মারাকানায় মেসির স্বপ্নপূরণ

ব্রাজিলকে কাঁদিয়ে শিরোপা উল্লাসে মাতল আর্জেন্টিনা

ক্রীড়া প্রতিবেদক | সোমবার , ১২ জুলাই, ২০২১ at ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

একটা শিরোপার জন্য ২৮ বছর অপেক্ষা। দুটি কোপা আমেরিকা কাপ এবং একটি বিশ্বকাপের ফাইনাল থেকে খালি হাতে বিদায় মাত্র চার বছরের ব্যবধানে। তার উপর এবারের কোপা আমেরিকা কাপের ফাইনালে প্রতিপক্ষ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল। বিশ্বসেরা ফুটবলার লিওনেল মেসির ক্যারিয়ারের জন্য এই শিরোপাটি ছিল খুব বেশি প্রয়োজন। তার উপর ২০১৪ সালে এই মারাকানা স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফাইনালে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল। ১৯৯৩ সালে যে কোপা আমেরিকা কাপের ট্রফিটা ছিল শেষ ট্রফি সেই ঐতিহাসিক মারাকানায় সেই কোপা আমেরিকা কাপের শিরোপা পুনরুদ্ধার করে আবার ফুটবল বিশ্বকে রাঙ্গিয়ে দিল আর্জেন্টিনা। ব্রাজিল- আর্জেন্টিনা ফুটবল কিংবা ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট মানে পুরো বিশ্ব দুইভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া। যার একভাগের কপালে জুটে শুধুই আনন্দ আর আনন্দ আর অন্য ভাগের কপালে জুটে হতাশা আর যন্ত্রণা। যেমনটি গতকাল জুটেছে ব্রাজিলিয়ানদের কপালে। রিও ডি জেনেরির আকাশ যখন আতশবাজির আলোয় যতই উদ্ভাসিত হচ্ছিল ততই যেন গাঢ় অন্ধকার নেমে আসছিল ব্রাজিলীয়ানদের মাঝে। আর্জেন্টিনার আকাশী-নীল জার্সিটা যতই উদ্ভাসিত হচ্ছিল ততই যেন মলিন হতে থাকে ব্রাজিলের হলুদ-নীল জার্সিটা। মেসি-ডি মারিয়া-মার্টিনেজরা যখন আনন্দ উল্লাসে প্রকম্পিত করছিল মারকানাকে তখন নেইমার-থিয়াগো কিংবা ফিরমিনোরা যেন মাটি ফেটে ভেতরে ঢুকে যেতে পারলেই বাঁচে। একেতো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার কাছে হার। তাও আবার নিজেদের মাঠে। সেটাও আবার সেই ১৯৭৫ সালের পর প্রথম দেশের মাটিতে কোপা আমেরিকা কাপের ফাইনালে হারল ব্রাজিল। করোনায় জর্জরিত দেশটি কোপা আমেরিকা কাপ আয়োজন করেছিল কঠিনতম এই সময়ে দেশের মানুষকে শিরোপা জিতে একটু আনন্দ দেওয়ার আশায়। সে আশাও পূরণ হলো না ব্রাজিলের। সব মিলিয়ে নিজেদের ফুটবল ক্যারিয়ারে যেন কঠিনতম একটি দিন পার করেছে গতকাল ব্রাজিল। কারণ কোপা আমেরিকা কাপের ফাইনালে ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারিয়ে ২৮ বছর পর শিরোপা খরা কাটাল আর্জেন্টিনা। মেসি নামক ফুটবল যুবরাজের সাফল্য মুকুটে যোগ হলো বড় একটি পালক। যে পালকটির জন্য দীর্ঘদিন তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করেছিলেন ফুটবল রাজপুত্র। তাইতো কোপা আমেরিকা কাপের স্বপ্নের ট্রফি নিয়ে এত পাগলামি মেসির।
মেসির মত ফুটবলার যে দলে থাকে সে দলে আর কারো পাদপ্রদীপের আলোয় আসাটা বেশ কঠিন। যেমনটি পারেননি ডি মারিয়া কিংবা অ্যাগুয়েরোরা। কিন্তু ব্রাজিলের বিপক্ষে স্বপ্নের ফাইনালে ঠিকই সব আলো কেড়ে নিলেন সেই ডি মারিয়া। কারণ তার গোলেই যে ২৮ বছর পর শিরোপা জিতল আর্জেন্টিনা। তাই শিরোপা জয়ের আনন্দে মধ্যমনি মেসি হলেও ডি মারিয়েকে নিয়েও কম মাতামাতি হয়নি। তবে আর্জেন্টিনার এই শিরোপা যেন মরুর বুকে এক ফসলা বৃষ্টির মত। যে বৃষ্টি অসীম আরাধ্যের।
আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ম্যাচ মানে মাঠের লড়াইয়ের বাইরেও অনেক লড়াই। যেমনটি গতকালের লড়াইটি মেসি-নেইমারের লড়াই ছাড়াও তিতে-স্কোলনির লড়াই। তার বাইরে এই লড়াই পৌঁছে গিয়েছিল ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত। কারণ আগের দিন তিনি ভবিষ্যদ্বানি করেছিলেন আর্জেন্টিনাকে ৫-০ গোলে হারাবে ব্রাজিল। কাজেই বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় কতটা মর্মস্পর্শী এই দু’দলের লড়াই। দিন শেষে সবকিছুকে ছাপিয়ে বিজয়ীর নাম আর্জেন্টিনা। নায়কের নাম লিওনেল মেসি। এই দু দলের ম্যাচ মানে স্নায়ুর লড়াইও। তবে গতকালের ফাইনালে সেই স্নায়ু যুদ্ধে বারবার হেরে গেছে দু দলের ফুটবলাররা। অন্তত একের পর এক হলুদ কার্ড তারই প্রমাণ। তারপরও ফুটবলের অনুপম সৌন্দর্য ঠিকই অবগাহন করেছে বিশ্বের কোটি কোটি দর্শক। ব্রাজিলের শৈল্পিক আর আর্জেন্টিনার নান্দনিক ফুটবলটা হয়তো শতভাগ মেলেনি। তারপরও লড়াইটা যখন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার তখন আনন্দের তো আর শেষ থাকে না। কারণ এই দু’দলের ফাইনাল খেলাটাও যে অনেক আরাধনার।
