ভোরে উঠে বারান্দায় বসতেই মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠলো। সবকিছু যেনো অন্যরকম ভালো লাগা। হালকা ঠাণ্ডা, কুয়াশার ঘোলাটে আকাশ আর পাখির কিচিরমিচির শব্দের সাথে গাছের পাতার সবুজের হাতছানি। চোখে বেশ আরাম লাগছে। চারিদিকে কেমন শান্তি আর শান্তি অনুভব করছি।
অন্যদিন কাজ সেরে চা নিয়ে চেয়ারে বসি। কাজ বলতে দুই ছেলে, একজন অফিস, আরেকজন ইউনিভার্সিটি যায়। তাদের জন্য সকালে উঠে রান্না করে, টিফিনবঙে ভরে, হাতে তুলে দিই। যাবার সময় দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। সব মা‘রা যেমন করে তাদের সন্তানরা বের হবার সময়, প্রার্থনা করি ঠাকুরের কাছে। ওরাও বের হবার সময় পায়ে ধরে প্রণাম করে তারপর বের হয়। এটা রোজকার অভ্যাসের মধ্যে একটা।
কিন্তু আজকে চেয়ার থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। ভাবলাম ছেলেদের বলবো আজ কিছু রান্না হয়নি তোরা বাইরের থেকে কিছু খেয়ে নিস।
যদিওবা এই রান্না না করার কাজ মাসে দু‘একবার হয়। যখন বলি রান্না করতে ইচ্ছে করছে না, তখন ছেলে হোক বা ছেলের বাবা বাইরের থেকে খাবার অর্ডার করে দেয়। তবে সবাই বাসায় থাকলে। সবসময় চেষ্টা করি নিজের করা রান্না খাওয়াতে।
বারান্দায় মনের সুখে বসে আছি। গুনগুন গান করছি। দিন ফুরোলো সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে! এটা দাদু সবসময় গাইতেন। তাই আমার শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে। একটু পর ভাবছি দূর…..কী গাইছি এইসব, লোকে শুনলে হাসবে। এমনিতেই এখন তো সকাল….সন্ধ্যে হলো কই!
একটা পাখি কোত্থেকে এসে প্রথমে আমার জামার উপর তারপর হাতে, তারপর পায়ে কী যেন কুটকুট করে খেতে লাগলো। আমিও পাখি চলে যাবে ভেবে স্ট্যাচুর মতো চুপ করে বসে রইলাম। আমার আনন্দ হচ্ছে খুব। কতোদিন ধরে পাখিকে খাবার দিচ্ছি, হাত দিয়ে ধরতে চেয়েছি, পারিনি। কখনো এভাবে সামনে আসেনি, দেখার সাথে সাথে পালিয়েছে। আজকে কী হলো কী জানি!
একটু পর পাখিটা উড়ে চলে গেলো। চায়ের খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। অনেকদিনের পুরনো অভ্যেস বারান্দায় বসে চা খাওয়া! রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ পাচ্ছি। ছেলেরাই হবে। ডেকে বললাম কে আছিস রান্নাঘরে, আমার জন্য এককাপ চা নিয়ে আয় তো!
এই কাজটা অবশ্য বড়ছেলে, ছোট ছেলেকে দিয়ে মাঝেমধ্যে করাই। বলি রোজ তোদের আমি করে দিই আজ তোরা কেউ আমাকে করে দিবি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি, কেউ আসে না।
কী হলো ব্যাপারটা! এরকম তো হয় না কখনো। আরেকটু বসে বকা দিতে দিতে রুমের ভেতর গিয়ে দেখি বড়ছেলে, ছোটছেলে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে! বুকটা ধক করে উঠলো। কী হলো? কাছে গিয়ে আমিও তাদের জড়িয়ে ধরলাম। জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে? কেউ উত্তর দিচ্ছে না। আবার জিজ্ঞেস করলাম, বলছিস না কেন! কী হয়েছে বলবি তো! ছেলেরা কথার উত্তর দিলো না!
গৌতমকে গিয়ে বললাম, ছেলেরা কাঁদছে কেন একটু দেখো। আর তুমিই বা কেন মনমরা হয়ে বসে আছো! কী হয়েছে সবার?
গৌতমও কোন কথার উত্তর দিলো না। এমনিতেই শাশুড়ি মায়ের শরীর খুব একটা ভালো থাকে না আজকাল। তাই টেনশন তো একটু থাকেই।
ভাবছি কিছুক্ষণ বসে থাকার মজা এখন বের হবে। দূর… রোজ রোজ কাজ করতে আর ভালো লাগে না। চারদিকে সব কাজ ছড়ানো ছিটানো হয়ে পড়ে আছে। বুয়া আসার কলিং বেল বেজে উঠলো। ছোটছেলে দরজা খুলে দিলো। ফাঁকিবাজ বুয়া একঘণ্টার মধ্যে সব কাজ শেষ করে চলে গেলো। রোজ বলে যায় দিদি আসি, আজ আমাকে সামনে দেখেও কিছু বলে গেলো না। মনে মনে বলছি, তোদের যা ইচ্ছে কর, কিছু বলবো না।
মাস্টার বেডের পাশে একটা বড় আয়না আছে, আমি সেই আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখতে পাচ্ছি না। হাত পা নাড়লাম, তাও না! ছেলেদের ডাকলাম, কেউ আসছে না, আমার কোন কথায় তাদের কানে যাচ্ছে না।
কী হলো! কিছুক্ষণ পর বুঝলাম, আমি না– আমার আত্মা, আমার মায়া সবার চারদিকে ঘুরছে। আমার এখানে থাকা আর ঠিক হবে না! ঘুরে ঘুরে হাতেগড়া সবকিছু দেখলাম। চিৎকার করে কাঁদলাম। কান্নার শব্দ শোনার কাউকে পেলাম না!
মায়া বড়ই অদ্ভুত! মৃত্যুর পরও ছেড়ে যেতে চায় না। জোর করে ত্যাগ করতে হয়!