আমাদের প্রতিনিয়ত খারাপ খবরের মধ্যে একটা ভালো খবর হলো – ‘সংকট ঘুচেছে আইসিইউ বেডের, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল : চালু হয়েছে ১০টি বেড, সেবা পাচ্ছেন সাধারণ রোগীরা’। গত ১০ নভেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ২৫০ শয্যার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সংকট অবশেষে ঘুচেছে। করোনাকালীন আইসিইউ’র সেবা দিয়ে আলোচনা আসা এই সরকারি হাসপাতালটিতে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ১৮টি আইসিইউ বেডের ১৮টি কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাসের যন্ত্র (ভেন্টিলেটর) এক পর্যায়ে বিকল হয়ে পড়ে। ফলে হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিট এক পর্যায়ে হাই ডিফেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) রূপান্তরিত হয়। তবে কয়েক মাস আগে বিকল হওয়া ভেন্টিলেটরগুলো মেরামতে নজর দেয় কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে ১০টি ভেন্টিলেটর সচল করা হয়। ফলে মূর্মুর্ষু রোগীরা এখন আইসিইউ’র সেবা পাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে কখনো পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ সেবা দেয়ার মতো যন্ত্রপাতি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিল না। পূর্ণাঙ্গ রোগীকে আইসিইউ সেবা দেয়ার জন্য সমন্বিত চিকিৎসা দরকার। জেনারেল হাসপাতালে হৃদরোগ বিভাগ, নেফ্রোলজি বিভাগ ও নিউরোলজি বিভাগ নেই। এখন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে একজন রোগী যদি আইসিইউ’তে ভর্তি করানো হয়, এক্ষেত্রে তার পরিপূর্ণ সেবা নিশ্চিত করার হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দরকার। আবার ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে কেউ যদি আইসিইউ’তে ভর্তি হন, তবে একজন নিউরোলজিস্ট বা নিউরো সার্জারির চিকিৎসক দরকার। এছাড়া আইসিইউ’র অভ্যন্তরে কিডনি রোগীর জন্য ডায়ালাইসিস মেশিন থাকতে হয়, এখন আমাদের তো নেফ্রোলজি বিভাগ নাই। তাই আমাদের সীমাবদ্ধতার কারণে আইসিইউ’র পূর্ণাঙ্গ সেবা শুরু থেকেই আমরা দিতে পারতাম না।
বলা জরুরি যে, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যে মানুষের অধিকার, কারো দয়া বা করুণার বিষয় নয় – এটাও সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে বোঝানো এবং সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে যারা সেবা প্রদানকারীর ভূমিকায় আছেন তাদের জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরির জন্য সচেষ্ট হতে হবে। অধিকারভিত্তিক একটি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারলেই এইসব ক্ষেত্রে অর্জন এবং সর্বোপরি যে কোনো বিপদশঙ্কুল পরিস্থিতি আরও সুদৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করা সহজতর হবে। স্বাস্থ্য অধিকারের দাবিতে দেশে একটি স্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সারা বিশ্বের সিদ্ধান্ত। শুধু বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত নয়। প্রত্যেক মানুষ, সর্বস্থানে এবং সর্বস্তরে স্বাস্থ্য সেক্টরের একটি অ্যাকসেস থাকতে হবে। এটি আমাদের জন্মগত অধিকার, এটি রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতেই হবে। শুধু আমার পকেটে টাকা নেই বলে আমি স্বাস্থ্যসেবা পাব না, তা কিন্তু হবে না। কাজেই সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এটি দেশের উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকার দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের মাধ্যমে যখন প্রয়োজন তখনই যেকোনো ধরনের চিকিৎসাসেবা বিনা মূল্যে গ্রহণ করতে পারবে, তখনই আমাদের দেশে ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হবে। এ জন্য আরো লম্বা পথ পাড়ি দিতে হতে পারে; যদিও আমাদের মতো এত জনবহুল দেশের সব মানুষকে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া কঠিন। তবু সরকারের উদ্যোগ থাকলে তা অসম্ভব হবে না। আমাদের দেশে এখনো সরকারি যে স্বাস্থ্যসেবা বিদ্যমান, তা অনেক দেশের চেয়ে ভালো। আমাদের যে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি আছে, তা অনেক দেশেই নেই। হাসপাতালগুলোতে ফ্রি সেবা দেওয়া হয়, ওষুধ দেওয়া হয়। তাতেই কি আমরা সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারবো। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, সেবার মধ্যে আমরা দেখেছিলাম সব জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং সব প্রাইভেট হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার–এগুলো ছিল সেবার অধীনে। এখন দেখা যাচ্ছে যে ২০ শতাংশ শিক্ষা এবং আর ৮০ শতাংশই সেবার অধীনে। তবে মনিটরিং ঠিকমতো না হওয়ার কারণে দুর্নীতি ও অনিয়ম স্বাস্থ্য খাতকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে। এটি হচ্ছে উপযুক্ত পর্যায়ের মনিটরিং ও পরিকল্পনার অভাবে। তাই দেশের সাধারণ মানুষ যাতে কোন ধরনের স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। হাসপাতালে এসে কোন রোগী যাতে সেবা না পেয়ে ফিরে না যায় এবং প্রতারণা ও ভোগান্তির শিকার না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।







