বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি শিক্ষাস্তরই এখন বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। মানসম্মত শিক্ষা প্রাপ্তির আশা যেন সবাই ভুলতে বসেছে। আর প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা! সে তো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা আমাদের শিক্ষার মূল স্তর। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরের লক্ষ্যে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছেই। আগের পরীক্ষাপদ্ধতি বাদ সহ বেশ কিছু পরিবর্তন এনে গত শিক্ষাবর্ষ থেকে বাংলাদেশে নতুন যে কারিকুলাম চালু করেছিলো বিগত সরকার তা নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্কের শেষ ছিলো না। শিক্ষক ও অভিভাবকরা নতুন ওই কারিকুলাম নিয়ে উদ্বেগের কথা জানালেও সরকার বলেছিল, নতুন বিধায় এটি বুঝতে সময় লাগছে। শিক্ষকদের অনেকে বলেছেন, নতুন এ পদ্ধতি বোঝার জন্য যে প্রশিক্ষণ দরকার তা সঠিকভাবে দেয়া হয়নি। এর ফলে পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন নিয়ে শিক্ষক–শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই ছিলো অন্ধকারের মধ্যে। বিশেষ করে নতুন কারিকুলামে পরীক্ষা পদ্ধতি পুরোপুরি বাদ দেয়ার সিদ্ধান্তে প্রবল আপত্তি ছিলো অভিভাবকদের। জুলাই–আগস্ট ২০২৪ ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে নোবেল জয়ী প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর সর্বত্রই রাষ্ট্র মেরামত ও সংস্কারের আওয়াজ উঠেছে। মূলত সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এরই মধ্যে অন্তর্র্বর্তী সরকার সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছেন। ফলে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশে উদ্যোক্তাদের একটি প্রজন্ম তৈরি করতে হলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হতে হবে যাতে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে। গত বুধবার রাজধানীর সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা এ মন্তব্য করেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মানুষ জন্মগতভাবে উদ্যোক্তা। তবু, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা চাকরিপ্রার্থী তৈরি করে। এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা। তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমনভাবে সংস্কার করা উচিত যাতে এটি একটি প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। আমাদের এমন শিক্ষাব্যবস্থা দরকার, যা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল মানুষ হতে সাহায্য করবে। আমাদের তরুণদের মধ্যে সৃজনশীলতার যে সম্ভাবনা রয়েছে তা অবশ্যই পূরণ করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা সচিবালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন এবং পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেন। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশে এমন শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা উচিত নয় যেখানে শুধু পরীক্ষার নম্বরের ওপর জোর দেওয়া হয়। তিনি বলেন, পরীক্ষার নম্বর কত পেল সেটাই যে সবকিছু না, এটি সকলের উপলব্ধি করা উচিত।
প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের সমাজে জেনারেশন গ্যাপ (পূর্ববর্তী প্রজন্মের সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের ব্যবধান) কমিয়ে আনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমাদের অবশ্যই নতুন প্রজন্মের ভাষা, তাদের আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের চিন্তার প্রক্রিয়া বুঝতে হবে। অধ্যাপক ইউনূস আরো বলেন, আমাদের তরুণদের ভাষা ও চিন্তা প্রক্রিয়া বুঝতে হবে। আমাদের জানতে হবে কীভাবে প্রবীণ প্রজন্ম তাদের অভিজ্ঞতা তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে শেয়ার করে নিতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তরুণ ও প্রবীণ প্রজন্মের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে, এটি সমস্যা তৈরি করবে। আমাদের অবশ্যই দুই প্রজন্মের মধ্যে ধ্যান–ধারণার ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে। তিনি আমাদের জাতীয় পাঠ্যক্রমে পারিবারিক মূল্যবোধ অন্তর্ভুক্তির ওপরও জোর দেন।
আজ যে শিশু বেড়ে উঠছে এদের মধ্যেই কেউ কেউ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে দায়িত্ব পালন করে উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে আরো গতিশীল, সমৃদ্ধ করে তুলবে। এর জন্য শিশু সহায়ক যে পরিবেশের প্রয়োজন সেটি আমরা কতটা দিতে পারছি তা ভাবা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ বর্তমানে শিশুরা যে পরিবেশে বেড়ে উঠছে বিশেষ করে শিক্ষার পরিবেশ তাদের অনুকূলে নেই। প্রাথমিক স্তর থেকেই শিশুর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে বইয়ের বোঝা। মগজে পড়া মুখস্থ করার চাপ। সকাল থেকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত শিশুকে পড়াশোনার চাপ মাথায় নিয়ে কাটাতে হচ্ছে। অথচ এতটুকু বয়সে এই শিশুদের এত চাপ নেয়ার কথা নয়। তারা বেড়ে উঠবে হেসে খেলে এবং আনন্দের মাঝেই তারা গ্রহণ করবে প্রয়োজনীয় শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, শিশু বইয়ের বাইরে এবং ভালো ফলাফল ছাড়া আর কিছু ভাবনায় নিতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানসম্মত শিক্ষার জন্য মানসম্মত শিক্ষকের সংখ্যা বাড়াতে হবে; যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে হবে; মানসম্মত বই ও শিখন সামগ্রী সরবরাহ ও ব্যবহার করতে হবে; নিরাপদ ও সহযোগিতামূলক শিখন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।