মালেক ভাই ও দৈনিক আজাদী

ড. মাহবুবুল হক | বুধবার , ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ

এ বছর (১৯২২) প্রবীণ সম্পাদক, দেশহিতৈষী, সমাজসেবী, সাংস্কৃতিক প্রণোদক এম এ মালেক (মালেক ভাই) সাংবাদিকতায় একুশে পদক পেয়ে চট্টগ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। গৌরবান্বিত করেছেন চট্টগ্রামবাসীদের।
দীর্ঘ ষাট বছর ধরে মালেক ভাই সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৬২ সাল থেকে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দৈনিক পত্রিকা দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ও সম্পাদক পদে সফল দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রথম যে দৈনিক পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় সেটি ছিল দৈনিক আজাদী। সেই সূত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকার প্রথম সম্পাদকের গৌরবের অধিকারীও এম এ মালেক। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রীয় পদক একুশের পদক প্রাপ্তি জাতীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতার মালেক ভাইয়ের অনন্য অবদানের স্বীকৃতি। তাঁকে অভিনন্দন জানাতে খুব ভালো লাগছে। ভালো লাগছে মালেক ভাইয়ের জীবনের সমস্ত অর্জনের নেপথ্য চালিকাশক্তি কামরুন ভাবিকেও অভিনন্দিত করতে।
বাংলাদেশের যশস্বী সম্পাদক এম এ মালেক (মালেক ভাই) ও চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা দৈনিক আজাদীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ১৯৬৫-সনে। আজাদী তখন ছাপা হতো আন্দরকিল্লায় অবস্থিত কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে, ফ্ল্যাট মেশিনে। আজাদীর অফিস তখন ছিল ঐ প্রেসের দোতলায়। প্রেস ও পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন – আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জামাতা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ হন পত্রিকাটির সম্পাদক এবং একমাত্র পুত্র আবদুল মালেক হন পরিচালনা সম্পাদক এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রেসের মালিক।
কোহিনূর প্রেসে তখন রাতে পত্রিকা ছাপা হতো আর দিনে চলত সাধারণ মুদ্রণের কাজ। এসব কাজ দেখাশোনা করতেন লোকমান ভাই (লোকমান হাকিম চৌধুরী)। তিনি খুবই মিশুক ধরনের লোক। কোহিনূর প্রেসে আমি মালেক ভাই ও লোকমান ভাইয়ের অসাধারণ আনুকূল্য পেয়েছি।
সে সময়ে অধ্যাপক খালেদ পত্রিকা সম্পাদনার সব দিক সামলাতেন। মালেক ভাই যে কেবল কাগজে-কলমে পরিচালনা সম্পাদক ছিলেন, এমন নয়। তিনি চট্টগ্রাম সরকারি বাণিজ্য কলেজ থেকে ডিগ্রি নিয়েছিলেন। আজাদী হয়ে উঠেছিল তার তাত্ত্বিক জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্র। স্বভাবতই তিনি নিয়মিত আজাদীর প্রকাশনা সংক্রান্ত সব কাজ দেখতেন। বিশেষ করে বিজ্ঞাপন ও আর্থিক বিষয় দেখাশোনার ভার নিজের হাতেই রেখেছিলেন।
