‘হায় হায় কী সর্বনাশ হলো গো!’
ভোরের নিস্তব্ধতা চিরে নারী কণ্ঠের বুকফাটা আর্তনাদ সবুর আলীর কানে এসে ধাক্কা দেয়। ভোরের দিকে সবুর আলী তলপেটে জব্বর চাপ অনুভব করে। এই সময়টিতে তাকে একবার উঠতেই হয়। মাত্রই সে হালকা হয়ে কাঁথার ওমে ঢুকেছে। কান্নার আওয়াজে ত্রস্তে বিছানায় উঠে বসে। বোঝার চেষ্টা করে কোন বাড়ির বেটিছাওয়ালটা কাঁদছে। পুবদিকে পরেশ কুমার প্রামানিকের বসতভিটে। তার মনে হলো, ‘শব্দটা ওদিক থেকেই আইলছে। আহা! কী সর্বনাশ হইলছে?’ লুঙ্গিটা সামলে উঠে দাঁড়ায় সবুর আলী। দ্রুত ওঠার কারণে কাঁথা সরে যায়, বউ বিরক্তিসূচক শব্দ করে পাশ ফিরে। দড়িতে ঝুলন্ত আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে সে দাওয়ায় বেরিয়ে আসে। এখনও জাড় শুরু হয়নি। হাড়ে দাঁত বসানোর মতো ধারালো জাড় শুরু না হলেও ভোরের দিকে গরম কাপড়ের দরকার পড়ে। সবুর আলীর উর্দ্ধাংশ আলোয়ানের উষ্ণতায় থাকায় ঠান্ডা হাওয়া মওকা পেয়ে লুঙ্গির নিচ দিয়ে কামড় বসায়। প্রস্রাব করতে গিয়েও একবার কামড়টা খেয়েছে। আরেক দফা খেয়ে খিস্তি করে। কার উদ্দেশ্যে সে’ই জানে।
সুনসান উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একবার চারপাশটায় চোখ বুলায় সবুর আলী। এরপর পুবদিক লক্ষ্য করে গুটি গুটি পায়ে হাঁটা দেয়। নিকানো দাওয়ায় হাত পা ছড়িয়ে পরেশের বউ মালতিকে কাঁদতে দেখে বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। ‘আহা! তবে কী পরেশটো’ মালতি শান্ত স্বভাবের মৃদুভাষী মেয়ে। বহুদিনের পড়শি হিসেবে সবুর আলী কখনও তাকে উচ্চকণ্ঠ হতে শোনেনি। আজ সাতসকালে মালতি কোন শোকে কাঁদতে বসেছে? বিলাপরত মালতির মুখ থেকে ঘটনা শুনে বিমূঢ় বনে যায় সবুর আলী। ধাতস্থ হতেই পড়িমরি করে ছুট দেয় জমির দিকে।
ক্রমে দিনের আলো ফোটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আহাজারি বাড়ে। মাতমের আওয়াজ পুব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণের ঘরগুলোতে চক্রাকারে পাক খেয়ে গোটা গ্রামটাকে শোকবিধুর করে তোলে। উঠানে উঠানে জড়ো হয় উৎকণ্ঠিত কৌতূহলী মুখ। এমন হৃদয় বিদারক ঘটনায় কী সান্ত্বনা দেওয়া যায়! ভাষা হাতড়ে না পেয়ে অনেকেই কেমন তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে নিচুকণ্ঠে ফিসফাস করে। জমায়েতের মানুষগুলো যতটা না শোকে আক্রান্ত তারচেয়ে বিস্ময়ে অধিক হতবাক।
সব্বোনেশে ঘটনার প্রথম সাক্ষি পরেশ কুমার প্রামানিক। বরাবরই তার কাকভোরে জেগে ওঠার অভ্যাস। প্রাতঃকৃত সেরে দাওয়ায় বসে সে জপতপ করে কিছুক্ষণ। বাটিতে মুড়ি নিয়ে একা বসে চিবায়। বউ উঠলে ভরপেট আহারদি সেরে মাঠে যায়। তার আগ পর্যন্ত কোনো বিঘ্ন না ঘটিয়ে বউটাকে ঘুমাতে দেয়। বউটা সারাদিন সংসারের পেছনে খাটে। উপযুক্ত ঘুম দরকার। কাকভোরে পরেশের বিছানা ছাড়ার অভ্যাস নিয়ে মালতি আগে খুব বেজার হতো। জমিজিরেতে দিনরাত ঘাম ঝরাও। হাড়মাস কালা করে একাই পাঁচজন মুনিশের খাটুনি খাটো, ঠিক মতো বিশ্রাম না কইরলে শরীর টিকব্যে! বউয়ের ঝাঁঝধরা কথার ভেতর মুখগুঁজে থাকা ভালোবাসাটুকু ঠিকই বুঝতো পরেশ। কোনো বাক্যালাপে না গিয়ে হাসি দিয়ে বউকে ভোলাতে চাইতো। মালতি বকাঝকা করেও স্বামীর স্বভাব পাল্টাতে পারেনি। পরের দিকে মালতি আর উচ্চবাচ্যে যায়নি।
