সিন্ধু সভ্যতার ধারাবাহিকতা থেকে নিদর্শন পাওয়া যায়, প্রাচীন কালে হিন্দুদের প্রধান পূজা ছিল দেবী পূজা, মানে শক্তি পূজা। বৈদিক যুগেও শক্তি পূজার প্রচলন ছিল। হিন্দু ধর্মের আদি ধর্মগ্রস্থ বেদ, পুরাণ ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে বিভিন্ন দেবদেবীর রূপ, শক্তি, প্রভাব ও পূজা প্রণালীর ভিত্তিতে দেব-দেবী তিন ভাগে বিভক্ত :- বৈদিক, পৌরাণিক ও লৌকিক বা মর্ত্যলোকের দেবতা। দুর্গা হল পৌরাণিক দেবতা (দেবী)। পুরাণে দেবতাদের বিগ্রহ বা প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করার বিধান উল্লিখিত আছে। সহজ অর্থে পূজা মানে নিবেদন অর্থাৎ প্রশংসা বা শ্রদ্ধা জানানো। ব্যাপক অর্থে হিন্দু ধর্মে পূজা হচ্ছে ঈশ্বরের প্রতীকী কোন বিশেষ শক্তিরূপে প্রকাশিত দেব-দেবীকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে পুষ্প- অর্ঘ্য নিবেদনের মাধ্যমে বিশেষ অর্চনা বা উপাসনা। পরম সুখের আশায় দেব-দেবীর কাছে সমর্পিত হওয়ার মাধ্যমে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত হয়ে আশীর্বাদ লাভের চেষ্টাই পূজার মূল উদ্দেশ্য। দেবতাদের পূজা করলে ঈশ্বর খুশী হন এবং অভীষ্ট দান করেন। বিভিন্ন সময়ে জাগতিক প্রয়োজনে এবং জন হিতার্থে মুনী-ঋষি গণ কর্তৃক দেবী বা শক্তি পূজার আয়োজনের গল্প ধর্মীয় শাস্ত্রে বর্ণিত আছে। এই দেবী শক্তিই বিশ্বব্যাপিনী চন্ডী, বিশ্বরূপিনী আদ্যাশক্তি মহামায়া।
অসীম গুণ ও ক্ষমতার অধিকারী ঈশ্বর জীব-জগতের বিশেষ প্রয়োজনে দেবতা বা দেবীরূপে নিজের কোন গুণ বা ক্ষমতাকে কোন বিশেষ আকার বা রূপে প্রকাশ করেন বা আবির্ভূত হন। দেব-দেবী-দেবতা ঈশ্বরের গুণ বা শক্তির প্রকাশ।‘দিব’ ধাতু থেকে (দিব + অচ) এর উৎপত্তি।‘দিব’ ধাতুর অর্থ প্রকাশ পাওয়া। অর্থাৎ যিনি প্রকাশ পান তিনিই দেবতা। আবার যিনি নিজে প্রকাশ পেয়ে অন্যকে প্রকাশ করেন তিনিও দেবতা। দেবতারা আলাদা গুণ বা শক্তির অধিকারী হলেও ঈশ্বর নন। জ্যোতির্ময়ী দেবী “দুর্গা” ঈশ্বরের শক্তির প্রতীক। “দুর্গ” শব্দ থেকে “দুর্গা” শব্দের উৎপত্তি। যে স্থানে গমন করা দুরূহ তাহা “দুর্গ”, আর ‘দুর্গ’ শব্দের সাথে ‘আ’ প্রত্যয় যোগে গঠিত হয় স্ত্রী অর্থে দেবীরূপে “দুর্গা ” –যিনি ব্রহ্ম শক্তিবলে দূরধিগম্য। তিনি দুর্গতিনাশিনী অর্থাৎ এ মহাবিশ্বের যাবতীয় কষ্টের বিনাশকারী বলে তিনি দুর্গা। মহর্ষি ঋষিগণের অভিমত, দু:সাধ্য সাধনার মাধ্যমেই কেবল তাঁকে পাওয়া যায় বলে তিনি দুর্গা। আবার দুর্গম নামের পশুকে বধ করার কারণে তিনি দুর্গা। সনাতনী হিন্দু শাস্ত্রে বর্ণিত আছে অতি প্রাচীন কালে সাধনা বলে মহিষাসুর অমরত্ব লাভ করার পর দেবতাদের অগ্রাহ্য করতে শুরু করল। নিজের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে স্বর্গরাজ্যের দিকে মহিষাসুরের কুনজর পড়ল। মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গের দেবগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, নানাভাবে প্রতিনিয়ত লাঞ্চিত হতে থাকলেন। মহিষাসুরের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যে দেবতাদের সাধনার সম্মিলিত শক্তি থেকে আবির্ভূত হলেন জ্যোতির্ময়ী মহাজাগতিক শক্তি ‘‘দেবী দুর্গা’’। দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করে হলেন মহিষমর্দিনী। দেবী দুর্গা দশভূজা, ইন্দ্রীয় সংযমের প্রতীক তাঁর দশ হাত দশ দিক রক্ষায় শক্তিসম্পন্না। কবির ভাষায়, ‘দশ দিক তার দশ হাতে, ধরে দশ প্রহরণ।’ আবার তিনি কখনও চতুর্ভূজা বা অষ্টভূজা। দুর্গা ত্রিনয়না — অগ্নি, সূর্য্য ও চন্দ্রের প্রতীক ত্রিনয়না ব্রহ্ম, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের শক্তি সম্পন্না। অতসী বর্ণা ‘জ্যোতির্ময়ী মা’ কামনা বাসনা বিনাশিনী। তিনি শিবের সংহার শক্তি শিবানী এবং ব্রহ্মার সৃজন শক্তি ব্রাহ্মী। তিনি কখনও মহেশ্বরী স্বরূপিনী , কখনও বিশ্ব প্রসবিনী জগদ্ধাত্রী। আবার কখনও রুদ্রাণী, বারাহী বা চামুণ্ডা। বৃন্দাবনে তিনি কাত্যায়নী, দক্ষালয়ে তিনি সতী। এই দেবী শক্তিই বিশ্বব্যাপিনী চন্ডী, বিশ্বরূপিনী আদ্যাশক্তি মহামায়া।
শাস্ত্রমতে মহামায়ার দেবী মাহাত্ম্য আর রাজা সুরথের কাহিনী একসূত্রে গাঁথা। রাজনৈতিক চক্রান্তে রাজা সুরথ স্বীয় মন্ত্রী, সেনাপতি ও সেনাদল কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে বনে চলে যান। বনে মেধস মুনির সন্ধান পেয়ে তপোবন আশ্রমে আশ্রয় নিলেন, কিন্তু পরিবার-পরিজন, প্রজা-রাজ্য এসব চিন্তায় রাজা সুরথ শান্তিতে থাকতে পারলেন না। কিছুদিন পর পরিবার-পরিজন কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে সমাধি বৈশ্য একই আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন। তিনিও পরিবারের মমতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অশান্তিতে ভুগছিলেন। এ’সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যে সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য মুনিবর মেধসের কাছে গেলেন। মহামুনি মেধস তাদের সমস্যার কথা শুনলেন। তিনি তাদের এ জগৎ সংসারে মহামায়ার আদ্যাশক্তির প্রভাবের জ্ঞান দিলেন। তিনি তাদের বোঝালেন, সংসারের মায়াময় বন্ধনের একমাত্র কারণ ‘মহামায়া’– তিনি ব্রহ্মবিদ্য স্বরূপিনী, তিনি নিত্যা, সনাতনী ও পরমেশ্বরী। মেধস মুনি তাদের উপদেশ দিলেন, “আরাধিতা সৈব নৃনাং ভোগস্বর্গপবর্গদা।” – অর্থাৎ আরাধনা করলেই তিনি ভক্তের ইহকালে সুখ ও পরকালে শান্তি প্রদান করেন। তিনি জীবের মুক্তি প্রদায়নী। মুনিবর মেধসের নিকট দেবীশক্তির লীলা অবগত হয়ে দেবীর কৃপা লাভের আশায় রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্য দুর্গা দেবীর পূজায় অর্থাৎ কঠোর মার্তৃসাধনায় নিমগ্ন হলেন। দুর্গতিনাশিনী দুর্গা তাদেরও স্তবে মুগ্ধ হয়ে রাজা ‘সুরথ’-কে হৃত রাজ্য উদ্ধার আর ‘সমাধি বৈশ্য’-কে মোক্ষ লাভ তথা সমাধি প্রাপ্তিতে বর দিলেন। সুরথ ও সমাধি উভয়ে বসন্তকালে দেবীর পূজা করে দেবীর কৃপালাভ করেছিলেন বলে এ‘পূজাকে ‘বাসন্তী পূজা’ বলা হয়। কিন্তু ত্রেতা যুগে শরৎকালে রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য দেবীর আরাধনা করেছেন। তিনি অকাল বোধন করে মহামায়ার সুপ্তাবস্থায় থাকা কুন্ডলিনী শক্তি জাগ্রত করেছিলেন। পূজায় সন্তষ্ট হওয়ায় রামচন্দ্র দুর্গা দেবীর আশীর্বাদ লাভে সফল হন। বস্তুতপক্ষে বাসন্তী পূজাই প্রকৃত দুর্গাপূজা হলেও বিশ্বের হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে শারদীয়া দুর্গাপূজা সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় পার্বন হিসেবে অসাম্প্রদায়িক ধর্মীয় চেতনায় যুগে যুগে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। মহালয়া উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার আগমন ঘোষিত হয়। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ তিথিতে দুর্গাপূজা শুরু হওয়ার শাস্ত্রীয় বিধান আছে, তথাপি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ষষ্ঠী তিথিতে প্রতিমা স্থাপন করে শারদীয়া দুর্গা পূজা শুরু হয় এবং পাঁচ দিন ব্যাপী শাস্ত্রীয় বিধিসম্মতভাবে ষষ্টী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী বিহীত পূজা সমাপন করা হয়। দশমীর দিনে দেবী দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন হয়। শাস্ত্রীয় বিশ্বাস এই যে, মঙ্গলময়ী দেবী দুর্গা শ্বশুর বাড়ী থেকে তাঁর ছেলেয়েদের নিয়ে নিজ পিত্রালয়ে ঘরের মেয়ে রূপে বেড়াতে এসে চার দিন থেকে এ মঙ্গলালয়ের সমস্ত অমঙ্গল দূর করে এবং মঙ্গল প্রতিষ্ঠা করে পুনরায় কৈলাস ভবনে যাত্রা করেন। ভক্তিভরে মায়ের অর্চনার মাধ্যমে জন্মজন্মান্তরে মানুষের জীবন প্রবাহ মঙ্গল থেকে সুমঙ্গল স্তরে প্রবাহিত হয়। দশমীর দিনে দেবী দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন হয়। দুর্গা প্রতিমা নদী, পুকুর প্রভৃতি জলাশয়ে পবিত্রভাবে বিসর্জনের মাধ্যমে দুর্গাপূজা পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটে। একই সাথে ভক্তজন দেবী দুর্গার শ্রীচরণে হৃদয়ের কালিমা ও অন্ধত্ব বিসর্জন দিয়ে জগতমাতার আশীর্বাদ বিশেষ ভাবে অর্জনের প্রার্থনায় কাতর হয়।
অশুভ শক্তি কারও কাম্য নহে। অসুর বিনাশ তথা মনের আসুরিক শক্তিকে বিনাশের জন্য দুর্গাপূজার আয়োজন। তিনি মর্ত্যে আবির্ভূত হয়ে আমাদেরকে শক্তি, সাহস ও জ্ঞান অর্জনের প্রেরণা যুগিয়েছেন যাতে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য ভাব সুসংহত হয়। মহিষাসুরকে বধ করার পর আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের এই দশমীতিথিতে দেবী দুর্গা বিজয় উৎসব করেন। তাই দশমী বিজয়ের দিন। মহিষাসুর বধের মাধ্যমে দেবী আমাদের মনের কুপ্রবৃত্তিকে তথা মনের আসুরিক শক্তিকে দমন ও সদ- প্রবৃত্তি তথা শুভ শক্তিকে বিজয়ের শিক্ষা দিয়েছেন। অন্যায়কারীকে ধ্বংস এবং অন্যায়কে প্রতিহত করে জগতে সত্য, ন্যায়, শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করার শিক্ষা দিয়েছেন। দেবী দুর্গা দেবতাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার শক্তির প্রকাশ। তাই বিজয়া দশমী ঐক্যের শিক্ষা দেয়। বস্তুতপক্ষে দুর্গাপূজা অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও ঐক্যের প্রতীক। ধনী দরিদ্র,সকল স্তরের সকল সম্প্রদায়ের মানুষের অবাধ মিলনে দুর্গাপূজা বিশ্বমৈত্রীময় হয়ে উঠে, পরিণত হয় মহামিলনোৎসবে। এতে মানুষে মানুষে অহিংসার সেতু বন্ধন হয়। আজকের ক্ষয়িষ্ণু সমাজে মানুষ আর মানবতার অবক্ষয় রোধ করার দীপ্ত মানসে মনের আসুরিক বলয় তথা হিংসা, ক্রোধ ও অহংকার প্রভৃতি অজ্ঞানতার অন্ধত্বের শৃংখল থেকে মুক্ত হয়ে মানব মনে আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের চেতনা জাগরিত হওয়া জরুরি। মানবিক মূল্যবোধে বৈচিত্র্যময় আনন্দভুবন প্রতিষ্ঠায় অক্রোধী ও অমানী হয়ে শ্রদ্ধাবনত মস্তকে মহাশক্তিরূপিনী জ্যোর্তিময়ী মায়ের কাছে সকলের বন্দনা নিবেদিত হোক– যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমোঃ।
লেখক : ডিজিএম, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড