গতকাল ছিল বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হয়েছে দিবসটি। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য : অধিক বিনিয়োগ, অবাধ সুযোগ’। মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বাড়বে, এই সচেতনতা বৃদ্ধি করাই এবারের মূল উদ্দেশ্য। আসলে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস হলো পৃথিবীর সকলের মানসিক স্বাস্থ্যশিক্ষা, সচেতনতার দিন। এটি ১৯৯২ সালে প্রথম পালন করা হয়। কিছু দেশে একে মানসিক রোগ সচেতনতা সপ্তাহের অংশ হিসেবে পালন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডের মধ্যে কেউ না কেউ আত্মহত্যার মাধ্যমে প্রাণ হারান। আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। অধিকাংশ ব্যক্তিই আত্মহত্যার সময় কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত থাকেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আহমেদ হেলাল তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ১৯৪৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘স্বাস্থ্য’-এর যে সংজ্ঞা দিয়েছিল, তা আজও অমলিন। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘কেবল নিরোগ থাকাটাই স্বাস্থ্য নয়; বরং শারীরিক, মানসিক, আত্মিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকার নামই স্বাস্থ্য।’ অথচ কার্যত এই সংজ্ঞার খণ্ডিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয় প্রতিনিয়ত, কখনো সচেতনভাবে, আবার কখনো অসচেতনতায়। ফলে দীর্ঘদিন ধরে ‘স্বাস্থ্য’ শব্দটি সীমাবদ্ধ হয়ে ছিল ‘শারীরিক’ অংশটুকুর মধ্যে। তবে আশার কথা এই যে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেরিতে হলেও বাংলাদেশে ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ বিষয়টি ধীরলয়ে প্রবেশ করছে স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূল আঙিনায়।
একথা বলা বাহুল্য যে, করোনাকালে সাধারণ মানুষের শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপক অবনতি হয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৫ গুণ বেশি মানুষ বিষণ্নতাজনিত রোগে এবং দশ গুণ বেশি মানুষ উৎকণ্ঠাজনিত রোগে ভুগছেন। বিষণ্নতাজনিত সমস্যায় ভুগছেন ৩২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ, যা ২০১৯ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ পরিচালিত একটি জরিপে ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
একই সঙ্গে ৪৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ উৎকণ্ঠাজনিত রোগে ভুগছেন, যা আগে ছিল মাত্র ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা আর্ক ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক অনলাইন গবেষণায় এসব চিত্র দেখা গেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষদের তুলনায় নারীরা মানসিক সমস্যায় বেশি ভুগছেন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী পুরুষদের ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ সামগ্রিক মানসিক সমস্যায় ভুগলেও নারীদের মধ্যে এর হার ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ। অন্যদের তুলনায় শিক্ষার্থী ও বেকাররা বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। ‘দ্য ম্যাগনিটি অব ডিপ্রেশন অ্যান্ড এংজাইটি ডিউরিং কোভিড-১৯ : অ্যান অনলাইন সার্ভে এমং এডাল্টস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক অনলাইন গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ ও ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। এর মধ্যে ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ চাকরিজীবী এবং ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী।
গবেষণায় মানসিক স্বাস্থ্যের যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে তা আসলেই উৎকণ্ঠার। সবসময়েই নারী এবং তরুণরা মানসিক সমস্যায় বেশি ভোগেন। রাষ্ট্র, পরিবার, সমাজের সবার উচিত তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেয়া। সারাবিশ্বেই করোনার কারণে এ সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে। এ বিষয়ে কীভাবে মানুষকে সহায়তা করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনা মহামারির মধ্যে মানসিক সমস্যা বেড়েছে। সবাই এই সমস্যায় না ভুগলেও অনেকের মধ্যেই নমুনা দেখা যাচ্ছে। এই সময়টাতে এক ধরনের অনিয়ম তৈরি হয়েছে। তরুণরা রাতে ঘুমাচ্ছে কম, এতে তাদের মধ্যে এক ধরনের খিটখিটে স্বভাব তৈরি হচ্ছে। এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে হলে অন্যান্য রোগের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি দরকার। মানসিক রোগ নয় মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
করোনায় আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে কাজ করছে। এ জন্য আমাদের প্রচুর তথ্য প্রয়োজন। মানুষের কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা কমিয়ে আনা যায় তার জন্য কাজ করতে হবে।