মারাত্মক অগ্নি ঝুঁকিতে রিয়াজউদ্দিন বাজার

ঋত্বিক নয়ন

খাতুনগঞ্জসহ নগরের ৪২টি মার্কেটেও ঝুঁকি ব্যবসায়ীরা মানছেন না কোনো বিধিমালা | শনিবার , ২৯ জুন, ২০২৪ at ৪:০৬ পূর্বাহ্ণ

নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজার ও খাতুনগঞ্জসহ অন্তত ৪২টি মার্কেট আগুনের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। বারবার অগ্নিকাণ্ডের শিকার বৃহত্তর রিয়াজউদ্দিন বাজারের নাম রয়েছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের তালিকায় সর্বাগ্রে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা কখনোই সতর্কবাণী কানে তোলেন না। উল্টো ফায়ার সার্ভিসের নিয়মিত কাজে বাধা এসেছে বিভিন্ন সময়। তবু এতটুকু ভ্রুক্ষেপ নেই কর্তাব্যক্তিদের। ফলে আবারও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে রিয়াজউদ্দিন বাজারে। গত বৃহস্পতিবার রাতে রিয়াজউদ্দিন বাজারে একটি মার্কেট ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দমবন্ধ হয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ২ জানুয়ারি ও ৮ ফেব্রুয়ারি দুই দফা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে এই এলাকায়। এর পর থেকে ওই এলাকায় বড় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির আশঙ্কা করছিল ফায়ার সার্ভিস। সেইসব ঘটনার পাঁচ মাসের মাথায় ২৭ জুন রাতে তিনজনের মৃত্যু হলো।

ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের তালিকায় অগ্নিকাণ্ডের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে রিয়াজউদ্দিন বাজার। এই বাজারে ১০ হাজারের বেশি দোকান রয়েছে। অগ্নিঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য মার্কেটগুলো হচ্ছে খাতুনগঞ্জ, জহুর মার্কেট, টেরিবাজার, তামাকুমন্ডি লেন, গোলাম রসুল মার্কেট, বাগদাদ ইলেকট্রিক সুপার মার্কেট, হাজি সরু মিয়া মার্কেট, নূপুর মার্কেট, সিঙ্গাপুর সমবায় মার্কেট, কর্ণফুলী মার্কেট, পোর্ট মার্কেট, বড় পুল বাজার, ইসা মিস্ত্রি মার্কেট, ফকিরহাট মার্কেট, নয়াবাজার মার্কেট, ফইল্যাতলি বাজার, চৌধুরী মার্কেট, মহাজন টাওয়ার, চকভিউ সুপার মার্কেট, কেয়ারি শপিং মল, গুলজার মার্কেট, আলী মার্কেট, মতি টাওয়ার, শাহেন শাহ মার্কেট, হক মার্কেট, স্বজন সুপার মার্কেট, বখতেয়ার সুপার মার্কেট, নজু মিয়া হাট মার্কেট, বলির হাট মার্কেট, ভেড়া মার্কেট, চালপট্টি, শুঁটকিপট্টি, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, মিয়া খান পুরোনো জুট মার্কেট ও ওমর আলী মার্কেট, শেখ ফরিদ মার্কেট, যমুনা সুপার মার্কেট, ষোলশহর সুপার মার্কেট, ইমাম শপিং কমপ্লেক্স এবং চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্স।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক জানান, এই মার্কেটগুলোর বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। বিশেষ করে রিয়াজউদ্দিন বাজারের অবস্থা খুবই খারাপ। কারণ এখানে একটি মার্কেটের সাথে আরেকটি মার্কেটে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। দুইশো মার্কেটই মনে হয় এক ছাদের নিচে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো একসাথে কাজ না করলে এই মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড থেকে বড় ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া তালিকায় থাকা অধিকাংশ মার্কেটের গলি সরু। পানিও পাওয়া যায় না। ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় এসব এলাকায় যন্ত্রপাতি নিয়ে দ্রুত পৌঁছানোও কঠিন। আমরা ব্যবসায়ীদের প্রায় সময়ই সচেতন করি। কিন্তু সচেতন হন না। কেউ হাজার টাকা দিয়ে একটি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রও কেনেন না। অথচ পরে হারান লাখ টাকার জিনিস, যোগ করেন তিনি।

