আপনি কি জানেন এই মুহূর্তে আপনার শরীরে সাঁইত্রিশ (৩৭) ট্রিলিয়ন–এরও বেশি কোষ আলো নির্গত করছে? বিজ্ঞানীরা এটিকে বায়ো ফোটন নির্গমন বলে থাকেন। আর এর একটি কারণ আছে, যা আমরা এখনও এই ক্ষমতা ধরে রেখেছি। কারণ বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে, মানুষ মূলত বানর থেকে বিবর্তিত হয়নি। মানুষ ‘আলোকিত প্রাণ’ বা ‘আলোক’ থেকে বিবর্তিত হয়েছে, যারা উড়তে পারত, খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজন ছিল না এবং বিশুদ্ধ আনন্দের উপরই তাঁরা বেঁচে থাকত।
এটা পাগলের প্রলাপ বা গল্পের মতো শোনাতে পারে। কিন্তু নাসা মহাকাশে প্লাজমা–ভিত্তিক জীবন রূপ আবিষ্কার করেছে। অক্সফোর্ডের কোয়ান্টাম বায়োলজি ইনস্টিটিউট কোয়ান্টাম চেতনা নিয়ে গবেষণা করছে, এবং হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল প্রমাণ করেছে যে, ধ্যান ডিএনএ পরিবর্তন করতে পারে। সম্ভবত আধুনিক বিজ্ঞান ধীরে ধীরে প্রমাণ করছে, যা বুদ্ধ ২,৫০০ বছর আগে জানতেন।
১. মহাবিশ্বের কোনো সূচনা বিন্দু নেই : বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, যখন আপেক্ষিকতার তত্ত্ব তৈরি করেন, তখন তিনি অসাবধানতাবশত তথাগত গৌতম বুদ্ধের আড়াই হাজার বছর আগে শেখানো কিছু জ্ঞান বা ধারণা প্রমাণ করেন। যেমন: ‘সময় রৈখিক নয়!’ ‘সময় রৈখিক নয়’ এর অর্থ হলো সময় একটি সরল রেখার মতো অবিচ্ছিন্ন এবং অভিন্ন পথে চলে না, বরং এটি বিভিন্ন উপায়ে প্রবাহিত হতে পারে এবং আমাদের অভিজ্ঞতা তার একটি সরলীকৃত ধারণা মাত্র। এই ধারণাটি বোঝায় যে, অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ একইসাথে বিদ্যমান থাকতে পারে, এবং সময়ের ধারাবাহিকতা মানুষের উপলব্ধির একটি অংশ মাত্র।
বৌদ্ধ ধর্মে, প্রথম বিগ ব্যাং বলে কিছু নেই। মহাবিশ্ব অবিরাম চক্রে বিদ্যমান, এটি একটি বিশাল সত্তার নিঃশ্বাসের মতো প্রসারিত এবং সঙ্কুচিত হয়। এই চক্রের দৈর্ঘ্য ব্যাখ্যা করার জন্য বুদ্ধ একটি আশ্চর্যজনক ‘রূপক’ দিয়েছেন। এক যোজন (প্রায় ১১ মাইল) উচ্চতা এবং এক যোজন (প্রায় ১১ মাইল) প্রশস্ত একটি শক্ত শিলা পর্বত কল্পনা করুন। যদি কেউ প্রতি একশত (১০০) বছরে একবার, একটি পাতলা রেশমি কাপড় দিয়ে এটিকে ঘষে, তবে সেই পর্বতটি ক্ষয় করতে যে সময় লাগবে তা এখনও এক কল্পের চেয়ে কম হবে। একটি কল্প, এটি অসংখ্য মহাজাগতিক চক্রের সময়ের একটি ছোট একক।
আশ্চর্যজনক বিষয় হল, আধুনিক বিজ্ঞান বহু বিশ্ব, অগণিত সমান্তরাল মহাবিশ্ব সম্পর্কে যা আবিষ্কার করছে, তা ঠিক ‘ব্রহ্মজাল সূত্রে’ গৌতম বুদ্ধ বর্ণনা করেছেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ ড. ব্রায়ান গ্রীন একবার বলেছিলেন, ‘অগণিত সমান্তরাল মহাবিশ্বের সম্ভাবনা এখন আর বিজ্ঞান কল্পকাহিনী নয়।’ কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম প্রাচীন কাল থেকেই এটি জেনে আসছে। যদি মহাবিশ্বের কোনো সূচনা বিন্দু না থাকে, তাহলে প্রথম মানুষ কেমন দেখতে ছিল? উত্তরটি বিবর্তন সম্পর্কে আপনার সব ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করবে।
