ছবি শুধু ছবি নয়। ছবি অনেক কথা বলে। ছবি হাসায়, আবার কাঁদায়ও। সেই রকমই একটি ছবি। আজাদী’র ১৮ জুলাই সংখ্যার প্রথম পাতার শীর্ষ খবরের ছবি। স্ট্রেচারে শোয়া এক শিশু। অক্সিজেনের নল লাগানো। তাঁর পাশেই অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে তাঁর স্বজন। ছবিটি আমার মতো অনেক পাঠকেরও চোখে শ্রাবণের জল এনে দিয়েছে। তিন লাইনে ছবির ক্যাপশন মনটা ভারাক্রান্ত করেছে। এতে লেখা হয়েছে “জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন, তাই শিশুটিকে সাতকানিয়া থেকে আনা হয়েছে চট্টগ্রামে। জিইসি এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু করাতে না পেরে নিয়ে আসেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতালে মা ও নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে সব চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বার ও অপারেশন বন্ধ ছিল। তাই এই পরিস্থিতি।”
সম্মানিত পাঠক। ঘরে–বাইরে ছবিটি আর খবর নিয়ে অনেক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি, শুনেছি। সবারই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সাথে রয়েছে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা। এই রকম দৃশ্য প্রার্থিত নয়। একজন মুমূর্ষু রোগীর প্রতি সহানুভূতির চেয়ে পেশাগত দায়িত্ব একজন কর্তব্যরত চিকিৎসকের অনেক গুণ বেশী। চিকিৎসা প্রদান করা একজন পেশাগত চিকিৎসকের প্রধান ও একমাত্র দায়িত্ব। আর চিকিৎসা পাওয়াটা একজন রোগীর অধিকার। আমাদের সংবিধান তা সুনিশ্চিত করেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের “রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি” অনুচ্ছেদের ১৫ ক’তে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে “অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থার নিশ্চয়তা”। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য করোনাকালে এ দেশের চিকিৎসকরা মানবিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য চিকিৎসকের জীবন প্রদীপই চিরতরে নিভে গেছে। মানবিকতার এ দৃষ্টান্ত ইতিহাস। যেমন, এখনো চট্টগ্রামের মানুষের মুখে মুখে করোনাকালে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের করোনাকালীন চিকিৎসা’র প্রশংসা। করোনাকালীন দুঃসহ দিনগুলোই যেন হঠাৎ ফিরে এসেছে। কয়েক বছরে ডেঙ্গুর রেকর্ড ভেঙে দেশ জুড়েই সৃষ্টি করেছে ত্রাস। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এখন উপচে পড়ছে ডেঙ্গু রোগী। তিনদিনে মারা গেছে ছয়জন। হাসপাতালের শয্যা, মেঝেতে রোগীতে ঠাঁসা। ঠাঁই নাই। রোগী স্থানাভাবে ফেরত যাচ্ছে। প্রাইভেট হাসপাতালেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাই বেশি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আরো বৃদ্ধির আশংকার কথা বলেছেন। এ মানবিক বিপর্যয়কালে নাকাল মানুষ ভরসা চায়।
বাঙালি সহজ, সরল প্রকৃতির। আবেগ প্রবণও। আবেগের বেগে অনেক অঘটনও ঘটিয়ে ফেলি। তিলকে তাল করার মতো। কথায় কথায় আমরা রাস্তা বন্ধ করি। হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জরুরি সেবা সংস্থায় তালা ঝুলিয়ে দেই। পার্শ্ব–প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করি না। তবে, চিকিৎসকদের একটা ধর্ম আছে। তাঁরা রোগীর জীবন–মরণ সংকটকালে সেবা বন্ধ করেন না। জরুরি সেবা চালু রাখেন। কিন্তু, হলে এর ব্যত্যয়ও ঘটছে। যেমন ঘটেছে ১৭ জুলাই। চতুর্দিকে ডেঙ্গু নিয়ে ভীতি। আর রোগীর রীতিমতো ঢল। বিশেষ করে নগরীর বাইরে প্রত্যন্ত এলাকায় ডেঙ্গুর কোন পরীক্ষা–নিরীক্ষার সুযোগ নেই। চিকিৎসকরাই বলছেন এ রোগ নিয়ে রোগীদের অবহেলা আছে। কঠিন পরিস্থিতিতেই রোগীরা হাসপাতালমুখী হচ্ছেন। আর হাসপাতাল থেকেই যদি চোখের জল নিয়ে ফিরতে হয়।
নির্বাচনের মৌসুম (যে কোন সরকারের মেয়াদকালের শেষ সময়) কাছাকাছি এলেই আমাদের দেশে রাজনৈতিক আন্দোলন চাঙ্গা হয়। এর সাথে দাবী–দাওয়া নিয়ে সরকারি–বেসরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরাও রাস্তায় নামে। এই প্রবণতা চলে আসছে। এখনো দৃশ্যমান। চিকিৎসক, শিক্ষক, সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীরা বেতন–ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে রাস্তায় নামছেন। শিক্ষকরা স্কুলে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। চিকিৎসকদের একটি অংশ বেতন–ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন। আগস্ট–সেপ্টেম্বর মাসে রয়েছে ডেঙ্গুর মহা বিপদ সংকেত। আমরা মরণাপন্ন শিশুর করুণ আর্তি আর দেখতে চাই না। উপমহাদেশের কিংবদন্তী গায়ক ভূপেন হাজারিকার সেই বিবেক জাগ্রত করার আহবানটিই শুনাই “মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য–এটুকু সহানুভূতি কী মানুষ পেতে পারে না ও–বন্ধু…।”
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক