সীতাকুণ্ড উপজেলার ছলিমপুর কালুশাহ নগর গ্রামের বৃদ্ধ মোহাম্মদ সিরাজুল হকের বয়স ৮০ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু পিছু ছাড়েনি দারিদ্র্য, দুর্দশা। ২৫ বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন তিন সন্তানকে নিয়ে তার জীবনযাপন। তাই তার কান্না থামছে না। সলিমপুর ইউনিয়নের কালু শাহ নগরের মৃত এরশাদ উল্লাহর পুত্র সিরাজুল। জন্ম ১৯৪৫ সালে। সত্তরের দশকে কাজ করতেন স্থানীয় একটি জুট মিলে। ১৯৭৫ সালে ভাটিয়ারী এলাকার আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয়। তাদের দুই মেয়ে ও ৩ ছেলে। সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলতে খুব কষ্ট করেছিলেন। বিয়ে দেওয়ার পর বিধবা হয়েছে বড় মেয়ে রোকসানা। ১৬ বছরের পুত্র সন্তান নিয়ে কাটছে জীবন। ছোট মেয়ে মোহসেনা বেগম এইচএসসি পাস করেছেন। টাকার অভাবে এরপর আর পড়া হয়নি। তিন ছেলে মোহাম্মদ আলমগীর (৪২), জাহাঙ্গীর আলম (৩৬) ও জানে আলম (৩৩) মানসিক ভারসাম্যহীন। টাকার অভাবে ঠিকমতো তাদের চিকিৎসা হচ্ছে না। সিরাজুলের জীবনে দারিদ্র্যের সঙ্গে এটা বড় একটা চাপ। তার জীবন অনেক কঠিন।
এলাকাবাসী জানান, সত্তর দশকে একটি জুট মিলে দৈনিক শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন সিরাজুল হক। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে ফৌজদারহাট বাজারে চায়ের দোকান করতেন। সংসার ভালোই চলছিল। এরই মধ্যে দুই মেয়ে ও তিন পুত্র সন্তানের বাবা হন তিনি। বড় ছেলে আলমগীর এসএসসি পাস করেন। তার বয়স যখন ১৮ বছর তখন মানসিক রোগের লক্ষণগুলো দেখা দেয়। পুকুরে নেমে দীর্ঘক্ষণ পানি পরিষ্কার করতে থাকেন। পুকুরে পানা ফেলেন, পা দিয়ে ময়লা সরান। সারা দিন এভাবে চলে যায়। মেজ ছেলে জাহাঙ্গীর আলম রোদ কিংবা বৃষ্টিতে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। ছোট ছেলে জানে আলম হাতে পাথর ও গাছের টুকরা নিয়ে মানুষকে মারতে যান। তবে কাউকে মারেন না। ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে এই লক্ষণগুলো দেখা দেয় তিন ছেলের। স্থানীয় চিকিৎসকের মাধ্যমে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হলেও কোনো প্রতিকার মেলেনি। হুজুর দিয়ে অনেক ঝাড়ফুঁক করিয়েছেন সিরাজ। এতেও সুফল আসেনি।
দারিদ্র্যের কারণে সিরাজুল তিন ছেলের উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছেন না। পারিপার্শ্বিক নানা চাপে চায়ের দোকানও চালু রাখা সম্ভব হয়নি। এখন বর্গাচাষি হিসেবে মানুষের জমিতে চাষ করে জীবন নির্বাহ করে আসছেন। অভাব অনটনের মধ্যে অর্ধাহারে, অনাহারে জীবন পার করছেন। ছেলেদের উন্নত চিকিৎসা দিয়ে ভালো করার আশায় ঘুরছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে।
সরেজমিনে সিরাজুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙাচোরা টিনের চালা, একটি ঘরে খালি গায়ে তিন ভাই তিন স্থানে চুপ করে বসে আছেন। কারো সাথে কথা বলছেন না। কিছু জিজ্ঞেস করলেও জবাব দেন না। মাঝেমধ্যে জোরে চিৎকার দেন।
বৃদ্ধ সিরাজুল হক জানান, তাদের তিন ভাইয়ের ১৬ জন সন্তান রয়েছে। কারো সন্তান মানসিক ভারসাম্যহীন হয়নি। কিন্তু তার তিন সন্তানই মানসিক রোগী।
তিনি বলেন, ছেলেদের চিকিৎসার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অনেক মানুষ সাহায্য করেছে। ইচ্ছা থাকার পরও আর্থিক সংকটে তাদের উন্নত চিকিৎসা দিতে নিতে পারছি না।
সিরাজুল হকের ছোট মেয়ে মোহসেনা বেগম বলেন, আমরা গরিব মানুষ। অর্থের অভাবে বাবা–মা তিন ভাইয়ের চিকিৎসা করাতে পারছেন না। হতাশায় আমাদের দিন কাটছে। দুই ভাই সরকারি প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছে। তিন ভাইয়ের চিকিৎসায় সহযোগিতা চান তিনি।
ছলিমপুর ইউনিয়নের সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, ১৫ থেকে ১৮ বছর ধরে ভাঙাচোরা একটি ঘরে অমানবিক জীবন পার করছেন সিরাজুলরা। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করা পরিবারটি পাগল তিন সন্তান নিয়ে এখন দিশেহারা।