২. প্রথম মানুষ, তুমি যা ভাবছো তা নয় : অজ্ঞান্না (সর্বোচ্চ জ্ঞান) সূত্রে, তথাগত বুদ্ধ ‘মানুষের প্রথম রূপ’–এর বিষয়ে এত বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেছেন যে, এটি আধুনিক বিজ্ঞানীদের মানব উৎপত্তি সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করে। সেই সময়ে, প্রাণীরা ছিল মন–নির্মিত এক উজ্জ্বল আলোক রশ্মি, আনন্দ (প্রীতি) দ্বারা পুষ্ট, স্ব–উজ্জ্বল, বাতাসে চলাচলকারী। এটা কবিতা বা রূপক নয়। তথাগত বুদ্ধ মনুষ্য জীবনের সূচনা সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ হিসাবে বর্ণনা করছেন। এই প্রাণীদের বস্তুগত খাদ্যের প্রয়োজন ছিল না। তারা আনন্দ খেত। তাদের কোনো লিঙ্গ ছিল না, কোনো স্পষ্ট শারীরিক সীমানা ছিল না এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তারা জীবন্ত তারার মতো স্ব–উজ্জ্বল ছিল।
অবিশ্বাস্য শোনাচ্ছে! বিবেচনা করুন। মহাবিশ্বের ইতিহাসের ৯৫% জুড়ে, আলো, শক্তির প্রধান রূপ ছিল। পদার্থ মাত্র ৫%। এমনকি বর্তমান মানবদেহেও, আমাদের এখনও জৈব–উজ্জ্বল কোষ রয়েছে। জার্মানির শারীর বিজ্ঞানী ড. ফ্রিটজ–আলবার্ট পপ আবিষ্কার করেছিলেন যে, সমস্ত জীবন্ত কোষ ফোটন নির্গত করে। তিনি এই জৈব–উজ্জ্বল নির্গমনকে বায়ো ফোটন নির্গমন বলে অভিহিত করেন। সম্ভবত বৌদ্ধ ধর্মে আলোক প্রাণী গুলি সম্পূণরূপে পৌরাণিক বা গল্প কাহিনী নয়।
৩. বিবর্তন আসলে কেন অব–বিবর্তন : এটি সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ হতে পারে, তবে আসুন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ বিবেচনা করি। বৌদ্ধধর্ম অনুসারে, আলোক প্রাণী থেকে বর্তমান মানুষে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াটি অগ্রগতি নয়, একটি পতন। স্ব–আলোকিত হওয়ার ক্ষমতা হারানোর অর্থ হল একটি অসীম প্রাকৃতিক শক্তির উৎস হারানো। পরিবর্তে, আমাদের একটি সীমিত খাদ্যের উপর এবং অপর্যাপ্ত শক্তির উৎসের উপর নিভর্র করতে হচ্ছে। শক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি সত্যিই এক ধাপ পিছিয়ে।
অজ্ঞান্না সূত্র অনুসারে, যখন মানুষ জড় খাদ্য খেতে শুরু করে, তখন কেবল তাদের দেহই পরিবর্তিত হয় না, বরং তাদের মনও রুক্ষ হয়ে ওঠে। এই রুক্ষতা তাদের মনে ছড়িয়ে পড়ে কারণ অজ্ঞতা এবং তৃষ্ণা তাদের মিথস্ক্রিয়ায় দ্বন্দ্ব নিয়ে আসে। এই সময় লোভ, ঘৃণা এবং মোহ দেখা দেয়। মানব জীবনের সমস্ত দুঃখ কষ্টের কারণ এই তিনটি বিষ। স্ট্যানফোর্ডের স্নায়ুবিজ্ঞানী ড. রবার্ট স্যাপোলস্কি প্রমাণ করেছেন যে মানসিক চাপ এবং লোভ আসলে মস্তিষ্কের গঠনকে নেতিবাচক ভাবে পরিবর্তন করে।