ষোল বছরের বিবাহিত জীবনে মালতির কোল জুড়ে কোনো সন্তান আসেনি। পরেশের ধারণা হয়তো তার কলকব্জায় কোনো খামতি ছিল। মালতি আড়ালে অশ্রুপাত করে ভাবতো তারই কোনো দোষে বুঝি স্বামীকে বাবা হওয়ার সুখ থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। এতটা সময় গড়িয়েছে, এখনও কয়েক গজ দূরত্বে বাস করা জ্ঞাতিদের মুখনাড়া শুনতে হয় মালতিকে। দিনের শুরুতে বয়োজ্যেষ্ঠরা ওর মুখ দেখাকে অকল্যাণ মনে করে। অথচ পরেশ কোনোদিন সন্তান না হওয়া নিয়ে ওর উদ্দেশ্যে টুঁশব্দও করেনি। মনে মনে স্বামীর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নাই মালতির। সন্তান না থাকার চাপা দুঃখ বাদে নির্ঝঞ্ঝাট গৃহস্থের জীবন তাদের। বাগানের গাছগুলোকে অপত্য স্নেহে ফলবতী করে তোলাতেই আনন্দের সন্ধান পেয়েছে। চাষবাসে যত্ন–আত্তির ছকে তাদের জীবন বাধা। শুধু তাদেরই বা কেন, মহেশপুরের আর দশজনের জীবনও ওই একই বৃত্তে ঘোরে।
অন্যান্য দিনের মতো আজও ঘুম ভেঙে দাওয়ায় বসেছিল পরেশ। কী মনে হতে জমির দিকটায় হাঁটতে গিয়েছিল। ধ্যানস্থ ভোরের শরীরে দুধের পাতলা সরের মতো ভেসে থাকা কুয়াশার মিহি পরত ঠেলে, মাঠে গিয়ে পরেশ হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। দিশেহারার মতো দৌড়ে বাড়িতে এসে সে যখন দাওয়ার উপর আছড়ে পড়ে, মালতির ঘুম তখনও ভাঙেনি। স্বামীর হাউমাউ কান্নায় ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসেছিল মালতি। তার হৎপিণ্ডটা বেখাপ্পাভাবে ধড়াস ধড়াস শব্দে কাঁপতে থাকে। স্বামী তাকে সর্বনাশের বৃত্তান্ত শুনিয়ে জ্ঞাতি ভাইদের খবর দিতে ছুটে যায়। শোকে দিশেহারা মালতি মিহি কণ্ঠের আর্তনাদে ভোরের স্নিগ্ধতা ছিঁড়েখুঁড়ে দিতে থাকে। ‘কাখে বুলি, কে করলে এমন সর্বনাশ ভগবান…’
পরেশের লাগোয়া জমিতে জ্ঞাতিভাই মলয় আর অজয় নিজেদের হিস্যায় চাষবাস করে। তিন ভাইয়ের পাশাপাশি জমিতে সারবাধা ফলবতী আমগাছ। মহেশপুর গ্রামের ঘরে ঘরে আমচাষী। এই গ্রামে এমন বাড়ি খুব কমই আছে, যে–বাড়ির আঙিনায় আমগাছ নাই। গাঁয়ের নিচু জমিগুলোতে আগে বছরে তিন ফসল ফলতো। তাতে খাজনার চেয়ে বাজনায় অর্থ বেশি যেত। শস্যাদির ফলনও আহামরি এমন হতো না যাতে লাভের মুখ দেখা যায়। পাঁচ মণ ধানের তুষ দুই আড়াই মণ। যে চাল ঘরে উঠতো তাতে বছরকার খোরাকি চলবে নাকি বিক্রিবাট্টা করবে। ধারকর্জে জেরবার হচ্ছিল চাষীরা। স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শে পরেশ, সবুর, জয়নুলরা তখন তিনফসলের চাষ বাদ দিয়ে আম চাষে নামে। লাভের হাতছানিতে বিপদের ঝুঁকিও ছিল। ঝুঁকি মেনে নিয়েই তারা চাষে নেমেছিল। উপযুক্ত সময়ে গাছ প্রতি যখন তিন চার মণ আমের ফলন দেওয়া শুরু করলো, চাষীদের আনন্দ তখন দেখে কে। শস্য ফলনের চেয়ে ফলের চাষে অধিক লাভ দেখে আরো অনেকেই আম চাষে ভিড়লো। এরমধ্যে উনিশ বছর গড়িয়েছে। মারী শুরুর আগে আর পরের দু’বছর আমের ফলন তেমন ভালো হয়নি। এদিকে মারী পরবর্তী সময়ে শস্যাদির দাম আকাশ ছোঁয়ায় কিছু চাষী আবারও তিন