কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে কয়েক বছরে স্বজনহারা হওয়া তিন হাতিশাবকের ঠাঁই হয়েছিল দেশের প্রথম প্রতিষ্ঠিত কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে। এর মধ্যে গত ৪ জানুয়ারি টেকনাফ বনাঞ্চলে শাবক জন্ম দিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যায় একটি মা হাতি। তার রেখে যাওয়া শাবকটি গত বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে পার্কের বন্য প্রাণী হাসপাতালের আইসোলেশন সেন্টারে মারা যায়। এরপর নিয়মানুযায়ী ময়নাতদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন এবং বিভিন্ন অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ সংগ্রহের পর মৃত শাবকটিকে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে।
পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, গত সাড়ে চার বছরের মধ্যে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম বনাঞ্চলে একে একে স্বজনহারা হয় তিনটি হাতিশাবক। এর মধ্যে গত ৪ জানুয়ারি কক্সবাজারের টেকনাফ বনাঞ্চলে জন্মের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মাকে হারায় সদ্যজাত একটি পুরুষ শাবক (যেটি গত বৃহস্পতিবার মারা যায়)। একই বনাঞ্চলে স্ত্রী লিঙ্গের আরেক শাবক (যমুনা) জন্মের কয়েক দিনের মাথায় হারায় মাকে। তাকেও ২০২১ সালের ১০ মার্চ প্রেরণ করা হয় পার্কে। অপরদিকে বাঁশখালীর বনাঞ্চলে দলছুট হওয়ার পর দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কাদায় আটকে পড়ে গুরুতর আহত হয় পুরুষ শাবক (বীর বাহাদুর)। বর্তমানে ১৮ মাস পার হওয়া ‘বীর বাহাদুর’ এবং চার বছর পার হওয়া ‘যমুনা’ সুস্থ–সবল রয়েছে। তাদের নিয়মিত পরিচর্যা, ব্যায়াম করানোসহ যত্ন–আত্তিতে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রয়েছে দুই মাহুত। বাকি দুই শাবককে নিয়ম করে খাবার (দুধ, কলাগাছ, কলা, শসা, গাজর, মিষ্টিকুমড়া) ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা প্রদানের মাধ্যমে বড় করে তোলা হচ্ছে। হাতি শাবক মারা যাওয়ার ব্যাপারে সাফারি পার্কের বন্য প্রাণী হাসপাতালের চিকিৎসক (ভেটেরিনারি সার্জন) হাতেম সাজ্জাদ মো. জুলকার নাইন দৈনিক আজাদীকে জানান, টেকনাফ বনাঞ্চল থেকে আনার পর স্বজনহারা শাবকটিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং নিয়মিত পরিচর্যায় একজন মাহুতকে নিয়োজিত করা হয়। তখন থেকেই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তরল দুধ খাইয়ে বড় করে তোলা হচ্ছিল। সম্প্রতি হাতিশাবকটি ভাইরাল ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও সেবা প্রদান করা হলেও শাবকটিকে আর বাঁচানো যায়নি। এরপর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভেটেরিনারি সার্জন) মো. আরিফ উদ্দিনকে সাথে নিয়ে ময়নাতদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করার পর মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে।
ময়নাতদন্ত সম্পন্নকারী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আরিফ উদ্দিন জানান, হাতিটির হার্ট কাজ করছিল না। এমনকি হার্টের ভেতর রক্ত জমাট হয়ে পড়েছিল। লিভারেও মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। অল্পবয়সী এই হাতিশাবকটি ‘এলিফ্যান্ট হারপেস ভাইরাসে’ আক্রান্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাই হাতিশাবকটির মৃত্যুর অধিকতর কারণ নির্ণয়ের জন্য ময়নাতদন্তের সময় সংগৃহীত বিভিন্ন অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ ল্যাবে পাঠানো হবে।
পার্কের মাহুত সুশীল চাকমা ও বীরসেন চাকমা বলেন, স্বজনহারা এই তিন হাতি শাবককে পার্কে আনার পর থেকে নিজের শিশুসন্তানের মতো করে সেবা দিয়ে বড় করে তুলছিলাম। কিন্তু জন্মের পরপরই মা–হারা পুরুষশাবকটি চার মাসের মাথায় মারা যাওয়ায় আমাদেরও মন ভেঙে গেছে। আমরা শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি। বাকি দুই শাবককে নিয়মিত পরিচর্যা করা হচ্ছে।
ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মঞ্জুরুল আলম জানান, স্বজনহারা তিন শাবকের মধ্যে বাকি দুই শাবক স্ত্রী লিঙ্গের চার বছর বয়সী ‘যমুনা’ এবং ১৮ মাস বয়সী পুরুষ শাবক ‘বীর বাহাদুর’ পার্কের বন্য প্রাণী হাসপাতালের কোয়ারেন্টাইন শেডে যত্ন–আত্তির মাধ্যমে বড় করে তোলা হচ্ছে। এই দুই শাবক বর্তমানে শারীরিকভাবে বেশ সুস্থ ও সবল রয়েছে। আইসোলেশন সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চার মাস বয়সী পুরুষ হাতিশাবকটি মারা পড়া নিয়ে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি রুজু করা হয়েছে।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এবং ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক আবু নাছের মো. ইয়াছিন নেওয়াজ দৈনিক আজাদীকে বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধারের পর তিন হাতিশাবককে পার্কে প্রেরণ করা হয়েছিল চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের জন্য। তদ্মধ্যে অনেক চেষ্টার পরও চারমাস বয়স পেরুনো শাবকটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায়নি। বাকি দুই শাবককে বড় করে তোলা হচ্ছে মায়ের মমতায় যত্ন–আত্তির মাধ্যমে।