সে বছরই বিয়ে করে মালেক ভাই ভাবিকে নিয়ে কোহিনূর প্রেস তথা পুরোনো আজাদী অফিসের তিন তলায় থাকতে শুরু করেন। তখনও খলিফা পট্টির বাড়ি তৈরি হয়নি। মনে পড়ে, বিয়ের কয়েক দিন পর লোকমান ভাই আমাকে ও কাসেম ভাইকে (দৈনিক আজাদীর আগামীদের আসরের পরিচালক আবুল কাসেম সন্দ্বীপ) নতুন ভাবি কামরুনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ভাবির নিজের হাতে রান্না করা চমৎকার পায়েসের কথা আজও মনে আছে। ভাবি যে কী রকম রন্ধন-নিপুণা তার পরিচয় গত পঞ্চাশ বছরে যে কতবার পেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। আমাদের দেশে রন্ধন শিল্প জনপ্রিয়তা পেয়েছে অতি সমপ্রতি এবং মূলত টিভির কল্যাণে। কিন্তু কামরুন ভাবি সত্তর-আশির দশকেই দেশ-বিদেশের রান্নার বই সংগ্রহ করে নানা রকম রান্নায় হাত পাকিয়েছেন। আমি সেই সময় ভাবিকে বলেছিলাম, আজাদীর পাতায় রান্না নিয়ে মাঝে মাঝে লিখতে। কিন্তু তিনি হেসে উড়িয়ে দিতেন। পরে বুঝেছি, লেখার চেয়ে রেঁধে খাওয়ানোতেই তাঁর আনন্দ।
পিতার অবর্তমানে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আজাদী পত্রিকাকে বাঁচিয়ে রাখাকে মালেক ভাই ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। পত্রিকার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন বলেই পত্রিকাটি দাঁড়িয়ে গেছে। হয়ে উঠেছে চট্টলাবাসীর প্রাণের পত্রিকা। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা হিসেবে।
১৯৮০-র দশকে খুব কাছে থেকে আজাদী পত্রিকার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মালেক ভাইয়ের ভূমিকা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। দেখতাম, তিনি প্রতিদিন সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যে পুরোনো আজাদী অফিসে আসতেন। স্থানীয় অন্যান্য পত্রিকায় কী কী বিজ্ঞাপন এসেছে অথচ আজাদীতে আসেনি, তা খুঁটিয়ে দেখতেন। তারপর হিসাব, অফিসের কাজ ও প্রেস সহ অন্যান্য ব্যবসায়িক লেনদেনের কাজ সম্পন্ন করতেন। এখানে তিনি নির্দিষ্ট সাংবাদিকের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন। নতুন কোনো উল্লেখযোগ্য সংবাদ জানতে পারলে তা জানিয়ে সংবদ্ধ প্রকাশ করতে বলতেন। চট্টগ্রাম ক্লাব, লায়নস ক্লাব সহ নানা ধরনের সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের সূত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তিনি পেয়ে যেতেন। এদিক থেকে আজাদীতে প্রকাশিত অনেক খবরের উৎস ছিলেন তিনি নিজে।
কোহিনূর প্রেসে কাজ সেরে তিনি চলে যেতেন মোমিন রোডে আজাদীর মূল কার্যালয়ে। সেখানে দুঘণ্টার মতো থেকে পত্রিকার সংবাদ ও বিজ্ঞাপনের কাজ দেখাশোনা করতেন। বিকেলে তিনি আর একবার পুরোনো অফিসে এবং রাত আটটার পর মূল অফিসে আসতেন। মাঝখানে তিনি নিয়মিত যেতেন চট্টগ্রাম ক্লাব, লায়নস ক্লাবের কাজে এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে।