ফসলের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। গ্রামের মাতব্বর তরফদারের তাতে ইন্ধন ছিল। তার জমির চারপাশে আম গাছের ছায়া ফসল ফলনে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। এই অভিযোগ সামনে রেখে, দেনদরবার করে তরফদার কিছু চাষীর তিনফসলি জমি উদ্ধারে সফল হলেও অধিকাংশকেই রাজি করানো যায়নি। তাদের এক কথা, নিজ হাতে সন্তানের মতো বড় করেছে গাছগুলোকে, জান থাকতেও কাটবে না। নাখোশ হয়ে তরফদার ফিরে গেছে। গত মাসের কথা এসব।
নিশ্চুপ বসে সবুর আলী সেসব কথা ভাবছিল। গাঁ শুদ্ধ সবাই যখন গভীর ঘুমে তখনই অজানা পিশাচেরা কাজটা করে গেছে। বসতভিটা থেকে আমবাগান দূরত্বে থাকায় কেউ জানতেও পারেনি দিনের আলোয় কোন অন্ধকার মুখগুঁজে অপেক্ষা করছে। সবুর আলী পরেশের বাড়ি থেকে সেই যে ছুটে জমিতে এসেছিল, সূর্যটা চনমনিয়ে মাথার উপর উঠে এলেও তাকে নড়ানো যায়নি। গায়ের আলোয়ানটা কোথায় পড়ে গেছে সে খেয়ালও নাই। অধিক শোক তাকে পাথর করে দিয়েছে। ঘুম ভেঙে লোকমুখে ঘটনা শুনে বউ, ব্যাটা বেটি এসে উপস্থিত হয়েছে। সাধাসাধি করে কয়েক ঢোক পানি ছাড়া তাকে কিছু খাওয়ানো যায়নি। ‘এতটো বেলা হইলছে মানুষটো না খেয়ে’। কাঁদতে কাঁদতে বউ মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। বাপের পাশে দাঁড়ানো সবুর আলীর বড় ব্যাটার বুকটা টাটায় রূপজানের জন্য। ভাবে, রূপজান ফুপুরও বুঝি ফুপাজানের মতো মাথাটো বিগড়েইলছ্যা।
রূপজানের আহাজারিতে চোখের জল সামলানো দায়। তার বাকহীন স্বামী জয়নুল বার কয়েক নিজস্ব ভাষায় বউকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে ক্ষান্ত দিয়েছে। অসহায় ভঙ্গিতে নিথর বসে থাকা জয়নুলকে বাজপড়া বৃক্ষের মতো দেখায়। বোবা দৃষ্টি মেলে সে দেখতে থাকে ক্রন্দনরত রূপজান দুহাতে বুকে সজোরে থাবড়া দিচ্ছে আর মাঠময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ‘কাখে বুইলবো, কাখে বিচার দিব্যো’র মাতমে কাকগুলোও উড্ডয়ন ভুলে গাছে–গাছে শব্দহীন বসে থাকে।
মহেশপুর গ্রামের নিতান্তই সাদাসিদে মানুষগুলো কারো সাতেপাঁচে থাকে না। তাদের এমন কোনো একক কিংবা দলবদ্ধ শত্রুর মুখ মনে পড়ে না যে বা যারা তাদের এমন সর্বনাশ ঘটাতে পারে। কিন্তু মহেশপুরে সত্যিই সর্বনাশ নাজিল হয়েছে। অন্ধকার ফুঁড়ে সর্বনাশ নেমে এসে গ্রামের অনেকের ঘরে মৃত্যু শোক দেগে দিয়ে গেছে। ঘরে–ঘরে তারই মাতম। চাষের জমি, আর চাষীদের উঠান জুড়ে সারি–সারি লাশ। রক্ত পানি করে সন্তানের মতো বড় করে তোলা মানিকধন হারানোর শোকে চাষীরা হতবিহ্বল।
বোবার শত্রু থাকে না, অপ্তবাক্যকে ভেংচি দিয়ে রাতারাতি লাশ বনে যাওয়া গাছেদের শোকে গোটা গ্রামটা অবিরাম কেঁদে যাচ্ছে। এ–কান্না না পৌঁছায় সৃষ্টিকর্তার কানে, না গ্রামপ্রশাসনের। এসব বিচারহীন নিতান্তই মামুলি খুনের ঘটনা। এই ঘটনার সাথে শুধু মহেশপুর কেন পৃথিবীর কোনো মনুষ্যপ্রাণীরই যোগাযোগ নাই। হৃদয়বিদারক এই ঘটনায় বরং ভিনগ্রহের এলিয়েনদের সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। অতএব মানুষসকল, কোনো এক মহেশপুর গ্রামে রাতের অন্ধকারে শত শত আমগাছের লাশ বনে যাওয়ার ঘটনায় বিলকুল পেরেশান হবেন না।