‘আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে মানছি, কিন্তু হৃদয়টা বড়। আর এই হৃদয় দিয়েই সকল সীমাবদ্ধতা জয় করি। আঁরা চাটগাঁইয়া…।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে একজন লিখেছেন এ কথা। সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় আবারো চট্টগ্রামের মানুষ প্রমাণ করল, মানবতা মরেনি আজো, মানবতা মরে না কখনো। গত শনিবার রাতে ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহত ও তাদের স্বজনদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে নগরী। চট্টগ্রামের আকাশে এখন শুধুই কান্নার রোল। বাতাসে পোড়া লাশের গন্ধ। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি কাজ করছে রোভার স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। হতাহতদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন বন্দর নগরীর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। কেউ ছুটে আসছেন রক্ত দিতে, আবার কেউ আসছেন ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী নিয়ে। কেউ এসে বলছেন, আমার অমুক গ্রুপের রক্ত। কই দেব? কেউ আবার নিজের গাড়ি দিয়ে বলছেন, আমার গাড়ি নেন। রক্তদাতা নিয়ে আসেন। চট্টগ্রামের তরুণ, যুবক, স্বামী-স্ত্রী, বয়স্ক থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ এভাবেই ছুটে এসেছেন হাসপাতালে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাসভর্তি হয়ে আসছেন সাহায্য করতে, রক্ত দিতে। কেউ ফ্রিতে ওষুধ, সরঞ্জাম দিচ্ছেন, কেউ ফ্রিতে ডোনার আনা-নেওয়া করছেন।
শনিবার মধ্যরাত থেকে আহতদের আনা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শুরু হয় চিকিৎসক ও স্বজনদের ছোটাছুটি। খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান অনেক মানুষ। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যের হাত বাড়ান। রাত থেকে অগ্নিদগ্ধদের চিকিৎসায় সহায়তা করতে চট্টগ্রাম মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে কাজ করছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ডিপো থেকে হতাহতদের উদ্ধারে কাজ করে। সংগঠনকেন্দ্রিক স্বেচ্ছাসেবীদের বাইরে ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে এগিয়ে আসেন।
শনিবার মধ্যরাতে চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সামনে দেখা যায়, কয়েকজন তরুণ হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাতে লেখা, কোনো প্রকার ওষুধের প্রয়োজন হলে বলুন, কারো রক্ত লাগলে জানান। অনেকে অগ্নিদগ্ধের চিকিৎসায় স্বেচ্ছায় রক্ত দিচ্ছেন, কেউ খাবার পানি নিয়ে হাজির হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, নিম্নআয়ের অনেক রিকশাচালক ও সিএনজি চালককে বিনা ভাড়ায় অগ্নিদগ্ধদের বিভিন্ন হাসপাতালে পৌঁছে দিতে দেখা গেছে।
এদিকে গতকাল ভোরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ শতাধিক শিক্ষার্থী অগ্নিদগ্ধদের রক্ত দিতে চমেক হাসপাতালে যান। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও দগ্ধদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। চবির যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নুর নবী রবিন বলেন, এমন দুঃসময়ে আমরা রক্ত দিয়ে আহতদের সহযোগিতার উদ্দেশ্যে ছুটে আসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অগ্নিদগ্ধদের মরদেহ বহনে সরাসরি সহযোগিতা করেছে বলে জানান তিনি।
বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের তরুণ-তরুণীরাও রক্তদান করেন। গাউসিয়া কমিটির কর্মী জোনায়েদ হোসেন বলেন, রক্ত প্রয়োজন শুনেই রক্ত দিতে ছুটে এলাম। দিতে পেরে ভালো লাগছে। চবির শিক্ষার্থী রেদওয়ান হোসেন জয় বলেন, রক্ত দিয়েছি। ভালো লাগছে।
আলী তানবির ও শহিদুল ইসলাম নামে দুজন বলেন, রাতে ঘটনা শোনার পরপরই আমরা ছুটে আসি। আমরা এখন জরুরি বিভাগে লাশ বহন এবং সহায়তায় কাজ করছি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শনিবার রাত থেকে হতাহতদের জন্য কাজে লেগে পড়েছেন। আহতদের রক্তসহ জরুরি ভিত্তিতে সাহায্য দিতে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল।
হতাহতদের সহযোগিতা করছেন গণসংহতি আন্দোলনের চট্টগ্রাম জেলার নেতাকর্মীরা। সংগঠনের জেলা সমন্বয়ক হাসান মারুফ রুমী জানান, আহত ব্যক্তিদের জীবন বাঁচানোর জন্য রক্তসহ অন্যান্য সহযোগিতার প্রয়োজন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি পোস্ট, এতে লেখা রয়েছে রিকশা, সিএনজিসহ অন্যান্য গাড়ির ড্রাইভাররা ভাড়া নিচ্ছে না। ওষুধের দোকান ফ্রি। রক্তদানে অপেক্ষারত হাজারো রক্তদাতা। শারীরিক শ্রম দিচ্ছেন শত শত স্বেচ্ছাসেবক। খাবার পানি সরবরাহ করছেন যে যেভাবে পারছেন। দল মত নির্বিশেষে এগিয়ে এসেছেন রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। ছুটে এসেছেন ডাক্তার ভাইয়েরা। আহা মানবতা!
