‘যদি কাগজে লেখো নামসে কাগজ ছিড়ে যাবে/ যদি হৃদয়ে লেখো নাম/সে নাম রয়ে যাবে‘ কিম্বা ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ এ গানগুলো শোনেননি তেমন সংগীতপ্রিয় লোক পাওয়া দুষ্কর। এ জনপ্রিয় গানগুলোর স্রষ্টা ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা সংগীত শিল্পী এবং সুরকার মান্না দে (১৯১৯–২০১৩)। তিনি হিন্দি, বাংলা, মারাঠি, গুজরাটিসহ প্রায় ২৪টি ভাষায় সংগীত চর্চা করেছিলেন। মান্না দে। জন্ম ১৯১৯ সালের ১ মে উত্তর কলকাতায়। তাঁর পিতা পূর্ণ চন্দ্র দে আর মাতা ছিলেন মহামায়া দেবী। পড়াশুনার পাঠ শেষ করার পর তিনি তাঁর কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দের ছত্রছায়ায় সংগীত চর্চ্চা শুরু করেন। উস্তাদ দাবির খাঁর, উস্তাদ আমন আলী খাঁ ও উস্তাদ আব্দুল রহমান খানের কাছেও তিনি সংগীতে তালিম নেন। ১৯৪২ সালে তিনি মুম্বাই পাড়ি দেন। ১৯৪৩ সালে ‘তামান্না’ নামে একটা ছবিতে তাঁর কাকার সুরে এবং প্রথম গায়ক হিসেবে তাঁর অভিষেক ঘটে। তারপর শুরু হয় তার সংগীতে প্রতিষ্ঠার পালা। পেছনের দিকে আর তাকাতে হয়নি তার। মান্না দে প্রায় চার হাজারেরও অধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তার মাঝে আড়াই হাজারের অধিক বাংলা গান। ‘ও কেন এত সুন্দরী হল’ বা ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি’ গানের মাধ্যমে তিনি ব্যর্থ প্রেমিকের মনের যন্ত্রণা যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন। তেমন ‘সে আমার ছোট বোন’ গানটিতে তিনি তাঁর স্নেহ মায়া সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। ‘আমায় একটু জায়গা দাও, মায়ের মন্দিরে বসি’ গানটিতে তাঁর শ্রদ্ধা–ভক্তিকে সুনিপুনভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন, যা শুনলে যে কোনো শ্রোতার চোখ জলে ভিজে যায়। মান্না দের গানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তার গানের পরিধি বাঙালি জীবনের সাথে মিশে আছে। আমাদের সব অনুভূতি বা আবেগের বহিঃপ্রকাশ তাঁর গানে গানে প্রকাশিত হয়েছে। তাই তো তিনি ‘সারা জীবনের গান’ বা ‘ সারা বছরের গান’ গেয়ে ছিলেন। দীর্ঘ প্রায় ষাট বছরের সংগীত জীবনে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ভারতের সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী‘ এবং ‘পদ্মবিভূষণ‘ খেতাবসহ অসংখ্য খেতাব অর্জন করেন তিনি। এ ছাড়া ২০০৪ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও ২০০৮ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ডি.লিট সম্মাননা লাভ করেন। তার গান বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষদের উজ্জীবিত করেছিলো। মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মামনা প্রদান করে। মান্না দে ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।