব ফল আমদানি করতে হয়। বিশেষ করে দেশে বছরের পাঁচ মাস, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে বিদেশি ফলের। এসময়ে বিদেশী ফলের চাহিদার তুলনায় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কম হলে আমদানির বিকল্প থাকে না। তবে আমদানি বাড়লে রিজার্ভের উপর চাপ বাড়ে।
বর্তমান ডলার সংকট চলছে। বৈশ্বিক সংকট তো আছেই। এমতাবস্থায় এসব ফলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে দেশেই এর উৎপাদন বাড়ানো দরকার। বাড়ছেও তাই। বারি মাল্টা-১, ড্রাগন ফল-১ ও বাউ ড্রাগন ফল ১ ও ২ এর উৎপাদন ও চাহিদা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক কৃষকের সফলতার গল্পও রয়েছে। দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা গেলে বাণিজ্যিক চাষাবাদ বাড়বে। আমদানি নির্ভরতা কমবে। ডলার সাশ্রয় হবে। অনেক শিক্ষিত কৃষি উদ্যোক্তা ও কৃষি কর্মকর্তা ফল দু’টোকে ডলার সাশ্রয়ী ফল হিসাবে আখ্যায়িত করেন। ফটিকছড়ি উপজেলার চৌকস কৃষি কর্মকর্তা হাসানুজ্জমান এর মতে মাল্টা ও ড্রাগন ফল গাছের এক একটি ফল যেন এক একটি ডলার। মনে হয় গাছেই ডলার ঝুলছে। এটি তাঁর সঠিক উপলব্ধি। তিনি বলেন, কৃষকের চাহিদার আলোকে তাদের প্রচেষ্টায় ফটিকছড়িতে অনেক বারি মাল্টা-১ ও বারি ড্রাগন ফল-১ এর বাগান গড়ে তুলেছেন। কৃষকেরা লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছেন।
এমনই একজন ফটিকছড়ির ইসলামপুরের মাল্টা চাষী শাহ আলম মুন্সীর সাথে আলাপে জানা যায়, তিন বছর আগে তিনি দুই একর জায়গায় ৫৫০ টি বারি মাল্টা-১ এর গাছ লাগান। প্রথম বছর মাল্টার সাথে কলা, পেঁপে ও মরিচ আন্তঃফসল হিসাবে চাষ করেন। একই সাথে সাথী ফসল হিসাবে লেবু গাছও লাগান। বারি মাল্টা-১ এর তিন বছর বয়সী প্রতিটি গাছ থেকে চলতি বছর গড়ে ১৫-২০ কেজি মাল্টা সংগ্রহ করেন। গত বছর প্রতি কেজি মাল্টা ৮০-৯০ টাকা দরে বিক্রি করতে পারলেও চলতি বছর দাম কিছুটা কম বলে তিনি মনে করেন। দাম কমার কারণ হিসাবে তিনি বলেন, কিছু কিছু কৃষক অপরিপক্ক মাল্টা বাজারজাত করায় এর মিষ্টতা কম থাকায় কিছুটা বদনাম হয়েছে। তার মতে বর্তমানে বিদেশি হলুদ মাল্টা প্রতি কেজি ২০০ টাকা বা তারও বেশি। বারি মাল্টা-১ পরিপক্ক অবস্থায় বিক্রি করলে এর চাহিদা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের মানুষ সতেজ ও সুমিষ্ট ভালো মানের মাল্টা খেতে পারে। মাল্টা চাষে কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও সহায়তা পান বলেও তিনি জানান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বর্তমান মহাপরিচালক ৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ তাঁর বাগান পরিদর্শন করেছেন বলে জানান ফটিকছড়ি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) মাল্টা ও ড্রাগন ফলের নিয়মিত ফলনদানকারী উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছেন। তারমধ্যে বারি মাল্টা-১ ও বারি ড্রাগন ফল-১ উল্লেখযোগ্য। বারি মাল্টা-১ বাজারে সবুজ মাল্টা হিসাবে বেশি পরিচিত। সে সাথে লাল রঙের বারি ড্রাগন ফল-১ ভোক্তাদের বেশ দৃষ্টি কেড়েছে। পরিপক্ক বারি মাল্টা-১ অত্যন্ত সুস্বাদু, রসালো ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন একটি ফল। ভিটামিন ‘সি’ সম্মৃদ্ধ ফলগুলোর মধ্যে মাল্টা অন্যতম। ড্রাগন ফলও পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি ফল। এ ফলে যে রঙিন পিগমেন্টেশন থাকে তা দেহের পুষ্টির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের সর্বমোট উৎপাদিত লেবুজাতীয় ফলের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ হচ্ছে মাল্টা। জাতীয় এক দৈনিকের সূত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানি করতে হয়েছে ৮ লাখ ২৪১ মেট্রিক টন। মোট আমদানির ৭৭ শতাংশই হচ্ছে আপেল ও মাল্টা। রামগড়ের গ্রীণ টাচ্ এগ্রো বাগানের স্বত্বাধিকারী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহমুদুল হাসান মাল্টা ও ড্রাগন ফলকে ডলার সাশ্রয়ী ফল হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেন, টেকসইভাবে এ ফল দু’টো টিকিয়ে রাখতে হলে রাজশাহীর আমের মতো সংগ্রহের সঠিক সময় বেঁধে দেওয়া জরুরি এবং চাষীদের একটি সমন্বিত উদ্যোগ থাকা দরকার যাতে নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট দামে এ মাল্টা বিক্রি করা যায়।