আইনে অগ্নি নির্বাপনে তিন স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। প্রথম স্তরের মধ্যে রয়েছে প্রত্যেক ৫৫০ বর্গফুটের জন্য একটি করে ফায়ার এক্সটিংগুইসার (অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র) রাখতে হবে। এটির ওজন ৫ কেজির কম নয় আবার ৮ কেজির বেশি নয়। দ্বিতীয় স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রয়েছে প্রতি ১০ হাজার বর্গফুটে একটি করে হোস রিলস (পানি চলাচলের পাইপ) এবং তৃতীয় স্তরে রয়েছে একটি হাইডেন কাম রাইজার, একটি ডিজেল চালিত পাম্প ও পানির চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য জোকি মেশিন থাকতে হবে। অধিকাংশ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের নিরাপত্তা বিধি মানা হলেও ব্যয় সংকোচনের জন্য মানা হচ্ছে না তৃতীয় স্তরের নিরাপত্তা বিধি। অথচ এটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজার, তামাকুমন্ডি লেন ও জহুর হকার্স মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, এসব মার্কেটের সড়কগুলো এত সরু ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপক গাড়ি প্রবেশের কোনো সুযোগ নাই। এছাড়া আগুন নেভানোর জন্য পানির কোনো উৎস নেই। অথচ এসব মার্কেটে ইলেকট্রনিক্স, কাপড়, জুতো, কসমেটিকস এবং নানা ধরনের পণ্য সামগ্রীর প্রায় দুই হাজারের অধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অন্যদিকে বেশিরভাগ মার্কেটের দ্বিতীয় তলা থেকে উপরের দিকে গুদাম এবং কোনো কোনো ভবনের উপরের অংশ আবাসিক হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে। আবার দেখা যায়, মার্কেট ও ভবনগুলোর গা ছুঁয়েই বিদ্যুতের তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কোনো কারণে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে এসব মার্কেটে আগুন লাগলে বিপুল পরিমাণ সম্পদহানির আশঙ্কা আছে। ভবন থেকে বের হতে না পেরে ধোঁয়ার কারণেও মৃত্যুর আশঙ্কা আছে, যা গত ২৭ জুন সত্য হলো তিনজনের মর্মান্তিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, প্রত্যেকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখার কথা আইনে বলা হলেও কিন্তু অধিকাংশ ব্যবসায়ী সেই আইন মানেন না। অনেক প্রতিষ্ঠানে ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকলেও তা মেয়াদোত্তীর্ণ। এছাড়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে ফায়ার লাইসেন্স নেই। অগ্নিকাণ্ড রোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে শপিং সেন্টারগুলোতে স্বয়ংসম্পূর্ণ অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকা, জরুরি প্রস্থানের সিঁড়ির সংখ্যা ও ছয়তলার ওপরে প্রতি তলায় সেফটি লবির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে বৈদ্যুতিক তারে কনসিল ওয়্যারিং থাকা, বৈদ্যুতিক মেইন সুইচ বক্স ও ডিমান্ড বক্সের নিরাপদ অবস্থানে থাকা এবং স্মোক ও হিট ডিটেক্টর এবং মার্কেটের ব্যবসায়ী ও কর্মীদের নিয়মিত অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ রাখার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা থাকলেও ব্যবসায়ীরা তা মানছেন না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বোর্ডে অংশ নিচ্ছে ১ লাখ ৬ হাজার পরীক্ষার্থী
পরবর্তী নিবন্ধআগস্টে বিদেশ যাওয়ার আগেই রিদুয়ানকে কেড়ে নিল আগুন