মালেক ভাই চট্টগ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দীর্ঘকাল ধরে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায়ই তাঁকে বক্তৃতা করতে হয়। তাঁর বক্তৃতার নিজস্ব ভঙ্গি রয়েছে। বক্তৃতার জন্য সবসময় তিনি আগে-ভাগে কিছুটা প্রস্তুতি নেন। তাঁর পকেটে সব সময় একটা ছোট্ট নোট বই থাকে। তা উল্লেখযোগ্য মহৎ বাণীতে ঠাসা। তিনি বিখ্যাত রিডার্স ডাইজেস্ট পত্রিকার নিয়মিত সংগ্রাহক ও পাঠক ছিলেন। সেখান থেকেও তিনি অনেক মনীষীবাণী সংগ্রহ করেছিলেন। বক্তৃতার সময় কোনো না কোনো বাণী উল্লেখ করা তাঁর স্বভাব। তার ভেতর দিয়ে তিনি জীবনের গভীর তাৎপর্যকে ফুটিয়ে তুলতে চাইতেন।
১৯৮৭ সালের দিকে দৈনিক আজাদী আমার নৈমিত্তিক যোগাযোগের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তখন মালেক ভাই আজাদী পত্রিকার ব্যাপক গুণগত পরিবর্তন আনার কথা ভাবছিলেন। আমার মনে হয়েছিল, আমি যদি অধ্যাপনা ছেড়ে আজাদী পত্রিকায় যোগ দিতাম তাহলে বোধ হয় তিনি খুব খুশি হতেন। কিন্তু তখন আমি আমার গবেষণার কাজ শেষ করার কথা ভাবছিলাম।
মালেক ভাই মুদ্রণ প্রযুক্তির দিক থেকে পত্রিকাকে আধুনিক করার কাজ নিয়তই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ জন্যে বড় ছেলে ওয়াহিদ মালেককে লন্ডনে পাঠিয়েছিলেন মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিষয়ে লেখাপড়া করার জন্যে। ১৯৬০-এ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যখন আজাদী প্রকাশ করেন তখন তা ছাপা হতো বিচল হরফে অক্ষর বিন্যাস করে। মালেক ভাই ১৯৬৪-র দিকে স্বয়ংক্রিয় নতুন অক্ষর বিন্যাস পদ্ধতি মনোটাইপে পত্রিকা ছাপানোর কাজ আংশিকভাবে শুরু করেন। আংশিকভাবে শুরু করার কারণ, নতুন প্রযুক্তি হঠাৎ করে পুরোপুরি প্রবর্তন করলে অনেক অক্ষর বিন্যাসক বা কম্পোজিটার বেকার হয়ে পড়বে। ১৯৬৯ সালের দিকে মালেক ভাই আনেন আরও আধুনিক মুদ্রণ প্রযুক্তি। আজাদী ছাপা শুরু হয় সমকালীন সর্বাধুনিক লাইনো টাইপে। এরপর ১৯৮৮ সালে অক্ষর বিন্যাসের ক্ষেত্রে তিনি প্রবর্তন করেন আরও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি – ফটো টাইপ সেটিং। এর পরের দুই দশকে আজাদীর পৃষ্ঠাবিন্যাস ও প্রসেসিং ব্যবস্থা প্রায় স্বয়ংক্রিয় হয়ে গেছে। আর মুদ্রণের ক্ষেত্রেও ঘটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ষাটের দশকের ফ্ল্যাট মেশিন থেকে স্বয়ংক্রিয় অফসেট মেশিন হয়ে এখন আজাদী প্রবেশ করেছে রোল কাগজে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার রঙা মেটার যুগপৎ ছেপে ও ভাঁজ করে লাখ লাখ কপি বের করার অবস্থায়। ২০১০-এর দিকে চালু করা হয়েছে স্বয়ংক্রিয় প্রসেসিং ব্যবস্থা – ‘সিটিপি’ বা কম্পিউটার টু প্লেট।
বলছিলাম, মুদ্রণ প্রযুক্তির দিক থেকে আজাদী পত্রিকাকে আরও আধুনিক ও উন্নত করা এবং সাংবাদিকতার মান বাড়ানোর পাশাপাশি মালেক ভাই তখন নতুন নতুন নানা বিষয়ে আলাদা আলাদা পাতা করার কথা ভাবছিলেন। সে সময়ে জহুর ভাই (অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হক), হোসেন ভাই (অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন খান) ছাড়াও এ বিষয়ে আরও অনেকের সঙ্গে পরামর্শ করেন। আমার গবেষণার ফাঁকে ফাঁকে আজাদীর জন্যে কিছু করতে পারলে আমার ভালো লাগবে এই বিষয়টি মালেক ভাইকে খোলাখুলি জানিয়ে ‘আজাদী ফিচার’ নামে নিয়মিত ফিচার প্রকাশের প্রস্তাব দেই। তিনি সানন্দে রাজি হন। এর পর বছর দুয়েক নিয়মিত ‘আজাদী ফিচার’ প্রকাশিত হয়েছে। ইতিহাসকার ড. আবদুল করিমসহ অনেকেই সে সময়ে এর প্রশংসা করেছেন। তবু মনে হয়, কেউ না কেউ হয়তো এর বিরুদ্ধে মালেক ভাইকে বুঝিয়ে থাকবেন। অথবা হয়তো কিছু সীমাবদ্ধতার জন্য ফিচারগুলো কর্তৃপক্ষের কাছে মানসম্মত মনে হয় নি। ফলে ‘আজাদী ফিচার’ প্রকাশ এক সময় বন্ধ হয়ে যায়।