এমন ম্যাচে সুযোগ মেলে কম। যে দল সুযোগ কাজে লাগাতে পারে তারাই দিন শেষে হাসতে পারে। যেমনটি গতকাল হেসেছে আর্জেন্টিনা। সুযোগ যেমন এসেছিল আর্জেন্টিনার সামনে তেমনি এসেছিল ব্রাজিলের সামনেও। কিন্তু ব্রাজিল পারেনি তাদের সে সুযোগকে কাজে লাগাতে। অথচ খেলার ১৩ মিনিটে প্রথম সুযোগটা ব্রাজিলই পেয়েছিল। রিশার্লিসনের পাসটা আর্জেন্টিনা পেনাল্টি বঙের কাছে পেয়েছিলেন নেইমার। কিন্তু ঠিকমত শট নিতে পারেননি পিএসজির এই তারকা। তবে ২১ মিনিটে মারকানার স্বল্প সংখ্যক দর্শকসহ বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি ব্রাজিল সমর্থককে স্তব্দ করে দেন ডি মারিয়ো। নিজেদের অর্ধ থেকে ডান দিকে অসাধারণ এক ক্রস করেন রদ্রিগো ডি পল। হাওয়ায় ভেসে আসা বলটি অসাধারণ দক্ষতায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আগোয়ান ব্রাজিল গোল রক্ষকের মাথার উপর দিয়ে ডি মারিয়া বলটি যেভাবে জালে পাঠালেন তা ছিল এক কথায় দৃষ্টি নন্দন। এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। ২৯ মিনিটে আরো একবার ব্রাজিলকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন ডি মারিয়া। এবার ডি বঙের বাইরে থেকে তার শট ফিরিয়ে দেন ব্রাজিল অধিনায়ক থিয়াগো সিলভা।
বিরতির পর আর্জেন্টিনাকে চেপে ধরে ব্রাজিল। সে সুযোগে ৫২ মিনিটে সমতাও ফিরিয়েছিলেন রিশার্লিসন। কিন্তু তিনিই অফসাইডে থাকায় সে গোল বাতিল হয়ে যায়। হতাশা যেন আরো বেশি ভল করে ব্রাজিল শিবিরে। গোল বাতিলের দুই মিনিট পর প্রায় একই জায়গায় আবারো বল পান রিশার্লিসন। শটও নিয়েছিলেন। কিন্তু এবার বাধার দেওয়াল হয়ে দাঁড়ালেন সেই মার্টিনেজ। যিনি কলম্বিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালে তিনটি পেনাল্টি শট ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। সময় যতই গড়াচ্ছিল ততই যেন রক্ষণাত্মক হয়ে উঠছিল আর্জেন্টিনা। আর তার সুফলটা ঠিকই ঘরে তুলেছে স্কোলানির
শিষ্যরা। ৮৭ মিনিটে দারুণ এক ফ্রিকিক নিয়েছিলেন গ্যাব্রিয়েল বারবোসা। কিন্তু এবারো আর্জেন্টিনার ত্রাতা সেই মার্টিনেজ। তবে ম্যাচের সবচাইতে অমার্জনীয় মিসটা করেন মেসি। খেলার ৮৮ মিনিটে সতীর্থের বাড়ানো বল ডি বঙে পেয়ে গিয়েছিলেন মেসি। সামনে কেবলই ব্রাজিল গোল রক্ষক। কিন্তু তালগোল পাকিয়ে মেসি বল তুলে দিলেন গোল রক্ষকের হাতে। তবে মেসির সেই মিস তেমন ক্ষতির কারণ হয়নি ব্রাজিলের জন্য। অতিরিক্ত ৫ মিনিটেও ব্রাজিল পারেনি গোল আদায় করতে। ফলে পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়েছে। ২৮ বছর পর আর্জেন্টিনা যেমন আবার কোপা কাপের শিরোপা জিতেছে তেমনি ৪৬ বছর পর ব্রাজিল নিজেদের মাঠে হারল কোপার ফাইনালে। স্বপ্নের ট্রফি ফিরে পাওয়ার আনন্দে যখন মাতোয়ারা মেসিরা তখন হারানোর যন্ত্রণায় কাতর নেইমাররা। এই টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনা দলের অঙিজেন যে ছিলেন মেসি সেটা প্রমাণ করে তার টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় এবং সর্বোচ্চ গোল দাতার পুরস্কার জয়ে। ফাইনালের সেরা ডি মারিয়া আর টুর্নামেন্টের সেরা গোল রক্ষক আর্জেন্টিনার মার্টিনেজ। শিরোপার সাথে সবকিছু জিতেই দেশে ফিরল লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা পেল ৫৫ কোটি টাকা
পরবর্তী নিবন্ধব্রাজিলের পরাজয়ে নয় প্রেমিকাকে হারানোর ভয়ে কামালের বিষ পান