৪. কর্ম, বিবর্তনের আসল চালিকা শক্তি : এখানেই বৌদ্ধ ধর্ম একটি বিপ্লব হয়ে ওঠে। ডারউইন বলেন, পরিবেশ জীবকে গঠন করে, অন্য দিকে বৌদ্ধ ধর্ম বলে, চেতনা বাস্তবতাকে গঠন করে। কর্ম মানে প্রতিশোধ নয়, যেমনটি অনেকে মনে করেন। পালি ভাষায়, কর্ম মানে ইচ্ছাকৃত কর্ম। বুদ্ধ শিক্ষা দিয়েছিলেন: ‘কর্ম হল উদ্দেশ্য। আমি বলি যে উদ্দেশ্য নিজেই কর্ম। কারণ একটি উদ্দেশ্য তৈরি করার পর, একজন ব্যক্তি শরীর, বাক্য এবং মনের মাধ্যমে কাজ করে।’ এর অর্থ হল চেতনা মস্তিষ্কের উৎপত্তি নয় বরং বস্তুকে আকৃতি দেয় এমন শক্তি। পটিচ্ছা সামুপ্পাদা বা প্রতিত্য সমুৎপাদ (নির্ভরশীল উৎপত্তি) ব্যাখ্যা করে যে, মন এবং শরীর (নাম–রূপ) কীভাবে পরস্পর নির্ভরশীল ভাবে উত্থিত হয়। ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ান্টাম পদার্থবিদ ড. অমিত গোস্বামী চেতনা–ভিত্তিক বাস্তবতার প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি দ্য সেলফ–অ্যাওয়ার ইউনিভার্স বইয়ে লিখেছেন ‘চেতনা বাস্তবতার মৌলিক ভিত্তি, বস্তুর নয়’।
বুদ্ধ শিক্ষা দিয়েছিলেন: ‘মন হল সমস্ত ঘটনার অগ্রদূত। মনই সর্বোচ্চ। মনই স্রষ্টা।’ এর অর্থ, কেবল ব্যক্তিগত ভবিষ্যত নয়, বরং মানবতার ভবিষ্যত, আজ আমরা যে সচেতন সিদ্ধান্ত নিই, তার উপর নির্ভর করে।
৫. বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে মানবতার ভবিষ্যৎ : ভবিষ্যতে মানব জাতির কী হবে? বৌদ্ধধর্মের একটি নির্দিষ্ট এবং আশ্চর্যজনক উত্তর আছে। অজ্ঞান্না সূত্র অনুসারে, মহাবিশ্ব বিশাল চক্রে কাজ করে। বর্তমানে আমরা সমপ্রসারণ পর্যায়ে আছি, কিন্তু এমন একটি সময় আসবে যখন মহাবিশ্ব সংকোচন শুরু করবে। সেই সময়ে, প্রাণীরা মূলত আভাসুর ব্রহ্ম জগতে পুনর্জন্ম লাভ করবে–দীপ্তিময় শব্দ ব্রহ্মের জগতে। এটি একটি আধ্যাত্মিক জগৎ যেখানে প্রাণীরা বিশুদ্ধ আলো হিসেবে বিদ্যমান। আশ্চর্যজনক বিষয় হল এটি আধুনিক পদার্থবিদ্যার বিগ ক্রাঞ্চ তত্ত্বের সাথে সম্পূর্ণরূপ সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বৌদ্ধধর্ম আরও এগিয়ে যায়। এতে বলা হয়েছে যে, সংকোচনের পর্যায়ে কেবল পদার্থই অদৃশ্য হয়ে যায় না, বরং চেতনাও বিশুদ্ধ শক্তির আকারে ফিরে আসে। মানুষ তাদের মূল আলোক–সত্তার অবস্থায় ফিরে আসবে। নিউ ইয়কের্র সিটি ইউনিভার্সিটি’র তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ডঃ মিচিও কাকু বলেছেন, ‘সম্ভবত চেতনা এমন এক ধরনের শক্তি যা মস্তিষ্ক থেকে স্বাধীন ভাবে বিদ্যমান থাকতে পারে।’ কিন্তু এটি কেবল অর্ধেক গল্প। মহাবিশ্ব সম্পূর্ণরূপে সংকুচিত হওয়ার পরে, এটি আবার প্রসারিত হবে।
৬. কেন তুমি (মানুষেরা) মহাজাগতিক লটারি জিতেছো?
