আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। সাধারণত স্বাস্থ্য ও সুস্থতার কথা চিন্তা করলেই আমাদের মনে প্রথমেই আসে শারীরিক সুস্থতার বিষয়টি। কিন্তু শরীর এবং মন এ দুই নিয়ে হচ্ছে মানুষ। শরীরবিহীন যেমন মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, তেমনি মনবিহীন মানুষও অসম্ভব। মানসিক স্বাস্থ্য হলো– আমাদের মন, আচরণগত ও আবেগপূর্ণ স্বাস্থ্যের দিক। আমরা কী চিন্তা করি, কী অনুভব করি এবং জীবনকে সামলাতে কী রকম ব্যবহার করি– এগুলোই আসলে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য। আমরা শারীরিক সুস্থতা ও নানা রোগ–ব্যাধি নিয়ে নিজেরা সচেতন হতে পারলেও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটা তেমন আমলে নিচ্ছি না। ফলে লাখ লাখ মানুষ নীরবে মানসিক অসুস্থতার শিকার হচ্ছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলো, আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে ভুলে যাই। তাই সকলের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে কথা না বলার প্রবণতাকে দূর করতে আমাদের এখনই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার সময় এসেছে। এই দিবস পালনের উদ্যোগটি মানুষের মাঝে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে ও মানসিক অসুস্থতার বিষয়ে ভুল ধারণা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে নিঃসন্দেহে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। সারাবিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ১০ অক্টোবর নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই দিবস পালন করা হয়।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিবেচনায় যে পরিমাণ মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ রয়েছেন তা অপ্রতুল। কাজেই এ ক্ষেত্রে জরুরি হচ্ছে পরিবার, সমাজ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ বন্ধুমহলেও এ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা। কারণ মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার আগে একজন মানুষকে কিছু ধাপ পার হতে হয়। যদি প্রাথমিকভাবে ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান থেকেই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তাহলে এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে উত্তম উপায় হতে পারে প্রতিদিনের আলোচনা। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। কারণ মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকাদের আচরণ একটু ভিন্ন হয়। অনেক সময় ব্যক্তি নিজেই বুঝতে পারেন না যে তিনি ঝুঁকিতে আছেন। তাই ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের কথা শিক্ষকেরা এবং কর্মীদের কথা দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সহমর্মিতার সঙ্গে শুনবেন, তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত দেবেন না। সর্বক্ষেত্রে যদি এই চর্চাটা শুরু করা যায় তাহলে আলোচনার মাধ্যমে সহজেই মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা তৈরি করা সম্ভব।’
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, অর্থাৎ সাইকিয়াট্রিস্ট ও সাইকোলজিস্ট–উভয়ের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। বর্তমানে মাত্র ৩৫০ জন সাইকিয়াট্রিস্ট আর ৫০০–এর মতো সাইকোলজিস্ট ১৭ কোটি মানুষের মানসিক সেবা দিচ্ছেন, যা খুবই কম। যেখানে মানসিক রোগের হার প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ১৮ আর শিশু–কিশোরদের মধ্যে ১৩ শতাংশ। আবার এই বিশেষজ্ঞদের বেশির ভাগই অবস্থান করেন বড় শহরগুলোয়। তাঁদের কাছে পৌঁছানোই একটি সীমাবদ্ধতা। এছাড়া, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ছাড়া সরকারি পর্যায়ে উপজেলা কিংবা জেলাগুলোয় নেই কোনো মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো। ফলে প্রান্তিক মানুষের কাছে এই সেবা দূরগম্য। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে কাউন্সেলিং সেবা, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ ও রাষ্ট্র ভূমিকা রাখতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি পত্রিকান্তরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। হোল সোসাইটি অ্যাপ্রোচ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর সংবাদমাধ্যম যদি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে, তাহলে মনের যত্ন আর মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে আরও বেশিসংখ্যক মানুষ উদ্বুদ্ধ হবেন। আর আমার পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এমবিবিএস পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে পাঠক্রম না সাজালে বড় ধরনের গ্যাপ থেকেই যাবে। কারণ, কোনো কোনো চিকিৎসক, এমনকি সাইকিয়াট্রিস্ট ছাড়া অপরাপর কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মধ্যেও মানসিক স্বাস্থ্য, মানসিক রোগ নিয়ে স্টিগমা আর ভ্রান্ত ধারণা বিদ্যমান। এর মূল কারণ এমবিবিএস পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যের অন্তর্ভুক্তি খুবই নগণ্য। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকার পাশাপাশি এমবিবিএস কারিকুলামে মানসিক স্বাস্থ্যের যথোপযুক্ত অন্তর্ভুক্তির দিকে আমরা গুরুত্ব দেব।