চমেক হাসপাতাল এলাকার ফার্মেসিগুলোতে এখন আর বার্ন ক্রিমের সংকট নেই। গতকাল হাসপাতাল এলাকার বেশ কয়েকটি ফার্মেসি ঘুরে দেখা যায়, সব ফার্মেসিতে পর্যাপ্ত বার্ন ক্রিম ও অগ্নিদগ্ধের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ রয়েছে।
শনিবার রাতে নেগেটিভ রক্তের সংকটে মাইকিং করা হলে গতকাল বিভিন্ন সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক ও প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্থার রক্তদাতাদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। হতাহতদের প্রয়োজনে দেশের মানুষকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে আহ্বান জানিয়েছেন ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা এমপি, তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিম।
উদ্ধার অভিযানে থাকা দমকলকর্মীদের জন্য খাবার ও পানি নিয়ে এগিয়ে আসেন একদল স্বেচ্ছাসেবী। রাশেদুল ইসলাম নামে সংগঠনের ওই কর্মী বলেন, ভাই আগে খান, না হয় ক্লান্ত হয়ে পড়বেন।
তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী নামে একজন বলেন, রাত ১২টার পরপর খবর পেয়ে আমি, তারেক হোসেইন, মুহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম, আজমাইন সাদমান ও আঁখি যাচ্ছিলাম চট্টগ্রামে মেডিকেলে। কর্নেলহাট মোড়ে ওঠার পর পথে খবর আসে ক্যান্টনমেন্টের সামরিক হাসপাতালে রক্ত লাগবে দমকল বাহিনীর কর্মীদের জন্য। দেরি না করে রওনা দিই সামরিক হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে যখন ভাড়া দিতে যাই, ড্রাইভার নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, রক্ত দেয়ার জন্য আমাদের সাথে তিনিও অপেক্ষা করবেন। একটু পর একজন আর্মি অফিসার এসে চাইলেন বি পজিটিভ রক্ত। আমাদের কারোর বি পজিটিভ ছিল না। ড্রাইভারটির বি পজিটিভ ছিল। তিনি দিতে রাজি হন।
তানভীর বলেন, তার রক্ত দিতে দিতে আমাদের কাছে খবর এল মেডিকেলে খাওয়ার পানি ও স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে। ব্লাড ডোনার, রোগীর স্বজন ও স্বেছাসেবকরা পর্যাপ্ত খাওয়ার পানি পাচ্ছে না। সিদ্ধান্ত নিই আমরা পর্যাপ্ত পানির সাথে স্যালাইন ও কিছু মেডিসিন নিয়ে যাব। আমাদের সিদ্ধান্ত শুনে ড্রাইভার ভাইটি রক্ত দেয়ার সাথে সাথে ড্রাইভিং করা শুরু করে। জিনিসগুলো সংগ্রহ করা থেকে মেডিকেল নেওয়া পর্যন্ত সাথেই ছিলেন। বাসায় চলে যান রাত ৪টার দিকে। ভোর ৬টায় যখন মেডিকেলে ছিলাম তখন সেই ভাইটি ফোন দিয়ে জানতে চান তার আসতে হবে নাকি। পুরো সময়ে উনি আমাদের কাছ থেকে এক টাকাও নেননি।
একইভাবে পাওয়া গেছে সিএনজি টেঙির এক চালককে। মো. ইউছুফ নামে ওই চালক সারা দিন অগ্নিকাণ্ডে হতাহতদের আনা-নেওয়া করেছেন বিনামূল্যে।