ফিচার লেখার সূত্রে অনেক নতুন নতুন লেখক সে সময়ে আজাদীর পাতায় হাজির হয়েছিলেন। আমি নিজেও অনেক বরেণ্য শিল্পী-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানীর জীবনকথা লেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার সেসব
লেখা কৃতীজন কৃতিকথা নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে এবং বইটি আমি উৎসর্গ করেছি আজাদীর পরম শুভানুধ্যায়ী আমার অত্যন্ত প্রিয় অগ্রজ অকালপ্রয়াত রম্যলেখক অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হককে।
মালেক ভাই একজন জীবন রসিক সফল মানুষ। আপাত চোখে গম্ভীর মনে হলেও তাঁর ভেতরে রয়েছে সুন্দর সরস মন। এর পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর সঙ্গে আড্ডায় – বৈঠকে, বিশেষ করে, সভা-সমিতিতে তাঁর বক্তৃতায়। বক্তৃতার শুরুতে, শেষে বা মাঝখানে হাসির কোনো প্রসঙ্গ টানা তাঁর বক্তৃতার একটা বিশেষ রীতি। তা ছাড়া তাঁর রম্যব্যঙ্গপ্রবণ মনের পরিচয় তিনি রেখে গেছেন দৈনিক আজাদীতে ১৯৮০-এর দশকে প্রকাশিত তাঁর কলামে। কলামটির শিরোনাম ছিল, ‘চোখে দেখা কানে শোনা’।
মালেক ভাইয়ের লেখার রম্য বৈশিষ্ট্য আমার ভালো লেগেছিল। তাই এ ধরনের লেখার একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশের জন্য আমি তাঁকে অনুরোধ করি। আমার পীড়াপীড়িতেই তাঁর কলামের লেখাগুলি পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত করে ১৯৮৯-সালের ১৪ই এপ্রিল প্রকাশিত হয় উল্টো থেকে বইটি। এ বইয়ের মুদ্রণ ও প্রকাশনার কাজে আমি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম। ঢাকায় একাধিকবার গিয়ে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট রনবী-র (রফিকুন্নবী) সঙ্গে দেখা করে তাঁকে দিয়ে বইটির প্রচ্ছদ করিয়ে এনেছিলাম। ঐ বছরই আজাদী মিলনাতনে এ বইয়ের একটি প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। তাতে উপস্থিত ছিলেন মালেক ভাই ও আমার প্রিয় শিক্ষক বিশিষ্ট নাট্যকার ও অভিনেতা মমতাজউদ্‌দীন আহমদ। এ বইয়ের ১৬টি রচনার শিরোনাম এ রকম : ‘পিন সমাচার’, ‘উল্টো থেকে’, ‘অ্যাকসিডেন্টাল অ্যাকসিডেন্ট, ‘চক্কর’, ‘হাইজ্যাক, ‘আন্দরকিল্লা’, ‘কিন্তু’, ‘ক্রিকেট দর্শন,’ ‘ই-ফেইল টাওয়ার’, ‘লিভিং ট্র্যাজেডি,’ ‘বোকা ছিলাম হইলাম বুদ্ধিমান’, ‘ট্র্যাজেডি’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘একটি সেমিনার ও আরেক ভাবনা।’ এসব রম্যকৌতুক রচনার মধ্য দিয়ে মালেক ভাই আমাদের সমস্যাসংকুল জীবনে হাসি ফোটাতে সচেষ্ট হন। এটা তাঁর জীবনাদর্শের একট উল্লেখযোগ্য দিক। আর এ জন্যই মনে হয়, লায়ন গভর্নর হিসেবে তিনি স্লোগান নির্ধারণ করেছিলেন – ‘ওদের মুখে হাসি ফোটাও।’