এবার আমরা ফিরে আসি অন্তহীন সমুদ্রের অন্ধ কচ্ছপের দিকে। বুদ্ধ এই রূপকটি ব্যবহার করে মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করা কতটা বিরল তা তুলে ধরেছেন। কল্পনা করুন সমগ্র পৃথিবী জলে ঢাকা। এই সমুদ্রে একটি অন্ধ কচ্ছপ সাঁতার কাটছে। প্রতি একশত বছরে একবার এটি ভেসে ওঠে। জলের পৃষ্ঠে, বাতাসের সাথে ভাসমান মাঝখানে একটি ছিদ্র সহ একটি কাঠের জোয়াল রয়েছে। অন্ধ কচ্ছপের সেই গর্ত দিয়ে মাথা আটকে রাখার সুযোগ হল মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করার সম্ভাবনা। গণিতবিদ ড. আলী বিনাজির, একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্মের সম্ভাবনা গণনা করেছিলেন। ফলাফল: চারশত (৪০০) কোয়াড্রিলিয়ন এর মধ্যে এক (১) জন! কিন্তু মানুষ এত বিরল কেন? বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে, অস্তিত্বের অগণিত জগতের মধ্যে, শুধু মাত্র মানব জগতেরই জ্ঞানার্জনের জন্য আদর্শ পরিস্থিতি রয়েছে। স্বর্গীয় জগতের মতো উচ্চতর জগৎও অত্যন্ত আনন্দময়, সেখানে সত্য অনুসন্ধানের কোনো প্রেরণা থাকে না। নরক বা ক্ষুধার্ত ভূত–জগতের মতো নিম্নতর জগৎগুলি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এই প্রাণীরা দুঃখ কষ্টে এতটাই ডুবে থাকে যে, তারা জ্ঞান অনুশীলন বা ধর্মাচরনের দিকে মনোনিবেশ করতে পারে না।
বুদ্ধ শিক্ষা দিয়েছিলেন ‘মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করা কঠিন। নীতিগত জীবন যাপন করা কঠিন।’ কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করা কেবল প্রথম পদক্ষেপ। আসল সুযোগ হলো, এই জীবনকে ব্যবহার করে জন্ম ও মৃত্যুর চক্র, সংসারের চক্র থেকে মুক্তি পাওয়ার মধ্যে নিহিত। ত্রিপিটকের ধম্মপদ অনুসারে, বুদ্ধ শিক্ষা দিয়েছেন ‘আমরা যা, তা হল আমরা যা চিন্তা করেছি, তার ফলাফল। যদি কোনো ব্যক্তি বিশুদ্ধ মন নিয়ে কথা বলে বা কাজ করে, তবে সুখ তাদের অনুসরণ করে।’
মানুষ!, তুমি যেন মহাজাগতিক এক লটারি জিতেছো! তোমার কাছে এমন কিছু আছে, যার জন্য কোটি কোটি জীবন কাল অপেক্ষা করে এক সত্তা: জন্ম ও মৃত্যুর অন্তহীন চক্র থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ। প্রশ্নটি এই নয় যে, আপনি কোথা থেকে এসেছেন, কিন্তু আপনি কোথায় যাবেন? তথ্য সূত্র: অনলাইন / ইন্টারনেট
লেখক : মহাসচিব, ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ বাংলাদেশী বুড্ডিস্টস, বোস্টন, ইউএসএ।










