মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার রূপকার

কুমুদিনী কলি | বৃহস্পতিবার , ২৩ অক্টোবর, ২০২৫ at ১১:১৬ পূর্বাহ্ণ

ঈশ্বর থাকেন ঐ ছামে, ভদ্রপল্লীতে, এইখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না’। অথবা,‘অন্ধকারে যে বাস করে মৃদু আলোতে তাহার চোখ ঝলসাইয়া যায়, চোখ ঝলসানো আলোতে সে হয় অন্ধ’। অথবা, বিখ্যাত সেই উক্তি– ‘আমারে নিবা মাঝি লগে’?

বাংলা সাহিত্যের প্রভাবশালী রবীন্দ্র বলয়কে ভেঙে নতুন ভাবনা ও চমৎকার উপস্থাপনায় যিনি অন্ত্যজ শ্রেণির জীবনযাপনকে স্থান দিয়েছেন সাহিত্যাঙ্গনে, তিনি অনায়াসে বলেছেন তাদের জীবনযাপনের তীব্র বিবমিষার কথা। তাদের অন্ধকার ঘরেও, অভাব অনটনের তীব্র হাহাকারেও প্রেম আসে চুপিচুপি। তারাও তীব্র মানবতা ধারণ করেন, তারাও ন্যায় অন্যায়ের তফাৎ টুকু বুঝতে পারেন।

শুধু সেসব কথা স্বকীয় অনুভবের সাথে মিশিয়ে সর্বসমক্ষে বলেছেন, সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন, তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে মানবিক মূল্যবোধের চরম সংকটময় মুহূর্তে বাংলা কথাসাহিত্যে যে কয়েকজন লেখকের হাতে সাহিত্য জগতে নতুন এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর রচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, নিয়তিবাদ ইত্যাদি। ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ ও মার্কসীয় শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, যা তাঁর রচনায় ফুটে উঠেছে।

তাঁর প্রকৃতনাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী একজন লেখক। তিনি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাই মধ্যবিত্ত পরিবারের সমস্ত অলিগলি তাঁর চেনা। মধ্যবিত্ত সমাজে জন্ম নিয়ে তিনি খুব অল্প বয়সেই বুঝে ফেলেছেন, এই সমাজব্যবস্থার মূল সমস্যা গুলো কী কী হতে পারে। তিনি পৃথিবীকে দেখেছেন নির্মমভাবে, আর স্বাভাবিকভাবেই সেই নির্মমতা ফুটে উঠেছে তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যকর্মে। তাঁর মতে, মধ্যবিত্ত সমাজ একদিকে আদর্শ আর নীতির মুখোশ পরে থাকে, অন্যদিকে তার অন্তরে লুকিয়ে থাকে ভণ্ডামি, সংকীর্ণতা ও আত্মস্বার্থ।

তাঁর উপন্যাস ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় ধূর্জটিপ্রসাদ চরিত্রের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে মধ্যবিত্ত মানসজগতে আদর্শ ও প্রবৃত্তির সংঘাত ঘটে। বাহ্যিক শৃঙ্খলা ও আভিজাত্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকে দারিদ্র্য, হীনতা ও মানসিক দোদুল্যমানতা।

শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক সুউচ্চ কণ্ঠস্বর। তিনি আপাদমস্তক একজন ন্যায়ের ধ্বজাধারী লেখক ছিলেন। তাঁর দৃষ্টি শুধু মধ্যবিত্ত সমাজের গণ্ডিতেই আবদ্ধ ছিলো তাই নয়। তিনি নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবীদের জীবনকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং তাদের জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছেন তাঁর সাহিত্যে অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে।

তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘অতসী মামী’, ‘হারান মাস্টার’ কিংবা উপন্যাস ‘পদ্মানদীর মাঝি’তে আমরা দেখি দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অথচ সেই দারিদ্র্যের মাঝেও তাদের মানবিকতা, ভালোবাসা ও স্বপ্নের আলো।

বিশেষ করে ‘পদ্মানদীর মাঝি’তে কুবের, কপিলা ও হোসেন মিয়ার জীবনকাহিনি শুধু নদী ও জীবিকার গল্প নয়, এটি আসলে মানুষের অদম্য জীবনপ্রেমের গল্প। মানুষের জীবন ভাগ্য বা নিয়তি দ্বারা পরিচালিত হয় একথা তিনি প্রবলভাবে বিশ্বাস করতেন।