দৈনিক আজাদীর পঁয়ত্রিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে মালেক ভাই একটি অসাধারণ কাজ করেন। সেটি হল হাজার বছরের চট্টগ্রাম নামের সংকলন প্রকাশ। আমার সৌভাগ্য, সেটির সার্বিক পরিকল্পনা ও সম্পাদনার মূল দায়িত্ব মালেক ভাই ও অধ্যাপক খালেদ আমাকে দিয়েছিলেন। আমি আজাদীর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো দায়িত্বে ছিলাম না। কিন্তু মালেক ভাই ও অধ্যাপক খালেদ পুরোপুরি স্বাধীনভাবে আমাকে কাজ করার অনুপ্রেরণা ও সুযোগ দিয়েছিলেন। মাত্র মাস দুয়েকের মধ্যে বিশেষ সংখ্যাটি সম্পাদনা করে প্রকাশ করতে হয়েছিল। সে জন্যে আমি একটা খসড়া পথমানচিত্র তৈরি করে তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হই। এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছিল একাধিক বৈঠকে। অধ্যাপক খালেদকে মধ্যমণি করে মালেক ভাই, অরুণ দা (অরুণ দাশগুপ্ত), জহুর ভাই (চৌধুরী জহুরুল হক) ও আমি সে রূপরেখা চূড়ান্ত করি। তারপর কাজে নেমে যাই। সেই কাজের অভিজ্ঞতা আমার জন্যে অত্যন্ত রোমাঞ্চকর ও আনন্দের। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সংগঠকদের অবদানে ও প্রশাসনের সহায়তায় হাজার বছরের চট্টগ্রামের ভৌগোলিক পরিচিতি, পুরাকীর্তি, ইতিহাস, প্রশাসনিক দিক, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সাহিত্য, খেলাধুলা ইত্যাদি বিষয়ে একটি তথ্যসমৃদ্ধ সংকলন প্রকাশ করা সম্ভব হয়। এটির প্রকাশক ছিলেন মালেক ভাই, সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক খালেদ, অরুণ দা ছিলেন সহযোগী সম্পাদক। আমি দায়িত্ব পালন করি নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে। এ কাজের জন্যে গঠিত সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন মাহবুব হাসান, অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হক, অধ্যাপক ননীগোপাল চৌধুরী, শামসুল হোসাইন, ড. মঈনুল ইসলাম, অধ্যাপক ফজলুল হক, ড. রবীন্দ্রনাথ শীল, ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও সাংবাদিক সুখেন্দু ভট্টাচার্য। বেশ কয়েক দিন বৈঠক করে লেখাগুলোর মূল্যায়নের কাজে সহায়তা করেন দৈনিক আজাদীর কয়েকজন প্রবীণ সাংবাদিক – সাধন ধর, ওবায়দুল হক, বিমলেন্দু বড়ুয়া, কাজী জাফরুল ইসলাম, মাহবুবুল আলম, সমীর ভট্টাচার্য ও সিদ্দিক আহমদ। এ কাজে মনপ্রাণ দিয়ে খেটেছেন কবি-সাংবাদিক অরুণ দা, নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী, কবি কমলেশ দাশগুপ্ত ও সাংবাদিক সুপ্রিয় রক্ষিত। কম্পিউটারে অক্ষরবিন্যাসের কাজ সুসম্পন্ন হয়েছিল রকিবুল হকের নেতৃত্বে। আর সেসব দেখভালের কাজ করেছিলেন ওয়াহিদ মালেক ও মইনুল আলম বাদল। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পী মনসুর-উল-করিম। অঙ্গসজ্জার কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শিল্পী পীযুষ দস্তিদার। এটা সম্পাদনা ও প্রকাশের কাজে আমাকে রোজ প্রায় আঠারো ঘণ্টা করে প্ররিশ্রম করতে হয়েছে। আমাদের খুব ইচ্ছে ছিল সংকলনটি বই আকারে বের করার। কিন্তু মালেক ভাই সংকলনটি আজাদীর সমস্ত পাঠকের হাতে তুলে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তাই তাঁর যুক্তি ও সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিই। সংকলনটি এক চতুর্থাংশ ডিমাই আকৃতিতে নিউজপ্রিন্ট কাগজে প্রায় ৪০ হাজার কপি প্রকাশিত হয়। এই সংকলন ঐতিহ্য-সচেতন পাঠক ও বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষ সমাদৃত হয়, এমনকী পশ্চিমবঙ্গেও। পরবর্তীকালে যেসব পত্রিকা চট্টগ্রামের ওপর আলাদা পাতা প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছে হাজার বছরের চট্টগ্রাম তাদের খুব কাজে এসেছে।
মালেক ভাই ও দৈনিক আজাদীকে ঘিরে আমার অনেক স্মৃতি, অনেক অভিজ্ঞতা। মনে পড়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের কামরায় নিয়মিত আড্ডার কথা। আলোচনার বিষয়ের অন্ত ছিল না। সাড়া জাগানো ঘটনা, মজার ঘটনা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, নানা পরিকল্পনা – সব নিয়ে আলোচনা চলত। চলত তর্কবিতর্ক। মাঝে মাঝে আজাদীর সমালোচনাও বাদ যেত না। পরচর্চাও যে হতো না তা নয়। আজাদীর লেবু-চায়ের সঙ্গে সিঙারা বেশ মুখরোচক মনে হতো। মিষ্টি ও স্ন্যাকসের দোকান ‘হাইওয়ে’ চালু হওয়ার পর সেখান থেকে মালেক ভাই নানা রকম খাবার আনাতে পছন্দ করতেন।
অধ্যাপক খালেদের মৃত্যুর পর মালেক ভাই পত্রিকার সম্পাদক হন। সম্পাদক হওয়ার আগেও তিনি প্রায়ই সাংবাদিকদের নিয়ে বসতেন। নিজে অনেক সংবাদ-সূত্র জোগাড় করে সাংবাদিকদের দিয়ে অনুপুঙ্খ প্রতিবেদন লেখার ব্যবস্থা করতেন। সম্পাদক হওয়ার পর তাঁর সে দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। আজাদীর সাংবাদিকতার ঐতিহ্য তিনি সফলভাবে ধরে রাখতে সক্ষম হন। পত্রিকাটিকে ব্যবসা-সফল করার কৃতিত্বও পুরোপুরি তাঁর। এখন আজাদী ব্যবসার পাশাপাশি পেশাদারিত্বের ওপরও বিশেষ জোর দিচ্ছে। এটা শুভ লক্ষণ।
আজাদীর ব্যবস্থাপনায় এখন এসেছে পরিবর্তন। মালেক ভাই দূরদর্শী দৃষ্টিতে এ ক্ষেত্রে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। বিশেষ করে, পুত্র ওয়াহিদ মালেক ও কন্যা সানজিদা মালেক সোনালীকে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন ব্যবস্থাপনার কিছু কিছু দায়িত্ব। এ সব পদক্ষেপ ভবিষ্যৎমুখী ও সম্ভাবনাসূচক। এ ক্ষেত্রে আজাদীর ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের পত্রিকাটির গৌরবময় ঐতিহ্য থেকে পাঠ নিতে হবে এবং সচেতন থাকতে হবে যেন মুক্তবাজার অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাবে আজাদীর হার্দিক দিক আচ্ছন্ন হয়ে না পড়ে।
মালেক ভাইয়ের নেতৃত্বে গত পঞ্চাশ বছরে আজাদী স্বদেশ ও বিশ্বের সমস্ত জানালা নিরন্তর আমাদের সামনে খোলা রেখেছে। ঐতিহ্যের সঙ্গে সবসময় যোগ করেছে আধুনিকতাকে। প্রবীণের অভিজ্ঞতা ও সৃজনশীলতার সঙ্গে যুক্ত করতে সচেষ্ট থেকেছে নবীনের উদ্দীপনা ও স্বপ্নবিভোরতাকে। তাই আজাদীর শেকড় চট্টগ্রামে প্রোথিত হলেও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে তা বহুলাংশে জাতীয় মানের। দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে আজাদী জন্মলগ্ন থেকেই নিরপেক্ষ ও অসামপ্রদায়িক। সাংবাদিকতার আদর্শ ও ব্রতের দিক থেকে এ পত্রিকা সবসময় থেকেছে বস্তুনিষ্ঠ ও দায়বদ্ধ, নিরন্তর পালন করেছে দেশব্রতী ও মানবব্রতী ভূমিকা।