তিনি ২০২০ সালে ৮৫০ টি বারি মাল্টা-১ ও ২ থেকে প্রায় ৬.৫ লক্ষ টাকা আয় করেছেন। তারমতে এ ফলের স্থানীয় চাহিদা দিন দিন বাড়তির দিকে। মাল্টা ছাড়াও তাঁর বাগানে বারি ড্রাগন ফল-১ সহ আরো ২/৩ জাতের ড্রাগন ফল রয়েছে। তিনি প্রতি কেজি এ ড্রাগন ফল স্থানীয়ভাবে ২৫০-৩০০ টাকায় বিক্রি করেছিলেন। জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সূত্রমতে ২০২১-২২ অর্থবছরে মাল্টার উৎপাদন (ফসল-উত্তর ক্ষতি বাদে) ১০ হাজার টন ছাড়িয়েছে বলে প্রাথমিক তথ্যে উঠে এসেছে। প্রতি কেজি মাল্টার গড় দাম ৮০ টাকা হিসাবে ফলটির বর্তমান বাজার ৮০ কোটি টাকা। যা বর্তমান ডলারের বিনিময় মূল্য ১০০.০৯ টাকা ধরে হিসাব করলে এ পরিমাণ মাল্টা আমদানি করতে ডলার খরচ পড়বে ৭৯ লক্ষ ৯৫ হাজার ১৬১ ডলার! দেশেই মাল্টার উৎপাদন বেড়ে গেলে এ ডলার সাশ্রয় হবে অনেক। তাতে রিজার্ভও বাড়বে। অপর একটি জাতীয় দৈনিকের সূত্রে দেশে গত ছয় বছরে ড্রাগন ফলের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩১ গুণ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৯৫ হেক্টর জমিতে ৮ হাজার ৬৫৯ টন ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়। প্রতি কেজি ড্রাগন ফলের গড় দাম ২৮০ টাকা হিসাবে ফলটির বর্তমান বাজার ২৪২ কোটি ৪৫ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। যা বর্তমান ডলারের বিনিময় মূল্য ১০০.০৯ টাকা ধরে হিসাব করলে এ পরিমান ড্রাগন ফল আমদানি করতে ডলার খরচ পড়বে ২ কোটি ৪২ লক্ষ ৩০ হাজার ৫৩৬ ডলার!
বৃক্ষরোপনে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ির সফল কৃষি উদ্যোক্তা হ্লাচিং মং চৌধুরী চলতি বছর ৭ হাজার মাল্টা গাছ থেকে ১৭/১৮ টন মাল্টা বিক্রি করেন। এসবের বেশির ভাগই বারি মাল্টা-১। তিনি বারি মাল্টা-১ কে সেরা মাল্টা হিসাবে আখ্যায়িত করেন বলেন, এ মাল্টার জুড়ি মেলা ভার! তার বাগানে মাল্টা ছাড়াও চলতি মৌসুমে প্রায় ৫০০ টি ড্রাগন ফলের গাছ থেকে সাড়ে তিন টন ড্রাগন ফল সংগ্রহ করেন। তাঁরমতে বারি মাল্টা-১ ও ড্রাগন ফলের টেকসই উৎপাদন ধরে রাখতে হলে মাল্টার বেলায় আগস্টের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং ড্রাগন ফলের ক্ষেত্রে মে থেকে ডিসেম্বর প্রথম সাপ্তাহ পর্যন্ত আমদানি বন্ধ রাখা দরকার। তবে এ সময়ে চাহিদার তুলনায় দেশে এসব ফলের উৎপাদন কম হলে আমদানির বিকল্প থাকেনা বলে আমদানিকারকদের অভিমত রয়েছে বারি মাল্টা-১, বারি ড্রাগন ফল-১ ও বাউ ড্রাগন ফল ১ ও ২ এর দেশজ উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের বারি’র বিজ্ঞানী ও কৃষি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কার্যকর প্রশিক্ষন প্রদান; যৌথভাবে মাঠ পরিদর্শন, প্রদর্শনী প্লট স্থাপন, বারি মাল্টা-১ এর পরিপক্কতার লক্ষণ ও সংগ্রহের উপযুক্ত সময়ের উপর বিভিন্ন মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচারনা চালানো; উত্তম কৃষি চর্চা প্রয়োগ; এবং ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির জন্য সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে অচিরেই ফল দু’টোর আমদানি নির্ভরতা কমবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র,
বারি হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।