মানিকের রচনায় একধরনের নিয়তিবাদ বা ভাগ্যনির্ধারিততার ধারণা প্রবলভাবে উপস্থিত। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ নিজের জীবনের নিয়ন্তা নয় পরিস্থিতি, সমাজব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েন মানুষকে পরিচালনা করে। তাঁর গল্প ‘অতসী মামী’তে যেমন দেখা যায়, সমাজ ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা একজন নারীর জীবনকে যেভাবে গড়ে দেয়, তা তাঁর নিজের ইচ্ছার বাইরে। আবার ‘পদ্মানদীর মাঝি’তেও মানুষ প্রকৃতি ও ভাগ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করলেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়। এই পরাজয়ই মানিকের দৃষ্টিতে মানবজীবনের অনিবার্য ট্র্যাজেডি। অত্যন্ত খোলামেলা ভাষায় তিনি এমন এক শ্রেণির মনোভাব, ইচ্ছা, অনিচ্ছা তুলে ধরেছেন, যাদেরকে সমাজ কখনও গ্রহণ করতে চায় না। তারা অবহেলিত, সাধারণের চেয়েও সাধারণ। তিনি তাঁর রচনায় মানুষের জীবন ও মনের অভ্যন্তরীণ দিকগুলোর বিশ্লেষণে এক ভীষণ রকম পারদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন।

তাঁর প্রথম দিককার রচনায় নিপুণভাবে তিনি সাধারণ মানুষের মুখের কথাকে তুলে এনেছেন সাহিত্যে। তিনি সমাজের নিম্নবিত্ত ও অন্ত্যজশ্রেণির প্রতিদিনকার জীবনযাপনকে উদ্দেশ্য করে সাহিত্য রচনা করেছেন। আলোকপাত করেছেন সেসব মানুষদের ওপর, যেখানে স্বাভাবিকভাবেই আমরা আলোকপাত করি না। তাদেরও সবার মতোই কিছু কিছু আশা থাকে তাদের প্রিয়জনদের নিয়েও। এতো অভাবেও তাদের প্রিয়জনের হাসি তাদের কাছে অমূল্য।

সেই হাসি, সেই নোংরা দাঁত বের করে তারা ঠিক যেভাবে কথা বলে, ঠিক তেমন টাই তিনি প্রতিটি লাইনে তুলে ধরেছেন। তিনি সরাসরি এসব মানুষের সাথে মিশেছেন, তাদের সুখ দুঃখ হাসি আনন্দ খুঁজে নিতে চেয়েছেন। আর সেসবের প্রতিফলন পড়েছে তাঁর সাহিত্যে।

সাহিত্যকে বলা হয় মানবজীবনের অন্যতম দর্পণ। ব্যক্তি লেখক কী ভাবছেন, কতটা ভাবছেন সব যেনো সরাসরি প্রতিফলিত হয় তাঁর প্রতিটি সাহিত্যে। আর সেসব পাঠ করে আমরা ঋদ্ধ হই। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত কল্লোল পত্রিকা কেন্দ্র করে যে সাহিত্য আন্দোলন গড়ে ওঠে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সেই গোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান লেখক। তিনি এই আন্দোলনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথশরৎচন্দ্র ধারার বাইরে বাস্তবতার চর্চাকে প্রাধান্য দেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে পুতুলনাচের ইতিকথা, পদ্মা নদীর মাঝি, দিবারাত্রির কাব্য (উপন্যাস) এবং অতসী মামী, প্রাগৈতিহাসিক, ছোট বকুলপুরের যাত্রী (ছোটগল্প)

তিনি তার সাহিত্যকর্মে সমাজের অবক্ষয় এবং বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনযাত্রার পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র তুলে ধরেন, যা তাকে একজন স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। জীবনের অতি ক্ষুদ্র পরিসরে তিনি রচনা করেন চল্লিশটি উপন্যাস ও তিনশত ছোটোগল্প। তাঁর রচিত পুতুলনাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মা নদীর মাঝি ইত্যাদি উপন্যাস ও অতসী মামী, প্রাগৈতিহাসিক, ছোট বকুলপুরের যাত্রী ইত্যাদি গল্পসংকলন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

লেখক: প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাকতালীয়
পরবর্তী নিবন্ধশতবর্ষের প্রান্তসীমায় চসিক শিক্ষাসেবা