ব্যক্তিগতভাবে মালেক ভাইয়ের কাছে আমার ঋণ অনেক। ১৯৭৯ সালে আমার প্রথম বই মাক্সিম গোর্কির মা তাঁর মালিকানাধীন কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে ছাপা হয়। এ বইয়ের প্রকাশনা উৎসব আয়োজনের পেছনে ছিল মালেক ভাইয়ের প্রেরণা ও সহযোগিতা। বাংলা বানানের নিয়ম নামে আমার যে বইটি যুগপৎ বাংলাদেশ ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় তা ফটো টাইপ সেটিং-এ কম্পোজ করার কাজটি দৈনিক আজাদীতে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। দক্ষ অক্ষরবিন্যাসক শহীদুল্লার নেতৃত্বে এ বইয়ের কম্পোজের কাজ চলেছিল বেশ কিছুদিন ধরে। তা করা হয়েছিল বিশেষ ব্যবস্থায় আজাদী অফিস খোলার নির্ধারিত সময়ের আগে এবং সরকারি ছুটির দিনে। আজাদী প্রিন্টার্স থেকে চিটাগাং গাইড ছাপার ব্যাপারেও তাঁর সহযোগিতার কথা ভুলবার নয়। এ আনুকূল্য অভাবনীয়। শুধু তাই নয়, আমার পিএইচ ডি ডিগ্রি লাভের পর দৈনিক আজাদী বিশেষ অনুষ্ঠান করে আমাকে সংবর্ধনা জানিয়েছিল। এমনি আরও অনেক উদাহরণ টানা যাবে। এসব ক্ষেত্রে মালেক ভাইয়ের বদান্যতা আমি কখনো ভুলতে পারবো না।
মালেক ভাই ও কামরুন ভাবি অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। তাঁদের খলিফাপট্টির বাসায় শত আয়োজনে আমি আমন্ত্রিত হয়েছি। রন্ধন-নিপুণা ভাবির চমৎকার রান্নার আয়োজনে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়র স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। প্রতি বছর ইদের দিনে বিকেলে মালেক ভাইয়ের স্নেহভাজন বন্ধু হিসেবে নিয়মিত তাঁর বাসায় যেতাম আমি, অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান ও রম্যলেখক অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হক। দুঃখের বিষয় হোসেন ভাই ও জহুর ভাইকে আমরা চিরতরে হারিয়েছি। আর করোনা মহামারির কারণে এখন সেখানে আমার আর যাওয়া হয় না।
মালেক ভাই অত্যন্ত মনোযোগী পাঠক। তাঁর বাসভবনে আমি সেই ৮০-র দশকেই সমৃদ্ধ ব্যক্তিগত পাঠাগার দেখেছি। দৈনিক আজাদীর চার তলায়ও তিনি আজাদীর নিজস্ব লাইব্রেরি স্থাপন করেছেন। বৈশ্বিক জ্ঞানের নানা শাখায় এটি সমৃদ্ধ। তথ্য প্রযুক্তির বর্তমান ধারায় মুদ্রিত বইয়ের ভূমিকা আপাতচোখে কমে গেলেও এ ধরনের লাইব্রেরি নিঃসন্দেহে পত্রিকাকে সমৃদ্ধ করে।
মালেক ভাই চিন্তা, কর্মে, ভূমিকায় একজন সফল ও পূর্ণ মানুষ। আত্মস্বার্থপ্রবণ ও ব্যক্তিসুখকামী প্রবণতা যখন আমাদের ক্রমেই আচ্ছন্ন করতে চলেছে, তখন মালেক ভাইয়ের মতো বিরলপ্রজ মানুষই নতুন প্রজন্মের আদর্শ হতে পারে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকুশে পদকে ভূষিত হয়ে চট্টগ্রামকে সম্মানিত করেছেন
পরবর্তী নিবন্ধএম এ মালেকের একুশে পদক প্রাপ্তি ও চট্টগ্রামের গণমাধ্যম শিল্প